চিত্রভাষাটি ছিলো মানুষের আদি ভাষা

অলকানন্দা

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২১, ০৫:০৬ পিএম

ভাষার মাসে আমাদের দেশের তরুণ চিত্র শিল্পীদের মুখোমুখি হয়েছিলাম সাম্প্রতিক দেশকালের শিল্প-সংস্কৃতি বিভাগ থেকে। প্রত্যেক চিত্রশিল্পীর জন্য ছিলো সাতটি প্রশ্ন। সেই সকল প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন তারা। পর্যায়ক্রমে সেইসব সাক্ষাৎকার প্রকাশ হবে। এবার প্রকাশ করা হলো মোহাম্মদ রবিনের সাক্ষাৎকার। যিনি পেইন্টিং, কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা সম্পন্ন করেছেন। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেছেন-অলকানন্দা।
 
১. সাম্প্রতিক সময়ে চিত্রকলায় বর্তমান বাংলাদেশ কিভাবে উঠে আসছে
আসলে গোড়ার কথাই আগে না আসলে সাম্প্রতিকে আসা যায় না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রথম পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী শশিভূষণ পাল, শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীন স্যার থেকে শুরু করে কামরুল হাসান, এস এম সুলতান, সুফিউদ্দিন আহমেদ ওনারা সবাই শিল্প শিক্ষা শেষে দেশ-বিদেশে ঘুরলেও ওনাদের শিল্পের বিষয় বস্তুর মধ্যে জাতীয়তাবাদ কেন্দ্রিক বিষয়টিই বেশি লক্ষ্য করা যায়। এবং পরবর্তীতে যারা শিল্প শিক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন ওনারাও প্রায় একিই পথের পথিকৃৎ ছিলো। বর্তমানে সেই ধারাবাহিকতায় শিল্পীরা আজও কাজ করে যাচ্ছে দেশ বিদেশে, ফলে বাংলাদেশে শিল্পকলার প্রসার ঘটছে।

২. আপনার তুলিতে দেশের মুভমেন্টগুলো কতটা জায়গা নিয়েছে?
আমার তুলিতে দেশের মুভমেন্টগুলো কতটা জায়গা নিয়েছে সেটা বলতে পারবো না, এটা বড় জটিল প্রশ্ন! তবে এতোটুকু বলতে পারি, আজকে হয়তো চিত্রশিল্পীর জগতে লেগে আছি বলে- গ্রাম থেকে শহরে আসতে পেরেছি চিত্রশিক্ষার উদ্দেশ্যে। পরে নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে বিএফএ পাশ করে বের হয়ে সরকারিভাবে কলকাতার রবীন্দ্রভারতীতে মাস্টার্স শেষ করতে পেরেছি। কোর্স শেষে আমার শিল্পের ভাবনাগুলো সেখানকার শিল্প সংস্কৃতির সাথে পরিচিতির লক্ষ্যে, আমার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী সম্পূর্ণ করেছি। এছাড়াও আরো অন্যান্য দেশ বিদেশে চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছি এবং কয়েকটি থেকে পুরস্কৃত হয়েছি। আমাদের প্রাচ্যের যে লোকায়ত দর্শন, আধ্যাত্মিকতার রূপরেখা এবং প্রকৃতির ভাবনাগুলো নিয়ে আমি আমার চিত্রের বিষয় বস্তু হিসাবে কাজ করছি।

৩. একজন শিল্পী হিসেবে ‘ভাষা আন্দোলন ও চিত্রকলা’ এই দুই আপনার দৃষ্টিতে কেমন?
প্রাক গুহাচিত্রের কথা ভাবলে চিত্রভাষাটা ছিলো মানুষের আদি ভাষা। যা আমরা শিল্পীরা চিত্রকলাকে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবেই দেখি। এখন এ পথের পথিক যারা আমরা আছি, তারা সহজেই চিত্রভাষাটাকে অনুমান করতে পারি। এখন এই আন্তর্জাতিক চিত্রভাষা দেশীয় ঘরানা হয়ে উঠে কিভাবে? চিত্রশিল্পীর তুলির আঁচড়, রং, রেখা বিষয় বস্তুর গঠনেই বলে দেয় সে কোনো ভাষার হয়ে কথা বলতে চাই! এক কথায় যখন শিল্পীর শিল্পকর্মে জাতীয়তাবাদ বিষয়টি কাজ করে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম হাতে অস্ত্র ধরেননি, ধরেছেন কলম। সেই কলমের বর্ণের চয়নগুলো কত-শত দুর্বলকে সবলে পরিণত করেছেন। আমি চিত্রের বিষয়টিকে এভাবে দেখি।

৪. দক্ষিণ এশিয়ার চিত্রকলা সম্পর্কে জানতে চাই- এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্রকলার অবস্থা কেমন?
দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকলা আগের থেকে অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছে এটা ঠিক। যেমন- বিগত বছরগুলোতে আমার দেখা অভিজ্ঞতায় যদি বলি- ঢাকা আর্ট সামিট, এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল এবং ভারতের কয়েকটি মডার্ন গ্যালারির কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় বলাই যায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশও শিল্পকলায় অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছে।

৫. আমাদের চিত্রকলায় পশ্চিমা প্রভাব কেমন, ইজমের ঘেরাটোপে এদেশে চিত্রকলার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?
মূলত আমাদের রক্তের সাথে মিশে আছে পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্যের ধারা। যেগুলো ইচ্ছে করলেই মুছে ফেলে দিয়ে পশ্চিমের রঙে রঙ্গিন হলেই তাকে আধুনিক বলে না, আধুনিক হতে হলে আমাদের শিকড়ের যে গুণাগুণ আছে সেটাকে প্রসিদ্ধ করে সে রঙে রঙ্গিন হয়ে কতো রূপে কতো রকমে বিশ্বকে দেখানো যায় সেটাই হবে আধুনিক। আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষ পশ্চিমা প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। আর ইজমের কথা যদি বলি, শুধু বাংলাদেশে না ইন্ডিয়াতেও আমি দেখেছি মর্ডান, পোস্ট-মর্ডান, কনটেম্পোরারি এ ধারায় চিত্রকলা এখন বেশি চলমান।

৬. একটা সময় ছিলো চারুকলার শিক্ষার্থীদের সমাজে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হতো, সে সময় বদলেছে বলা হয়; সত্যিই কী তাই?
আসলে কোনো ভিউ থেকে চারুকলা শিক্ষার্থীদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে? সেটা আরো স্পষ্ট হলে মনে হয় ভালো হতো! ধর্মীয় গোড়ামি সেটা আগেও ছিলো এখনো আছে, যা বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনে বাঁধার সৃষ্টি করে। আগেও চিত্রশিল্পীর একটা মর্যাদা ছিলো এখনো সমাজে সেটা আছে। যেমন- শিল্পীর সম্মান আছে কিন্তু সঠিক মূল্যায়নটা নাই। তাই চিত্রশিল্পী সম্মানের সাইনবোর্ড নিয়ে কষ্টে দিন যাপন করছে এরকম নজিরও দেশে কম নয়।

৭. চিত্রকলা একটি শিল্প এই শিল্প সৃষ্টির সাথে শিল্পীর জীবন ধারণের সম্পর্ক রয়েছে সেই জায়গাটা দেশীয় প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে কী?
চিত্রকলার একটা আলাদা জগৎ আছে। সেটা সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত অন্যান্য পেশাজীবীর মানুষজন তেমন জ্ঞান রাখেন কিনা আমার সন্দেহ আছে? জীবনের প্রতিটি কাজে একটা নান্দনিকতা থাকে। আর এ নান্দনিকতাই হচ্ছে শিল্পকলার বিষয় বস্তু। সেটাকে কখনো সূক্ষ্মভাবে খুঁটিয়ে দেখা হয় বলে মনে হয় না। অথচ দেশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নান্দনিকতার ক্ষেত্রে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা হয়- এটা এমন না হয়ে অন্যরকম হলে ভালো হতো? নান্দনিক বুঝি কিন্তু সেটা কে ধারণ করে প্রশ্নগুলো করতে পারি না। সে জায়গা থেকে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আমি মনে করি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh