হামিম উল কবির
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২১, ০৮:৪৮ এএম | আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২১, ০৮:৫১ এএম
শীতের পর গরমের শুরুতেই বেড়ে গেছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। গত এক মাসের ব্যবধানে একদিনে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ।
ইউরোপীয় ও আমেরিকান দেশগুলোতে ঠান্ডায় সংক্রমণের সংখ্যা বাড়লেও, বাংলাদেশে শীতকালে তুলনামূলক সংক্রমণ কম ছিল। আর ধীরে ধীরে অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে; কিন্তু হঠাৎ করেই আবহাওয়া গরম হয়ে ওঠায় সংক্রমণ বেড়ে গেলে বিস্মিত হয়েছেন ভাইরোলজিস্টরা।
এতদিন বলা হতো যে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠান্ডায় বেশি বাড়ে এবং গরমে কমে যায়; কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে এর উল্টোটা।
শুধু চলতি মার্চ মাসের সরকারি পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে, প্রথম দিনেই করোনা শনাক্তের সংখ্যা পাঁচশতের ঘর অতিক্রম করেছে এবং সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ থেকে একদিনে শনাক্ত ১০১৪ ছাড়িয়ে গেছে। অনেকদিন পর এটি ছিল সর্বোচ্চসংখ্যক সংক্রমণ। তাহলে কি বাংলাদেশে গরমে করোনা বেড়ে যেতে পারে?
এ ব্যাপারে ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, সামনের দিনগুলোতে গরমে হয়তো সংক্রমণ কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। একটি ছোট আকারের ঢেউ আসতে পারে। তবে তা খুব বেশি স্থায়ী হবে না। ইতিমধ্যে ফেব্রুয়ারিতে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে করোনা টিকা প্রদান কার্যক্রম। ১৩ মার্চ পর্যন্ত ৪৩ লাখ চার হাজার ২৫৯ জনকে প্রথম ডোজ টিকা দেয়া হয়ে গেছে।
কেন করোনা শনাক্ত বাড়ছে?
কেন বাংলাদেশে হঠাৎ করোনা শনাক্ত বাড়ছে এর সঠিক কারণটি ভাইরোলজিস্টরা বলতে পারছেন না। তবে তারা অনুমান করে বলার চেষ্টা করছেন যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস উল্টো আচরণ করছে। শীতপ্রধান ইউরোপ আমেরিকায় ভাইরাসটি জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠলেও বাংলাদেশে ছিল অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে করোনা বাংলাদেশে তেমন উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠেনি। করোনার নতুন ভেরিয়েন্টটিও (রূপান্তর) কিছু মাত্রায় বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকান ভেরিয়েন্টটি ছিল খুবই শক্তিশালী।
গণস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও আরও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিয়েন্ট ঢাকা শহরে পাওয়া গেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল যে, দক্ষিণ আফ্রিকান এ ভেরিয়েন্টটি বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলতে পারে; কিন্তু দেখা গেল এটাও তেমন বিকশিত হতে পারেনি। কেন হয়নি এর সঠিক যুক্তি নেই। ভাইরোলজিস্টরা এর কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
তবে গত শীতে দেশে কেন করোনা সংক্রমণ কম ছিল এর একটি যুক্তি দেখিয়েছেন বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, ফ্লুর চারটি ভাইরাস বাংলাদেশে শীতকালে খুবই সক্রিয় থাকে। শীতকালে এই ভাইরাসগুলোর কারণে মানুষের সর্দি-জ্বর, কাশি হয়ে থাকে। এই ভাইরাসগুলো কোষে গিয়ে বসে থাকে এবং মানুষের উপরোক্ত রোগগুলোর কারণ হয়ে থাকে। শীতে এমনিতেই চারটি ভাইরাস কোষে গিয়ে বসে থাকে। ফলে কোষের ভেতরে নতুন কোনো ভাইরাসের (করোনা) প্রবেশের মতো আর কোনো জায়গা খালি থাকে না অথবা এই ভাইরাসগুলো করোনাভাইরাসকে কোষে প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে করোনা কোষে প্রবেশ করতে পারে না বলে মানুষকে দুর্বল করতে না পেরে হয় করোনাভাইরাসের মৃত্যু হয়, নয়তো সে অন্য দেহ থেকে বের হয়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, ঠিক কীভাবে হচ্ছে, তা জানার জন্য গবেষণা প্রয়োজন। এ কাজটি রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) দায়িত্ব; কিন্তু নতুন এ গবেষণাটি করার জন্য তাদের পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, আইডিসিআরকে এ গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য।
গরমে করোনা বেড়ে যেতে পারে?
বাংলাদেশে গরমে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভাইরোলজিস্টরা ইতিমধ্যেই এ আশঙ্কার কথাটি বলতে শুরু করেছেন। তারা যুক্তি হিসেবে বলেছেন, গত বছরের মে থেকে শুরু করে আগস্ট পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। ২০২০ সালের ২ জুলাই দেশে সর্বোচ্চ চার হাজার ১৯ জন করোনা শনাক্ত হয়েছিলেন। আগস্ট মাসের মধ্যে ১৮ আগস্টে সর্বোচ্চ তিন হাজার ২০০ শনাক্ত হয়। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ দুই হাজার ৫৮২ জন শনাক্ত হয়। এরপর ৩০ নভেম্বর সর্বোচ্চ দুই হাজার ৫২৫ জন করোনা শনাক্ত হয়। এরপরের ইতিহাস ক্রমান্বয়ে করোনা হ্রাস পাওয়ার। সর্বশেষ ৭ ফেব্রুয়ারি একদিনে সর্বনিম্ন ২৯২ জন শনাক্ত হয় ভাইরাসটিতে।
ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, বাংলাদেশে গরমের মধ্যেই করোনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হয়তো দেখা যাবে সামনের গরমে সংক্রমণ রেখা কিছুটা উপরের দিকে উঠতে পারে। তবে তা খুব বড় কিছু নাও হতে পারে অনেক কারণে। প্রথমত, বাংলাদেশের মানুষ জন্ম থেকেই অনেক ধরনের ভাইরাসের মোকাবেলা করেই বড় হয়ে ওঠে। ফলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীর যেমন সহনীয় হয়ে ওঠে, তেমনি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা (অ্যান্টিবডি) গড়ে ওঠে শরীরে। এসব কারণে নতুন করে করোনা সংক্রমণ ঘটলে তা খুব বেশি কাহিল করতে পারে না। এসব কারণে করোনার বিস্তার তেমন ঘটবে না বলে মনে করছেন ভাইরোলজিস্টরা।
ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণ
শীতের পর ফেব্রুয়ারিতে ধীরে ধীরে আবহাওয়া উষ্ণ হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ঠিক এ সময়েই বাংলাদেশে একদিনে ৭ ফেব্রুয়ারি করোনা সংক্রমণ ছিল সর্বনিম্ন। সেদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত (আগের দিন সকাল ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত যত শনাক্ত হয়, তা সেদিনের শনাক্ত হিসেবে ধরা হয়) দেশে করোনা শনাক্ত হয় ২৯২ জন ও সেদিন মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। ফেব্রুয়ারিতে একদিনে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। অবশ্য ২৩ ফেব্রুয়ারি একদিনে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ করোনা শনাক্ত হয়েছে ৪৭০ জন। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে (২১ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি) ৭ দিনে ৯৬ হাজার ৯৭৯টি নমুনা পরীক্ষা করে দেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে দুই হাজার ৮০৭ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছে ৫৮ জন।
এর পরের সপ্তাহে (২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ) এক লাখ এক হাজার ৪৯৭টি নমুনা পরীক্ষা করে করোনা শনাক্ত হয়েছে তিন হাজার ৮৯৩ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৫১ জন। এই দুই সপ্তাহের ব্যবধানে করোনা শনাক্ত বেড়েছে ৪.৬৬ শতাংশ এবং মৃত্যু কমেছে ১২.৭ শতাংশ।