শিশু পেটানো হাটহাজারীর সেই মাদরাসা শিক্ষক আটক

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২১, ০৮:১৯ পিএম

চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমির হিফজ বিভাগের শিশু শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক হাফেজ ইয়াহিয়াকে আটক করেছে পুলিশ।

বুধবার (১০ মার্চ) বিকেল তিনটার দিকে তাকে রাঙ্গুনিয়ার সাফরভাটা এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাটহাজারী থানার ওসি রফিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। তবে শিশুটির মা-বাবাকে রাজিতে চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি তারা রাজি না হয় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।’

মঙ্গলবার রাত থেকে শিশুটিকে মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। শিক্ষক হাফেজ ইয়াহিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থী ইয়াসিন ফরহাদকে মারধরের ঘটনার পরে হাটহাজারী উপজেলার ইউএনও রুহুল আমিনের নেতৃত্ব মঙ্গলবার (৯ মার্চ) রাত ২টার দিকে মাদরাসা থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়ে। পরে শিশুর অভিভাবক শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো অভিযোগ করতে রাজি না হওয়ায় মুচলেকা দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ওই শিক্ষককে বরখাস্ত করলেও বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে তাকে বুধবার বিকেলে রাঙ্গুনিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে আটক করে পুলিশ।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমির হিফজ বিভাগে মঙ্গলবার ছেলের জন্মদিনে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন তার মা। আধ ঘণ্টার মতো ছেলের সাথে সময় কাটিয়ে মা যখন ফিরছেন, আট বছরের শিশুটি তখন মায়ের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ ইয়াহিয়া শিশুটির ঘাড় ধরে ফিরিয়ে আনেন তাকে, ঠেলতে ঠেলতে ঢোকান এক কক্ষে, তারপর তাকে নৃশংসভাবে পেটাতে শুরু করেন। এই শিশু নির্যাতনের ঘটনাটি এখন ইন্টারনেটে ভাইরাল।

রাতেই চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন ওই শিশুটিকে মাদ্রাসা থেকে নিয়ে আসেন, আটক করা হয় নির্যাতনকারী শিক্ষককেও। কিন্তু শিশুটির মা-বাবা আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করতে রাজি না হওয়ায় প্রশাসন এক পর্যায়ে ওই শিক্ষককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। যদিও বুধবার সকালে হাফেজ ইয়াহিয়াকে বরখাস্ত করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।

ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া তেত্রিশ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, লম্বা সাদা আলখাল্লা পরা এক ব্যক্তি ছোট্ট একটি শিশুকে ঘাড়ের কাছের কাপড় ধরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছেন। শিশুটির পরনে হালকা গোলাপি পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা আর সাদা গোল টুপি। কয়েক পা যাওয়ার পর শিশুটিকে একটি ঘরে ঢোকানো হয়। এরপর শিশুটিকে মাটিতে ফেলে বেত দিয়ে পেটাতে শুরু করেন ওই ব্যক্তি। শুরুতে শিশুটির ডান হাত ধরে পেটানো হয়, এক পর্যায়ে শিশুটি মাটিতে শুয়ে পড়ে। তখন তার ডান পা টেনে ধরে পায়ের ওপর পেটাতে থাকে ওই শিক্ষক।

হাটাহাজারি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেছেন, ভিডিওটি দেখেই শিশুটিকে এবং অভিযুক্ত শিক্ষককে শনাক্ত করা হয়েছে এবং ভিডিওটি যে মঙ্গলবারই ধারণ করা হয়েছে সে ব্যাপারেও তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে ভাইরাল ভিডিওটি দেখে তিনি রাত একটার দিকে পুলিশ নিয়ে হাটহাজারীর মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমি নামে ওই মাদ্রাসাটিতে যান। সেখান থেকে নির্যাতনের শিকার শিশু, অভিযুক্ত শিক্ষক এবং মাদ্রাসার পরিচালককে নিয়ে উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ে নিয়ে আসেন। এর পর শিশুটির মা-বাবাকে ডেকে আনা হয়। মা-বাবাকে ভিডিওটি দেখানোর পর মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিন্তু তারা ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ দিতে চান না, তাকে কোনো সাজা দিতে চান না।

শিশুটির মা-বাবা মামলা করতে রাজি তো হনই নি, বরং নির্যাতনের শিকার শিশুর মা-বাবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে একটি চিঠি দিয়েছেন রাতেই, যেখানে অভিযুক্ত শিক্ষকের রুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিতে আবেদন জানানো হয়েছে। ফলে রাত সাড়ে চারটায় ওই শিক্ষকের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে শিশুটির মা-বাবার জিম্মায় তাকে ছেড়ে দেয় প্রশাসন।

শিশুটির বাবা মোহাম্মদ জয়নাল বলেছেন, তার সন্তানকে মারধরের ঘটনায় তিনি ও তার স্ত্রী অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে চান না। তিনি বলেন, ‘ছেলেকে হাফেজী পড়াইতে চাই আমরা, সে তো ওইখানে পড়বে, তাইলে মামলা করে কী হবে? উল্টা শিক্ষকের জীবনটা নষ্ট হবে।’

অভিযুক্ত মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমি নামে ওই মাদ্রাসার হিফয শিক্ষক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া গত তিন মাস ধরে এই আবাসিক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। তিনি আটকের আগে বলেছেন, নির্যাতনের ঘটনায় তিনি শিশুটির মা-বাবার কাছে তিনি মাফ চেয়েছেন। জন্মদিনে শিশুটির মা ছেলের জন্য মিষ্টি ও চকলেট নিয়ে এসেছিলেন। এমনকি তাকে (মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে) নাস্তা খাওয়ার জন্য মা দুইশো টাকাও দিয়েছিলেন। এরপর মা যখন চলে যাচ্ছেন, সেসময় শিশুটি দৌড়ে মাদ্রাসার বাইরে বেরিয়ে রাঙ্গামাটি-হাটহাজারী চৌরাস্তায় চলে যায়। শিশুটিকে ফিরিয়ে আনতে আনতে তিনি (মোহাম্মদ ইয়াহিয়া) রেগে গিয়েছিলেন। আসলে যে রকম দেখা যাচ্ছে, অত জোরে মারতে ছিলাম না, বেতটাও হাফ বেত, এক বিঘতের চেয়ে একটু বড় সাইজ। বেশি জোরে লাগে না। কিন্তু আমার অন্যায় হয়েছে, ওইভাবে মারা উচিত হয় নাই।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh