তিস্তা চুক্তির আহ্বান বাংলাদেশের

নিজস্ব প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২১, ০৮:১৬ পিএম

শুষ্ক মৌসুমে অনেক নদীর পানি শুকিয়ে পলি জমতে থাকে-ছবি বিবিসি

শুষ্ক মৌসুমে অনেক নদীর পানি শুকিয়ে পলি জমতে থাকে-ছবি বিবিসি

তিস্তা ও অন্য ছয়টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সই করার জন্য ভারতের প্রতি জোর আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।

মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) দিল্লিতে পানিসম্পদ সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ এই আহ্বান জানায়। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন কবির বিন আনোয়ার এবং ভারতের পক্ষে পঙ্কজ কুমার।

মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হলেও গত ১০ বছরে সই হয়নি। এই চুক্তিটি দ্রুত করার বিষয়ে বাংলাদেশ জোর দেয়। একই সাথে মনু, ধরলা, গোমতী, খোয়াই, দুধকুমার ও মুহুরি নদীর পানি বণ্টনের ওপরও জোর দেন সচিব কবির বিন  আনোয়ার।

গঙ্গা পানি চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ যে পানি পায়, সেটির সর্ব্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য যৌথ সমীক্ষার ওপরেও জোর দেয় বাংলাদেশ।

এছাড়া রহিমপুর খাল খনন, তিতাস নদীর পানি দূষণ, পশ্চিমবঙ্গে পানি প্রত্যাহারের কারণে মহানন্দা নদীর পানি হ্রাস ও অববাহিকা ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুই পক্ষ আলোচনা করে।

বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশন বলছে, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রায় ৪০৫টি নদী প্রবাহিত হচ্ছে এর মধ্যে ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী যার ৫৪টিই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন এবং বাকী তিনটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে।

১৯৭২ সালের মার্চে যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়েছিলো দু দেশের প্রধানমন্ত্রীদের এক যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হলেও অভিন্ন বাকী নদী গুলোর পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।

তবে গত কয়েক বছরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার মধ্যেই ২০১৯ সালে আলোচনায় আসে ছয়টি নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি।

ভারত বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের কারিগরি কমিটি তিন বছর পর গত ৫ জানুয়ারি যে বৈঠক করেছে তাতে অভিন্ন ৬টি নদীর পানি বণ্টনে একটি কাঠামো চুক্তি কীভাবে করা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে।

এই নদীগুলো হচ্ছে- মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার। এই ছয়টি নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ইতিমধ্যেই এসব নদীর ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালের তথ্য উপাত্ত নিজেদের মধ্যে বিনিময় করেছে দুই দেশ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন উভয় দেশের মধ্যকার পানি ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্য বিনিময় হয়ে গেলে পানি বণ্টন চুক্তির একটি কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তারা।

নদী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম বলছেন, বাংলাদেশের অন্য নদীগুলোর মতোই এসব নদীর অবস্থাও ভালো নয়। বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর পূর্ব দিকে আসা নদীগুলোতে বাধা পড়েছে অনেক বেশি। তবে পূর্ব জোনের নদীগুলো তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত। নদীগুলোর এখন বড় সমস্যা হলো বর্ষাকালে পানি উপচে বন্যা হয় আর শুষ্ক মৌসুমে পানিই থাকেনা। কারণ উপরের দিকে থাকা দেশে পানি আগেই প্রত্যাহার হয়ে যায়।

ইসলাম বলেন, অভিন্ন নদী হিসেবে এগুলোর পানি বণ্টন চুক্তি জরুরি কারণ নদীগুলোর ইকো সিস্টেমকে বাঁচিয়ে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীগুলোর নিজের বাঁচার জন্যই পানি দরকার। আবার কৃষির জন্য সেচের বা বৃষ্টি আর নদীর পানি ছাড়া আর বিকল্প নেই বাংলাদেশের। এসব নদীর মৎস্য সম্পদও হুমকির মুখে পড়েছে। ধরলার মতো নদীগুলো নিয়ে কাজ করেছি। তলানি ভরে গেছে এসব নদীর।

আলোচিত ছয় নদীর বর্তমান অবস্থা

ধরলা
ধরলা নদী বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এই নদীটি। তবে এটি বাংলাদেশে প্রবেশের পর পাটগ্রাম থানার কাছ দিয়ে আবার ভারতে প্রবেশ করে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে এবং এরপর আবার বাঁক নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

বাংলাদেশ অংশে ধরলার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে দীর্ঘ সড়ক সেতুটি এই নদীর উপর অবস্থিত যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৫০ মিটার। অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম বলছেন শুষ্ক মৌসুমে এ নদীতে পানি থাকে না বললেই চলে।

দুধকুমার
সরকারি তথ্য অনুযায়ী দুধকুমার বাংলাদেশের রংপুর জেলার একেবারে উত্তর-পূর্ব সীমান্তের নদী। এর উৎপত্তিস্থল তিব্বতের মনকোশ নদী, যা পরে ভুটানের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে নাম ধারণ করে হরিডাক।

এরপর এটি কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী থানায় সোনাইহাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের পর এর নামকরণ হয় দুধকুমার। পরে পাটেশ্বরীর কাছে গোদাধর ও গঙ্গাধর নামক দুটি উপনদী দুধকুমারের সাথে মিলিত হয়। এ দুটি নদীর প্রবাহ গ্রহণ করে দুধকুমার সর্পিল গতিতে চলতে থাকে। ৫১ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে নদীটি নুনখাওয়া নামক স্থানে ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়।

দুধকুমারের সাথে মিশে আছে আর একটি নদী-ফুলকুমার। বাংলাদেশের বন্যা মৌসুমে শুরুতেই যেসব নদীর পানি বিপদসীমার উপরে উঠে যায় এটি তার একটি।

মনু
মৌলভীবাজারের একটি নদী। মূলত এটি বাংলাদেশ ও ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তে আন্তঃসীমান্ত নদী। এ নদীর উৎপত্তিস্থল ত্রিপুরার একেবারে দক্ষিণের পাহাড়ি এলাকা। পরে কৈলাশহর এর পাশ দিয়ে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের দিক দিকে বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা দিয়ে নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে পরে ধলাই নদীতে মিশেছে।

এ নদীতেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিষ্কাশন ও সেচের জন্য প্রকল্প নিয়েছিলো বাংলাদেশ যা ৭৫-৭৬ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ৮২-৮৩ সালে। তবে ত্রিপুরায় বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ এ নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে চুক্তি করতে আগ্রহী।

স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলে মনু নদীর পানি বেড়ে বন্যার তৈরি হয় আবার উপচেপড়া পানিতে বর্ষায় দেখা দেয় ভাঙ্গনও। পলি পরে ভরাট হয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তারা।

খোয়াই

বাংলাদেশের হবিগঞ্জ সদর উপজেলাকে দুই ভাগে ভাগ করেছে খোয়াই নদী, যার উৎপত্তি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি এলাকায় ও দৈর্ঘ্য ৯০ কিলোমিটার। এটি চুনারুঘাট, সদর, বানিয়াচঙ এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিলেছে মেঘনায়-কুশিয়ারায়। এক সময় এ নদীই ছিল উপজেলার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। বর্তমানেও সীমিত আকারে এ নদীর মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্যস্থানে মালামাল পার করা হয়।

গোমতী
সরকারি তথ্য মতে, গোমতী নদীর উৎপত্তি স্থলও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। রাজ্যটির অমরপুর, উদয়পুর, সোনাইমুড়ী নামক স্থানের পাহাড়িয়া এলাকায়। এটি কুমিল্লা জেলার আদর্শ সদর উপজেলার কটকাবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বুড়িচং, ব্রাক্ষ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস ও দাউদকান্দি উপজেলা হয়ে মেঘনা নদীতে পতিত হয়েছে।

বাংলাদেশ অংশে নদীটির দৈর্ঘ্য ৮৩ কিলোমিটার। এক সময় নদীটিকে কুমিল্লার দুঃখ বলা হলেও বর্তমানে নদীর উভয় তীরে বাঁধ থাকার ফলে তা কৃষি ও সেচ কাজে সুফল বয়ে এনেছে। যদি নদীর উভয় তীরে রাস্তা পাকা করা হয় তবে এটির পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসাবে গড়ে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে । তবে পানি প্রবাহ কমে আসায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের নদী কমিশনের ২০১৮ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে শুকনো মৌসুমে গোমতীর পানি ব্যাপকভাবে কমে যায়। আবার পানি কমে আসার সুযোগে বাংলাদেশ অংশে অবৈধ দখল এবং বালু ও মাটি উত্তোলনের কারণে নদীটি মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে বলে মনে করেন অনেকে।

মুহুরী
এ নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুর রাজ্য। সেখানকার পাহাড়ী অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফেনীর পরশুরাম উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এ নদী। পরে ফেনী নদীর সাথে মিলে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। প্রতিবছরই মুহুরী ও আশেপাশের আরো কয়েকটি নদীর পানি সংকটের কারণে ওই এলাকা বোরো ধান চাষাবাদ নিয়ে সংকট তৈরি হয়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh