মহিয়সী নারী আয়েশা ফয়েজ স্মরণে

খালিদ ইফতেখার

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২১, ০৮:৫৯ এএম | আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২১, ০৯:০১ এএম

১৯৭৩ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশ। 

‘‘দীর্ঘ সময় পর মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে দেখা হলো। আমাদের দেখে একেবারে ক্ষেপে গেলেন মহোদয়। পেয়েছেন কি আপনারা? প্রত্যেক দিন সকালে এসে বসে থাকেন? সকালে ঘুম থেকে উঠেই আর কত বিধবার মুখ দেখব!!!

-আমি লজ্জায় মরে গেলাম।’’

(আয়েশা ফয়েজ/জীবন যে রকম/১৯৭৩)

১.

তার জন্ম ১৯৩০ সালের ২৩ মার্চ, মোহনগঞ্জে। তার বাবার নাম শেখ আবুল হোসেন ‍আর মা খায়রুন নেসা। তার খুব শখ ছিল তার পড়াশোনা করার, ক্লাস টুতে বৃত্তিও পেয়েছিলেন। সেই সময় পড়াশোনার চল ছিল না বলে তা হয়ে ওঠেনি। 

১৯৪৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন ফয়েজুর রহমানের সাথে। বিয়ের পর লেখক স্বামীর উৎসাহে বেগম ও ডিটকেটিভ পত্রিকায় কিছু গল্প লিখেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বামীকে হারান। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর মৃত্যুর পর শুরু হয় তার ভয়াবহ জীবন। কঠিন সংগ্রামে তার ছয় ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন। তার ছেলেমেয়েরা তাঁর জীবদ্দশায় বলতেন, ‘মা না থাকলে আমরা ভেসে যেতাম!’ 

বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকদিন ধরেই তিনি কিডনিসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউতে রাখা হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখের সকালে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। তিনি এখন  শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তার মা খায়রুন নেসার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

তার সন্তানেরা হলেন কিংবদন্তিতুল্য কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ, অধ্যাপক সুফিয়া হায়দার, অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মমতাজ শহীদ, রোখসানা আহমেদ ও কার্টুনিস্ট-রম্যলেখক আহসান হাবীব।

২.

আয়েশা ফয়েজের লেখা ‘জীবন যে রকম’ বইটি পড়লে জানা যায় তার জীবন সংগ্রামের নানা কথা। আত্মজীবনীর শুরুতেই লিখেছেন ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে একজন বেকার ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়েছিলো। যার নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজুর রহমান। তারপর ফয়েজুর রহমানের বদলির চাকরির কারণে আয়েশা ফয়েজ ঘুরেছেন সিলেট, পঞ্চগড়, রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, বগুড়া, কুমিল্লা ও অবশেষে পিরোজপুর। 

১২ নভেম্বর ১৯৭০ সাল থেকে উঠে এসেছে সে সময়ের রাজনীতির বিখ্যাত পুরুষদের কথা। এভাবেই শেখ মুজিব, ভাসানী, ইয়াহিয়াসহ অনেকের কথা তিনি বইটিতে উল্লেখ করেছেন। গ্রামের চলমান কুসংস্কার নিয়ে সে সময়ের অনেক কথা তুলে ধরেছেন। তারপর তিনি প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি ব্যক্ত করলেন। তখনকার সময়ে গর্ভবতী মায়েদের ভিটামিন খাওয়ানো নিষেধ ছিলো। মুরব্বিরা এটা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। 

প্রথম যে সন্তান তার কোল আলোকিত করলেন সেই শিশুটি জন্ম নিলো তার নাম রাখা হলো কাজল। পরবর্তীকালে সেই কাজল হলেন নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ। সেই ছোট্ট কাজলের নাম দাদা-দাদি রেখেছিলেন শামসুর রহমান। কিন্তু নামটি কাজলের বাবা ফয়েজুর রহমানের পছন্দ হয়নি। তিনি নাম বদলে রাখলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেই শিশুটি যার জন্য মায়ের বেশি আদর, স্নেহ, মমতার অভাব ছিলো না। 

৩.

‘জীবন যে রকম’ বইটির কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরছি:

‘বাবর রোডের বাসায় ওঠার তিনদিন পর হঠাৎ একদিন রক্ষীবাহিনী এসে হাজির হলো। একজন সুবেদার মেজর জিজ্ঞাসা করলো, এ বাড়ি আপনি কোথা থেকে পেলেন?

আমি বললাম সরকার আমাকে দিয়েছে। আমার স্বামী যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাই।

সুবেদার মেজর কিছু না বলে চলে গেল। আমার মনের ভেতর হঠাৎ করে একটা খটকা লেগে গেল। হঠাৎ করে রক্ষীবাহিনী আসছে কেন? ক্ষাণিকক্ষণ পর আরেকজন সুবেদার মেজর এসে হাজির। সে একা নয়, তার সাথে বোঝাই এক ট্রাক রক্ষীবাহিনী। সবার হাতে অস্ত্র। সুবেদার মেজরের নাম হাফিজ। ভেতরে ঢুকে বলল, এই বাড়ি আমার। শেখ সাহেব আমাকে দিয়েছেন। আমি বললাম, সে কি করে হয়? আমার সাথে বাসার অ্যালটমেন্ট রয়েছে।

সে কোনো কথা না বলে টান দিয়ে ঘরের একটা পর্দা ছিঁড়ে ফেলল। সাথে আসা রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বলল ছেলেমেয়েদের ঘাড় ধরে বের কর। আমি এত দিনে পোড় খাওয়া পাথর হয়ে গেছি। রুখে দাঁড়িয়ে বলেছি, দেখি তোমার কত সাহস?

সুবেদার মেজর একটু থমকে গিয়ে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। দেখতে দেখতে পুরো এলাকা রক্ষীবাহিনী দিয়ে বোঝাই হয়ে গেল। বাসা চারদিকে ঘেরাও হয়ে আছে। কাউকে বাসায় ঢুকতেও দেয় না, বের হতেও দেয় না। কাজল (হুমায়ূন আহমেদ) মহসিন হলে ছিল। খবর পেয়ে এসেছে। তাকেও ঢুকতে দিল না। সারারাত এভাবে কেটেছে। ভোর হতেই আমি বের হলাম। পুলিশের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলাম। পুলিশ বলল- আমরা গোলামির পোশাক পরে বসে আছি। রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা কি করব? বঙ্গভবন, গণভবন এমন কোনো জায়গা আমি বাকি রাখলাম না সাহায্যের জন্য। কিন্তু লাভ হলো না। আমি তুচ্ছ মানুষ। আমার জন্য কার মাথাব্যথা?

রাতে ফিরে এসেছি। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। অনেক বলে ভেতরে ঢুকেছি। রাত আটটার দিকে রক্ষীবাহিনীর দল লাথি মেরে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল। ইকবাল (ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল) আমাকে আড়াল করে দাঁড়াল। একজন বেয়োনেট উঁচিয়ে লাফিয়ে এলো। রাইফেল তুলে ট্রিগারে হাত দিয়েছে। চিত্কার করে কিছু একটা বলছে। গুলি করে মেরে ফেলবে আমাদের? আমি ছেলেমেয়েদের হাত ধরে বের হয়ে এলাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাকে প্রথমবার গৃহহারা করেছিল। বাংলাদেশ সরকারের রক্ষীবাহিনী আমাকে দ্বিতীয়বার গৃহহারা করল।’

৪.

আয়েশা ফয়েজ আরো লিখেছেন:

‘পেনশনের টাকা তোলার জন্য কাগজপত্র নিয়ে আবার গেলাম। কাজলের আব্বার পরিচিত একজন এআইজি তার অধস্তন অফিসারকে ডেকে আমার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। অফিসার বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। সব ঠিক করে দেব।

তার সঙ্গে অফিসে গিয়েছি। সে রাগে ফেটে পড়ল। মুখ খিঁচিয়ে বলল, আপনার বেশি ক্ষমতা হয়েছে না? ভাবেন ওপরওয়ালা বললেই সব হয়ে যাবে? মনে রাখবেন টাকা অত সহজে পাওয়া যায় না। টাকা যদি চান এখানে এসে খরচপাতি করবেন।

ভদ্রলোক গজগজ করতে করতে তার এক সহকর্মীকে বললেন, এই একটা নতুন দল বের হয়েছে। শহীদ পরিবার। যেখানেই যাই সেখানেই শহীদ পরিবার। জ্বালিয়ে খাচ্ছে ওরা। এইভাবে শহীদ পরিবার হিসেবে আমার এক নতুন জীবন শুরু হলো। শহীদ পরিবারের প্রথম কাজ হচ্ছে ঘোরাঘুরি করা। আমার ঘোরাঘুরি শুরু হলো। এক অফিস থেকে আরেক অফিস। এক অফিসার থেকে আরেক অফিসার। এভাবে আস্তে আস্তে ঘোরাঘুরিতে অভিজ্ঞ হয়ে গেলাম।

ঢাকায় থাকার জায়গার খুব সমস্যা। শহীদ পরিবারকে বাড়ি দেয়া হয়েছে শুনে তার জন্য ঘোরাঘুরি শুরু করেছি। একদিন খোঁজখবর নিয়ে বাড়ি সংক্রান্ত একজন মন্ত্রী, নাম মতিউর রহমান, তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার মতো আরও অনেকে আছেন। দীর্ঘ সময় পর মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে দেখা হলো। আমাদের দেখে একেবারে ক্ষেপে গেলেন মহোদয়। পেয়েছেন কি আপনারা? প্রত্যেক দিন সকালে এসে বসে থাকেন? সকালে ঘুম থেকে উঠেই আর কত বিধবার মুখ দেখব?

আমি লজ্জায় মরে গেলাম।’

৫.

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ২০১২ সালের ১৯ জুলাই চলে যান না ফেরার দেশে। মৃত ব্যক্তির শোক সবাই কাটিয়ে উঠতে পারে একটা সময়; কেবল মায়ের শোক থাকে আজীবন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি ছেলে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলেন, তার পাগলামি তো ভালো ছিলো। সুন্দর ছিলো। সে তো কখনো তার পাগলামি দিয়ে কারো কোন ক্ষতি করেনি। ফলে এটা নিয়ে আমি এত চিন্তিত ছিলাম না।

আয়েশা ফয়েজকে সম্মান জানিয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাম্রলিপি আয়েশা ফয়েজ সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করেছে।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অমর শহীদ জায়া-রত্নগর্ভা আয়েশা আয়েশা ফয়েজের ৯১তম জন্মদিনে তাকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh