বিশ্বে প্রভাব হারিয়ে ফেলার পথে কি চীন?

রাবেয়া আশরাফী পিংকি

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২১, ০৯:২৫ এএম

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং

মাত্র দুই দশকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রায় কেন্দ্রস্থলে পৌঁছেছে চীন। এ সহস্রাব্দের শুরুর তুলনায় বর্তমানে দেশটির অর্থনীতি পাঁচগুণেরও বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে। চীনের এই রূপান্তর অত্যন্ত বিস্ময়কর; কিন্তু এ উত্থানকে ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ক্রমে একা হয়ে পড়ছে দেশটি।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুসম্পর্ক ধরে রাখার ক্ষেত্রে চীন ক্রমে তার অবস্থান হারিয়ে ফেলছে। কিছু সম্পর্ক রয়েছে যেগুলো অনেক প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হলেও, তা এখন শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়ার মতো কিছু অনগ্রসর দেশ এখনো চীনের বন্ধু। 

এছাড়া নিজেদের অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে একাই যথেষ্ট এ ধরনের মনোভাব থেকে দেশটি উন্নত দেশগুলো থেকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। দেশটির প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা কমে আসছে। আর এ বিষয়গুলো চীনকে বিপজ্জনক করে তুলেছে। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অবনতি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে চীনের জন্য সত্যিকার অর্থেই বেশ সমস্যার। চীনের দেয়া প্রতিশ্রুতি কেউ-ই আর গুরুত্বের সাথে দেখছে না। এছাড়া দেশটির প্রচার-প্রচারণাও এখন আর কানে তোলা হচ্ছে না। উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের অনেক কাজই বন্ধ রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরের সিংহভাগ মালিকানার দাবি জানিয়ে বেইজিংয়ের নানা কর্মকাণ্ডে কোনো দেশেরই সমর্থন নেই।

অন্যদিকে স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল হংকংয়ের নিয়ন্ত্রণ গত বছর চীন নিয়ে নেয়ার পর, সেখানকার অনেক দক্ষ পেশাজীবীই এখন অন্যান্য দেশে পালিয়ে যাচ্ছে; আর তাদের অভিবাসনের সুযোগ করে দিতে পশ্চিমা দেশগুলো লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বের অনেক দেশই তাদের টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক থেকে চীনের প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ে ও জেডটিইকে নিষিদ্ধ করেছে। আর চীনের সম্ভাব্য হুমকির জবাব দিতে ভারত, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান নিজেদের সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক করে তুলছে। 

কিন্তু বর্তমানে কঠোর কট্টরপন্থী বাদে বাকি কেউ-ই হয়তো চীনের এমন শোচনীয় পরাজয় দেখতে চায় না। এছাড়া চীনের বাইরে থেকে এসে অন্য কারো পক্ষে দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিকে নের্তৃত্বচ্যুত করে তাদের বেইজিংয়ের কেন্দ্রস্থল থেকে বের করেও দিতে পারবে না। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিচক্ষণ লক্ষ্য হতে পারে, চীনকে প্রায় ১০ বছর আগের শ্লথ উদারীকরণের পথে নিয়ে যাওয়া; ২০১২ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এই লক্ষ্যটি এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে করে চীন নিজেই তা বাছাই করে নেয়। 

এছাড়া চীনের নেতারা যতদিন বিশ্বাস করবে যে, ওয়াশিংটনের বিদ্বেষের কারণেই তাদের সব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, ততদিন দেশটিতে সংস্কার অসম্ভব। অবশ্য বর্তমানে চীন মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্র একটি সাবেক পরাশক্তিধর দেশ ও তারা নিজেরা বিশ্বে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। নিজেদের সর্বোচ্চ অবস্থানে দেখার পাশাপাশি চীন বর্তমানে এটি দেখছে যে, আগের তুলনায় অনেক বেশি দেশের সাথে শত্রুতা সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি এসব শত্রুতার কোনোটিই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে হয়নি। দেশটির নেতারাও এ বার্তা পেয়ে গিয়েছেন। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে চীনের সম্পর্কের ভবিষ্যত নির্ভর করছে, কর্তৃত্ব নিয়ে তাদের নিজস্ব মনোভাবের ওপর। 

কিন্তু বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশের সাথেই চীনের দ্বন্দ্ব চলছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে জাপান, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকাসহ বিশ্বের সব প্রান্তেই চীনের শত্রুতামূলক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান প্রশাসন সাবেকদের দেখিয়ে দেয়া পথ অনুসরণ করে দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি প্রভাব সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এখান থেকেই দেশটির সাথে চীনের বিবাদের সূচনা হয়েছে। 

অন্যদিকে সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে জাপানের সাথে অচলাবস্থা চলছে চীনের। উল্লেখ্য, পূর্ব চীন সাগরে অবস্থিত সেনকাকু দ্বীপ বেইজিংয়ের কাছে দিয়াউ নামে পরিচিত। দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে জাপানের কাছে থাকলেও চীন এর দাবি ছাড়েনি। এতে মজুদ তেল, গ্যাস, মূল্যবান খনিজসম্পদ ও এর জলসীমায় মাছ শিকারের অধিকার আদায়ের জন্য জাপান-চীন-তাইওয়ানের ত্রিমুখী লড়াই চলছে বহুদিন ধরেই। 

ভারতের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব লাদাখ সীমান্ত নিয়ে। উল্লিখিত এসব কোনো একটি বিবাদই যুক্তরাষ্ট্রের কারণে সৃষ্টি হয়নি। এমনকি দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা নিয়ে চলমান বিবাদের কারণেও এসব দ্বন্দ্ব নয়। চীন সাগর নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার পাঁচটি প্রতিবেশী দেশই চীনের বিরুদ্ধে। 

এ তো গেল চীনের নিজ অঞ্চলের কথা। বিশ্বের অন্যান্য মহাদেশের সাথেও চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। মানবাধিকার লঙ্ঘন ইস্যুতে ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে চীনের মতবিরোধ চলছে। অবৈধভাবে মাছ শিকার নিয়ে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সাথে ও উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট ঋণ নিয়ে আফ্রিকার দেশগুলোর সাথে দ্বন্দ্ব চলছে চীনের। 

ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডো বাইডেন মিত্রদের সাথে কাজ করার কথা জানিয়েছেন ও তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ‘আন্তর্জাতিক সিস্টেমের অপব্যবহারের’ জন্য চীনকে জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে পূর্বসূরি ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্ট বাইডেন সম্ভবত চীনের প্রতি ততটা কঠিন হবে না। এছাড়া বিজ্ঞজনরাও বলছেন, বাইডেন যদি সত্যিকার অর্থেই তার চীন নীতিতে ভিন্নতা আনতে চান, তাহলে তার ফিরে আসা উচিত ও সময়কে নিজের মতো করেই চলতে দিতে হবে। 

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক প্রযুক্তিতে চীনের প্রবেশ সীমিত করার মতো কিছু কিছু ক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের মতো বিধি-নিষেধ রাখতে পারেন বাইডেন; অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন বেপরোয়া আচরণ করেছেন এমন কিছু বিষয় থেকে তিনি সরে আসতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রথম ভালো পদক্ষেপ হিসেবে চীন থেকে আমদানি করা ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক তুলে নিতে পারেন বাইডেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের পদক্ষেপে জাপান ও তাইওয়ানের মতো মিত্র দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

এছাড়া চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের জন্য ট্রাম্প ভিসা সীমাবদ্ধতার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেটিও তুলে নিতে পারেন বাইডেন। এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে বেইজিংয়ের ওপর সংস্কারের যে চাপ রয়েছে, তা না কমিয়েই যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কে আরও সম্মিলিত সুর আনা সম্ভব হবে। 

রাজনৈতিক ও স্বভাবসুলভভাবে যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য কিছু না করাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। এই প্রেসিডেন্টের হাতে এমন কিছু অভাবনীয় ক্ষমতা আসে, যা অনেক রকমভাবেই ব্যবহার করা হয়। তাদের নের্তৃত্বের জন্য অনেক সমালোচনাও শুনতে হয়; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের কর্তৃত্বপরায়ন নের্তৃত্ব একটি সুন্দর পরিবেশকে বিনষ্ট করতে পারে। এ অবস্থায় একমাত্র বিশৃঙ্খলা তৈরি করেই বিজয়ের কথা ভাবতে পারে চীন। ফলে বাইডেনের এখন প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে চীনকে এ ধরনের ঝামেলা করতে না দেয়া।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh