ভারতকে নিজ ছায়াতলে টানছে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২১, ০৮:৪৭ এএম

সারাবিশ্বে যখন করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের উৎপাদন ও প্রাপ্যতা নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন শক্তিশালী দেশগুলো ভ্যাকসিনকে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে দেখছে। 

পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকাতে যখন পশ্চিমা দেশগুলো ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন চীন ও রাশিয়া এই সুযোগে প্রভাব বাড়িয়ে নিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেক পশ্চিমা চিন্তাবিদরা। 

তবে ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার এক লেখায় বলা হয়, ঠান্ডা যুদ্ধের মতোই রাশিয়া ও চীনের ভীতিকে জিইয়ে রেখে পশ্চিমারা শক্তিশালী জবাব দিতে চাইছে। নিজেদের মেডিকেল গর্বকে ধরে রাখতে পশ্চিমা দেশগুলোকে দ্রুত কাজ করতে হবে। 

তবে একইসাথে বলা হচ্ছে, ব্রিটেনের উচিত তাদের ভ্যাকসিনের সফলতাকে ভূরাজনৈতিক সফলতায় রূপান্তরিত করা। উদাহরণস্বরূপ- ভারতের সাথে ব্রিটেনের একটা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি দুই দেশের বাণিজ্যকে ১৪০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে পারে, যা বর্তমানে ৩২ বিলিয়ন ডলারের মতো। 

ব্রিটেনের প্রভাবশালী স্পেকট্যাটর ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হয়, ঠান্ডা যুদ্ধ যখন তুঙ্গে ছিল, তখন বিশ্বের প্রায় শ’খানেক উন্নয়নশীল রাষ্ট্র জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে নাম লেখায়; তারা যুক্তরাষ্ট্র বা সোভিয়েত ইউনিয়ন, কারও পক্ষেই যাওয়ার পক্ষপাতী ছিল না। তখন উভয় সুপারপাওয়ারই চেষ্টা করেছে এই দেশগুলোকে নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসতে; বর্তমানেও সেটিই হচ্ছে। ঠান্ডা যুদ্ধের পর ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীন-রাশিয়াও চাইছে মাঝামাঝি থাকা এই দেশগুলোকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে আসে। তাদের ভ্যাকসিন কূটনীতি এরই অংশ। 

অপরদিকে ব্রিটেন আন্তর্জাতিকভাবে ভ্যাকসিনের প্রসার ঘটাতে ভারতকে ব্যবহার করছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেনের অক্সফোর্ডের ডেভেলপ করা ভ্যাকসিনই তৈরি করছে। ব্রিটেন যখন নিজের তৈরি ভ্যাকসিন দিয়ে নিজ জনগণকে রক্ষা করছে, তখন ব্রিটিশ ‘আশীর্বাদে’ ভারত দুনিয়াব্যাপী ভ্যাকসিন ছড়িয়ে দিচ্ছে। তবে আসন্ন ‘ডি-১০’ শীর্ষ বৈঠকে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে, পশ্চিমাদের বন্ধুত্ব চীনের বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি দামি। 

‘ডি-১০’ হলো অর্থনৈতিকভাবে উন্নত সাত দেশ ‘জি-৭’-এর একটা সম্প্রসারণ। ‘জি-৭’-এর দেশগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, কানাডা ও জাপান। এর সাথে ‘ডি-১০’-এর অধীনে যুক্ত করা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতকে। ব্রিটেন চাইছে ২০২১ সালে ‘জি-৭’ শীর্ষ বৈঠককে ‘ডি-১০’ বৈঠকে রূপান্তরিত করতে। অনেকেই বলা শুরু করেছেন যে, ‘জি-৭’ একটি পুরনো চিন্তা, তাই এটিকে ‘ডি-১০’এর মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করা উচিত। 

ওয়াশিংটন পোস্টের এক লেখায় বলা হয়, ‘ডি-১০’-এর চিন্তাটা নতুন নয়। ২০০৮ সালে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক আটলান্টিক কাউন্সিলের এশ জেন ও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রাক্তন পলিসি প্ল্যানিং ডিরেক্টর ডেভিড গর্ডন ‘ডি-১০’-এর বিষয়ে বলেন, এখন এমন একটি সময় এসেছে, যখন পশ্চিমা লিবারাল আদর্শের দেশগুলো নিজেদের নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারছে না। তাই এই দেশগুলোর উচিত একত্রে বসে কৌশল নির্ধারণ করা।  

ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের এক লেখায় মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ফেলো এরিক ব্র্যাটেনবার্গ ও ব্রিটিশ সাংবাদিক বেন জুডাহ বলেন, এখন সময় এসেছে ‘জি-৭’কে পেছনে ফেলে ‘ডি-১০’কে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। তারা বলছেন যে, ‘ডি-১০’ কোনো চীনবিরোধী সংস্থা নয়। বরং এটি হলো পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতি হুমকিস্বরূপ দুটি বিশেষ সমস্যাকে সমাধানের একটা উপায়। 

এর মাঝে একটা হলো ‘ফাইভ জি’ বা পঞ্চম জেনারেশনের প্রযুক্তি; আরেকটি হলো অতি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের সাপ্লাই চেইন। এই উভয় সমস্যাই পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কেউ একা সমাধান করতে পারবে না। অপরপক্ষে ‘ডি-১০’-এর মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো সমাধানে বেশ দ্রুত কাজ করা সম্ভব। এর মাধ্যমে ট্রান্স আটলান্টিক ও ট্রান্স প্যাসিফিকের গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে একটা কাঠামোর মাঝে এনে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে কেন্দ্র করে দ্রুত কর্মমুখী একটি সমাধানে দিকে এগোনোর মাধ্যমে একাধারে যেমন সংস্থাটিকে একটি আলোচনা সভা বানিয়ে ফেলা থেকে বাঁচা যাবে, তেমনি চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র ব্যবস্থা নেয়াকেও কঠিন করে ফেলা যাবে। 

তারা বলছেন, গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মাঝে সেতু তৈরি করার ক্ষেত্রে ব্রিটেনের গুরুত্ব যথেষ্ট। তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ১৯৪৯ সালে ন্যাটো তৈরির সময় ব্রিটিশ সামরিক অফিসার হেস্টিংস ইসমে বলেছিলেন, ন্যাটোর দরকার রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাইরে রাখতে, যুক্তরাষ্ট্রকে ভেতরে রাখতে ও জার্মানিকে দমিয়ে রাখতে। তেমনি ব্র্যাটেনবার্গ ও জুডাহ বলছেন যে, ‘ডি-১০’-এর দরকার রয়েছে চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে, ভারতকে কাছে রাখতে ও যুক্তরাষ্ট্রকে দৃঢ় রাখতে। তাদের কথায়, ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাটি এখনো একটি কঙ্কাল; লন্ডনের জন্যে ‘ডি-১০’ হলো এই কঙ্কালের ওপর পেশি যুক্ত করার একটা সোনালি সুযোগ। 

চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিনের ‘ভীতি’কে ব্যবহার করেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চাইছে। ঔপনিবেশিক সময় থেকেই ভারত ও চীনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ব্রিটেনের কাছে কখনোই কমেনি। এ কারণেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চীন ও ভারত উভয়কেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে। বিশেষ করে ব্রেক্সিটের পর ভারত ও চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে ব্রিটেন। ‘ফাইভ জি’ প্রযুক্তি ও সাপ্লাই চেইনকে আলোচনায় এনে ব্রিটেন চীনের বিকল্প তৈরি নয়; বরং চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। 

অপরদিকে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন উৎপাদনে ভারতকে অংশীদার করে ও ‘ডি-১০’ গঠনের মাধ্যমে ভারতকে একটি বড় আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের অংশ করে নিয়ে ব্রিটেন ভারতকে আবারো নিজের ছায়াতলে আনতে চাইছে। একইসাথে ব্রিটেন চাইছে চীনকে নিয়ন্ত্রণের খেলায় যুক্তরাষ্ট্র যেন একচ্ছত্রভাবে সিদ্ধান্ত না নিতে পারে। ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ব্রিটেনের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হলেও ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার বাস্তবায়ন অন্বেষণ করা থেকে তারা যে এক চুলও নড়েনি, তা পরিষ্কার।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh