একজন কামাল হোসেন ও তাসনুভার গল্প

মাহমুদ সালেহীন

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২১, ০৯:৪৬ এএম

তাসনুভা শিশির

তাসনুভা শিশির

৮ মার্চ থেকে নিজের নতুন পরিচয় সারাদেশকে জানান দিলেন কামাল হোসেন। তবে এই নামটি তার অন্ধকার এক জীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। সাহস ও প্রচণ্ডরকমের স্বপ্ন নিয়ে স্রোতের বিপরীতে বেড়ে ওঠা কামাল হোসেনকে আজ পুরো দেশ চেনেন তাসনুভা শিশির নামে। 

তাকে একজন উঠতি অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী কিংবা সংবাদ উপস্থাপক- এমন নানান বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়। টেলিভিশন কিংবা ইউটিউবের পর্দায় তাসনুভার বাচনভঙ্গি দেখে যে কেউ ভাবতেই পারেন, আর আট-দশ জন মানুষের মতোই তিনি একজন; কিন্তু আজকের তাসনুভা আনান শিশিরের বহু বসন্ত কেটেছে ভিন্ন পরিচয়ে। 

তাকে একসময় ডাকা হতো কামাল হোসেন। তার কামাল হোসেন পরিচয় থেকে শিশির হয়ে ওঠার গল্পটা দীর্ঘ সংগ্রামের। সেই সংগ্রামে রয়েছে শুধু লাঞ্ছনা আর বঞ্চনার গল্প। তবে ইচ্ছাশক্তি, পরিশ্রম ও ধৈর্যের দ্বারা মানুষ তার ভাগ্যকে বদলাতে পারে। তারই দৃষ্টান্ত কামাল হোসেন। যাকে আজকে পুরো দেশ চেনেন তাসনুভা শিশির নামে। প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। 


পরিবারের ভালোবাসা না পেয়ে যে তাসনুভার বেড়ে ওঠা সে এখন হাল ধরেছেন পরিবারের। তবে দিন বদলায়নি এখনো। মা-বাবার মুখ দেখার তীব্র ইচ্ছা পূরণ হয়নি বহুদিন। তিন বোন আর এক ভাইয়ের সাথে নেই কোনো যোগাযোগ। ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে বেড়ে ওঠা তাসনুভার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল বড় হওয়ার। বাগেরহাটে জন্ম নেয়া তাসনুভার জন্মের পর মা-বাবা নাম রাখেন কামাল হোসেন। উচ্চ-মাধ্যমিকে থাকতে তাসনুভা উপলব্ধি করেন, তিনি মেয়েদের মতো চলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মা-বাবা বুঝতে পেরে বন্ধ করে দেন তাসনুভার নৃত্য করা। আশপাশের লোক বলতে শুরু করেন ‘হিজড়া’। মা-বাবার সম্মানের দিকে তাকিয়ে ঘর ছাড়েন তিনি। জন্মস্থান ছেড়ে চলে আসেন নারায়ণগঞ্জে। সেখানেই তোলারাম কলেজে সমাজকর্মে শেষ করেন মাস্টার্স। একইসাথে চলতে থাকে লড়াই। 

তাসনুভা ততদিনে তার ভেতরের চাওয়াকে সম্মান দিয়ে নারীর বেশভুষায় চলতে শুরু করেছেন। ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শে পুরুষ থেকে রূপান্তরিত নারী হয়ে কামাল থেকে হয়ে ওঠেন তাসনুভা আনান শিশির। রূপান্তরিত হয়ে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। ‘হিজড়া’ হিসেবে যখন পরিচিত ছিলেন, তখন আর্থিক সংস্থাপন করাটা ছিল সহজ। ছেলেদের মতো চলাফেরায় টিউশনি কিংবা নৃত্য চালিয়ে যেতে পারতেন। রূপান্তরের পরে কাজ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করতেন, সেটিও বন্ধ হতে থাকে। তারপরে দেখা গেল, কেউ অনুষ্ঠানে ডাকছে না। তবে থেমে থাকেননি তাসনুভা। নিজ যোগ্যতায় পায়ের মাটি শক্ত করেছেন।

বাঁকা চোখ আর কটূক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এগিয়ে চলেছেন স্বপ্নপূরণে। তাসনুভা এখন মাস্টার্স করছেন ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে পাবলিক হেলথ বিষয়ে। 


সাম্প্রতিক সময়ে তাসনুভার পালকে যুক্ত হয়েছে আরো দুই পরিচয়- অভিনেত্রী ও সংবাদ উপস্থাপক। ‘কসাই’ নামে একটি সিনেমায় অভিনয় করছেন তিনি, যা চলতি মাসেই মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে, বৈশাখী টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে যাত্রা শুরু করলেন ৮ মার্চ থেকে।

এত কিছুর মধ্যেও তাসনুভার পরিবার কাছে আসেনি। তারা কামাল হোসেনকেই চায়। তাসনুভার শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই। 

এই প্রসঙ্গে তাসনুভা বলেন, ‘বাবার বয়স হয়েছে। মা অসুস্থ। ফ্যামিলিতে কন্ট্রিবিউশন আমি করছি। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়া অনেক বড় প্রভাব ফেলে আমাদের সমাজে। সেটি খানিকটা হওয়ার কারণে, বাড়ি আসতেই পারবা না, সে জায়গাটি এখন আর নেই। তবে তাদের মান-সম্মানের ভয়ে, আশপাশের মানুষ কী বলবে, এই ভয়ে আমি বাড়ি যাই না।’ 

অন্য চার বোন ও এক ভাইয়ের সাথেও নেই যোগাযোগ। বোনরা সবাই ঘর-সংসার করছেন। বাচ্চাও আছে। ভাগ্নে-ভাগ্নিদেরও চেনেন না তিনি। বছরান্তে বোনদের সাথে কথা হয় দু-এক মিনিট। কেউই কারও কাছে জানতে চান না, কে কোথায় আছে। তাসনুভাও বোঝাতে চান না তার নারী হয়ে ওঠার অগ্রগতির কথা। তিনি বলেন, আমি কথা বলি না। কাজে ব্যাঘাত ঘটে। আমাকে তো খেতে হয়, পরতে হয়। এই রিলেশন প্যানপ্যানানি আমার বিরক্ত লাগে।


তবে তাসনুভা সন্তান হিসেবে নিজের দায়িত্বের কথা মনে রেখেছেন। মাস শেষে অনেক যত্নে জমানো টাকা বাড়িতে পাঠান মা-বাবার জন্য। তাসনুভা এখন মানসিকভাবে স্থির হতে চান। বিয়ে করে একটি পরিবার নিয়ে বাঁচতে চান। ‘বিয়ে করতে চাই। সংসার করতে চাই; কিন্তু সোসাইটি তো সংবেদনশীল না এখনো। যেখানে আমাদের দেশের মেয়েদেরই বিয়ের পর যৌতুকসহ সব কিছুতে চাপ নিতে হচ্ছে, সেখানে আমাকে স্বীকৃতি দেবে তেমন পরিবেশ তো হয়নি। আর প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রেও তো সাধারণ মেয়েদেরই কতরকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়। সেখানে আমাদের তো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। আমি এখন একজন মানুষের কথা ভাবছি। যার মা-বাবার কাছে আমি ছেলের বউয়ের সম্মান পাবো। নারী হিসেবে মর্যাদা পাবো।’

তাসনুভা শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবছেন না। তার মতো রূপান্তরিত নারী ও হিজড়া জনগোষ্ঠীদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করতে চান। ‘আমরা একটা নীতিমালা চাই। যাতে বলা থাকবে সার্টিফিকেট নেম কীভাবে চেঞ্জ করবে, ডাক্তারি পরীক্ষা কীভাবে সম্পন্ন হবে। পরিবার গঠন কীভাবে হবে আমরা জানি না। সম্পদের ভাগ কীভাবে হবে তা স্পষ্ট না। সবকিছুর একটা সঠিক নীতিমালা থাকা দরকার।’ নীতিমালা না থাকায় তাসনুভা নিজেও জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম পরিবর্তন করতে পারছেন না বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন। 

সাম্প্রতিক সময়ে হিজড়া বা রূপান্তরিতরা অনেকেই পরিবারের সহযোগিতা পাচ্ছেন। পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে আশার কথা জানালেন তাসনুভা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত ১০ বছরে এখন তো পরিবেশটা পাল্টেছে। হয়তো আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কারণে তারা বলতে পারছে না।’


এতসব বঞ্চনার মধ্যেও কিছু ভালোবাসার গল্প আছে, যা এখনই জানাতে চাইলেন না তাসনুভা। আরেকটু থিতু হলে আত্মজীবনী নিয়ে প্রকাশ করতে চান বই। যা লিখছেন প্রতিনিয়তই।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh