করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী

করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী: এক সপ্তাহে বেড়েছে ২৫০০ জন

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২১, ১১:৫৯ এএম | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২১, ০২:৩৭ পিএম

গরমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পর থেকে এখন কেবলই ঊর্ধ্বমুখী। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে আড়াই হাজারের বেশি। এই অবস্থায় মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন করে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা। 

তবে এক শ্রেণির মানুষের সামাজিক আচরণ আগের মতোই। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন না। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের এ ধরনের উদাসীনতা করোনা সংক্রমণ বাড়া ছাড়া কমাবে না। মানুষের উদাসীনতার কারণে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি করোনা সংক্রমণ যাতে না বাড়ে, সেজন্য সরকার ১১ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। দেশে দুইদিনের ব্যবধানে (১৪ ও ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি) নমুনা পরীক্ষার সাপেক্ষে করোনা শনাক্ত ৬.২৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯.৪৮ শতাংশে উঠে গেছে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতেও শনাক্তের হার নেমে যায় ৩ শতাংশের নিচে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনা শনাক্ত বেড়েছে দুই হাজার ৬১৯টি। এই সময়ের মধ্যে মৃত্যু বেড়েছে ২৫টি। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমতাবস্থায় সময় এসেছে আত্মতুষ্টিতে না ভোগে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার। তাহলে করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে, সেজন্য সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও সহযোগিতা লাগবে। 

ভাইরাসের ইউকে ধরনটি বাংলাদেশে জানুয়ারি থেকেই

করোনাভাইরাসের ইউকে ধরনটি (ভেরিয়েন্ট) সেই জানুয়ারি থেকেই বাংলাদেশে এসেছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) চলতি বছরের জানুয়ারি থেকেই পাঁচজনের দেহে ইউকে ভেরিয়েন্টটি পেয়েছে বলে জানিয়েছে। কিন্তু তথ্যটি জানানো হয়নি এতদিন। করোনাভাইরাসের ইউকে ভেরিয়েন্টটি খুব দ্রুত ছড়ানোর ক্ষমতা রাখে। 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ছাড়া এই ভেরিয়েন্টটি অবশ্য খুব বেশি বিপজ্জনক নয়। চলতি মাসের গোড়ার দিকে ইউকে ভেরিয়েন্টটি বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে, তা প্রকাশের আগেই ভাইরোলজিস্টরা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। এই ভেরিয়েন্টটি বাংলাদেশে এসে থাকতে পারে। তারা তখন যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, যেহেতু ব্রিটেনে থাকা বহু প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে এসেছেন। তাদের টেস্টিং বা কোয়ারেন্টিন ঠিকমতো হয়নি। তাদের মাধ্যমে নতুন ভেরিয়েন্ট এসে থাকলে সংক্রমণ বাড়তে থাকবে। করোনারভাইরাসের জিন সিকোয়েন্সিং করে উদ্ভূত ফলাফল দেশবাসীকে জানানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন ভাইরোলজিস্টরা। 

গরমকালেই সংক্রমণ আরো বাড়ার আশঙ্কা

বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা শীতকালে নয় বরং গরমকালেই বেশি থাকে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম। করোনাভাইরাস ও ইনফ্লুয়েঞ্জার বৈশিষ্ট যেহেতু একই রকম, তাই এবারের গরমে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।

এক্ষেত্রে আইইডিসিআরের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, গরমকালে অনেকেই বাসায় বা কর্মস্থলে এসি ব্যবহার করেন, ছোট ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করেন। ছোট ও আবদ্ধ ঘরে একই রকম বাতাস বারবার সঞ্চালিত হয় বলে ওই ঘরে কেউ করোনাভাইরাস পজিটিভ থাকলে তার নিঃশ্বাস থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস অন্যদের সংক্রমণ করবেই।

টিকা দেয়া হলেও নিরাপদ ভাবার সময় আসেনি

জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ কমে যায় বাংলাদেশে। বিশেষ করে দেশব্যাপী কভিড-১৯ এর টিকা দেয়া শুরু হওয়ায় মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি দেখা দিয়েছিল। সে কারণে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখা দেয়। 

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা জানান, মানুষ এবার ছুটির দিনগুলোয় বিভিন্ন পর্যটন স্থানে ভিড় করেছে, সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশে যেতে শুরু করেছেন। সেখানে সামাজিক দূরত্ব দূরের কথা, অনেকে মাস্কও ব্যবহার করছেন না। এসব কারণে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। 

তিনি আরো জানান, করোনাভাইরাসের টিকা এলেও দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে দুই ডোজ টিকা না দেয়া পর্যন্ত ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকতেই পারে। বাংলাদেশে এখনো কাউকেই দুই ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়নি। এক ডোজ টিকা করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে নিশ্চয়তা দেয় না যে, সংক্রমণ থেকে টিকা গ্রহণকারী সম্পূর্ণ নিরাপদ। দুই ডোজ টিকা দেয়ার ১৪ দিন পর শরীরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে দুই ডোজ টিকা না দেয়া পর্যন্ত সবাইকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। 

নতুন ভেরিয়েন্ট দ্রুত বিস্তার লাভ করলেও পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে 

অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সের (এআইআইএমএস) পরিচলক রণদীপ গুলেরিয়া ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভারতে করোনার নতুন ধরনটি (নিউ ভেরিয়েন্ট) ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে। করোনার নতুন ভেরিয়েন্টটি দ্রুত পুনঃসংক্রমণ ঘটাতে পারে। ভারতের কেরালা, মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড় ও পাঞ্জাবে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। পাঞ্জাবে শুধু সংক্রমণ নয় মৃত্যুও বাড়ছে। ভারতের প্রদেশগুলোতে নতুন ভেরিয়েন্টটি প্রভাব বিস্তার করে থাকতে পারে। তা সত্ত্বেও মূলত ভৌগোলিক কারণে এশিয়ার দেশগুলোতে মানবদেহে নতুন ইউকে ভেরিয়েন্টটি খুব প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। 

ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারতীয় উপমহাদেশের বাসিন্দাদের শরীরে ‘আলফা-ওয়ান অ্যান্টি ট্রিপসিন’ নামে একটি প্রোটিন রয়েছে। এই প্রোটিন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে দারোয়ান হিসেবে (গেট কিপার) কাজ করছে। অর্থাৎ এই প্রোটিন ভাইরাসকে মানুষের ফুসফুসে প্রবেশে বাধা দিয়ে থাকে। সে কারণে ইউরোপ অথবা আমেরিকায় করোনা বিপজ্জনক মাত্রায় দেখা দিলেও, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে তেমন কাবু করতে পারেনি। 

তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু নতুন ভেরিয়েন্টটি বিপজ্জনক মাত্রায় ছড়িয়ে থাকে, সে কারণে বাংলাদেশের আরো সাবধান হওয়া উচিত- যেন ভারত থেকে নতুন ভেরিয়েন্টটি বাংলাদেশে চলে আসতে না পারে। শুধু ভারত নয় বিট্রেনের ভেরিয়েন্টটিও থামানোর সব ধরনের চেষ্টা করতে হবে। 

গবেষণায় দেখা গেছে, ইউকে ভেরিয়েন্টটি প্রথমে মানবদেহে স্পাইক প্রোটিনের সাথে মিশে কোষে প্রবেশ করে। গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, নতুন ভেরিয়েন্টটি একটি পথ দিয়ে কোষে আঘাত করে; কিন্তু এই পথ খোলার জন্য মানবদেহে ‘নিউট্রোফিল ইলাস্টেজ’ নামক একটি প্রোটিন প্রয়োজন হয়। ‘নিউট্রোফিল ইলাস্টেজ’ যাদের ফুসফুসে বেশি থাকে তাদের কোষে প্রবেশের পথটি সহজে খুলে যায় ও করোনাভাইরাস আক্রমণ করে। 

গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতসহ এশিয়ার দেশগুলোর মানুষের দেহে ‘আলফা-ওয়ান অ্যান্টি ট্রিপসিন’ প্রোটিন অধিক মাত্রায় থাকে। যার কাজ হচ্ছে নিউট্রোফিল ইলাস্টেজের উৎপাদনকে বাধা দেয়া ও নিয়ন্ত্রণ করা। তাই এই প্রোটিন করোনাভাইরাসকে প্রতিহত করে। ফলে যাদের দেহে এই প্রোটিন বেশি থাকে, তারা করোনা থেকে বেঁচে যান।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh