উত্তাল মার্চ, বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা

স্বপন দেব

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২১, ১১:৩৪ এএম

১৯৭১, বাঙালি জাতির  ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেই অধ্যায়ের সঠিক ইতিহাস এখনো জাতির সামনে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে লেখা হয়নি। সেক্ষেত্রে আমাদের ইতিহাস লিখিয়েদের সেই সাহস ও জ্ঞানের অভাব ছিল বলে মনে করা যায়। 

একটি জাতিকে দাঁড়াতে হয় তার নিজের মাটিতে নিজের পায়ের ওপর; কিন্তু পা তো এমনি চলে না তাকে মাথা দিয়ে চালাতে হয়। আমি মনে করি, মস্তিষ্ক দিয়ে যা দেখা, তাই-ই দেখা। আমি চেষ্টা করেছি সেই গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে নতুন করে ইতিহাসকে দেখতে। সেভাবে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেছি।

এতদিন এটি গোপন ছিল যে, ১৯৭০ সালের  নির্বাচনে ঝুলন্ত সংসদ হবে পাকিস্তানে, যা গোয়েন্দা প্রতিবেদনে চিত্রিত ছিল; কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সে পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। আওয়ামী লীগ একক মেজরিটি দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সুতরাং চক্রান্তের সৃষ্টি হয়ে গেল ভুট্টোর বাড়িতে, যা এম এম আহমেদ পরিকল্পনা নামে পরিচিত। চক্রান্তটি এরকম যে, আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না, সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আর ভারতকে দমিয়ে রাখা হবে আমেরিকা ও চীনের মাধ্যমে। মুজিবকে বিচারের নামে  হত্যা করা হবে। অর্থাৎ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না। 

সুতরাং মার্চের আলোচনাগুলো ছিল লোক দেখানো। মার্চ মাসে Operation Search light-এর চূড়ান্ত প্রস্তুতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দেখতে তারা সবাই ঢাকায় এসেছিলেন। আলোচনা ছিল ছল। খেয়াল রাখতে হবে দুটি বিষয়ের দিকে। যেমন-

এক. পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একক মেজরিটি পাবে ৭০ সালের নির্বাচনে।

দুই.  ভারতে একক মেজরিটি পাবে কংগ্রেস আর ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবেন।

এই দুটি কাজ সম্পাদনে বাইরের কোনো একটি শক্তি কলকাঠি নেড়েছে কিনা তা এখন গবেষণার বিষয় । কারণ, এই দুটি ঘটনা না ঘটলে বাংলাদেশ  স্বাধীন হবে না। ‘র’-এর  আওয়ামী লীগের সাথে পুরনো যোগাযোগ এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়।

১ মার্চ : ইয়াহিয়া খান বিনা কারণে বেতার ও টেলিভিশন ভাষণ হঠাৎ বাতিল করে দিলেন।

২ মার্চ : নির্বাচনে জেতার আগেই ইন্দিরা গান্ধী পি এন হাকসার, আর এন কাউ, টি এন কাউল এবং ডি পি ধরকে নিয়ে বাংলাদেশ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে দিলেন। এর মানে সাংঘাতিক! ভারত বাংলাদেশ বিষয়ে আগাম  প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল বলা যেতে পারে।

৭ মার্চ : বঙ্গন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ। যাকে স্বাধীনতার কাব্য বলা হয়ে থাকে।

৮ মার্চ : বঙ্গবন্ধু গোপনে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতের সহায়তা চাইলেন। ইন্দিরা গোপনে জানালেন Doctor's will take care your health and Awami League! ভারত সাহায্যের জন্য প্রস্তুত এভাবে তা জানিয়ে দেয়া হলো। অর্থাৎ পূর্ব যোগাযোগের ইঙ্গিত স্পষ্ট!

১০ মার্চ : পরিস্থিতি উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ছিলেন।

১২ মার্চ : লাহোরে এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তান পাঁচ বছরও টিকবে না।

১০ থেকে ১৩ মার্চ : পিআইএ তাদের সব বিমান পাবলিক পরিবহন বন্ধ করে শ্রীলঙ্কা ঘুরে সৈন্য পরিবহন শুরু করে।

১৪ মার্চ : বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। বলা যায় মাইলফলক! এ দিন  ভারতে বিপুল মেজরিটি নিয়ে ইন্দিরা ক্ষমতায় আাসেন। কংগ্রেস ৩৫২ আসনে বিজয়ী হয়। চমৎকার মেলবন্ধন। একদিকে আওয়ামী লীগ অন্য দিকে কংগ্রেস! পঞ্চম লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরার এই বিজয় বাংলাদেশের জন্য খুব  প্রয়োজন ছিল।

১৫ মার্চ : পঁয়ত্রিশটি বিষয় উল্লেখ করে সামরিক আইন জারি করা হয়।

১৬ মার্চ : বঙ্গবন্ধু গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করতে গেলেন। ভুট্টো হুমকি দিয়ে বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ দেশ শাসনের অধিকার রাখে। এ দিকে দিল্লির সাউথ ব্লক পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখতে শুরু করে। ঘনঘন আলোচনা চলছিল সাউথ ব্লকে।

১৭ মার্চ : বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালিত হয়নি।

১৮ মার্চ : ইয়াহিয়ার Drobe Bodzi প্রস্তাব আওয়ামী লীগ নাকচ করে দেয়।

১৯ মার্চ : জয়দেবপুরে পাকিস্তানি জান্তা জনতার ওপর গুলি চালায়। বেশ হতাহত হয়। বঙ্গবন্ধু তীব্র প্রতিবাদ জানান। পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে। আলোচনা ভেস্তে যায়।

২০ মার্চ : উভয় পক্ষের উপদেষ্টাদের মধ্যে দুই ঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া সে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। এম এম আহমেদ উদ্দেশ্যমূলকভাবে সে আলোচনা নস্যাৎ করে দেন।

২১ মার্চ : উত্তেজিত জনতা ভুট্টোর দলবলকে ধিক্কার জানায়।

২২ মার্চ : পুনরায় ইয়াহিয়া সংসদ অধিবেশন বাতিল করে দেন। আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে চলে যায়। 

২৩ মার্চ : পাকিস্তানের জাতীয় দিবস। একমাত্র সেনা ছাউনি ছাড়া কোথাও জাতীয় পতাকা ওড়েনি।

২৪ মার্চ : পুনরায় ইয়াহিয়া আলোচনায় বসেন; কিন্তু ফলাফল শূন্য। গুজব ছড়ানো হয় ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ তারিখে ক্ষমতা ছেড়ে দিচ্ছেন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh