আগুন জ্বলা মার্চে

হেনা সুলতানা

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২১, ০৩:১১ পিএম | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২১, ০৩:১৭ পিএম

আরো একটি ২৬ শে মার্চ আমাদের দাঁড় করিয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে। হাঁটি হাঁটি পা করে আমাদের স্বাধীনতার বয়স হলো ৫০ বছর। আগুন ঝরা মাস- মার্চ মাস। স্বাধীনতার মাস। বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বাঁচার সাহস এবং স্পর্ধা আমরা অর্জন করি ১৯৭১ সালের এই মার্চ মাসেই। এই সময় থেকেই তো- স্বাধীনতার নেশা যাদের রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে প্রবাহিত, তাদের কোনোভাবেই যে দমিয়ে রাখা যায় না। তাই প্রমাণ করেছিলো এদেশের মুক্তি পাগল বীর জনতা। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে রক্তক্ষয়ী এক মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা পেলাম লাল সবুজের একটি আশ্চর্য সুন্দর পতাকা। এ পতাকার পিছনে রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল  ইতিহাস। স্বাধীনতা অর্জন যেমন কঠিন, তার চেয়েও কঠিন তার সার্বিক মর্যাদা সমুন্নত রাখা।

আমরা ইতিহাস থেকেই জানতে পারি ১৯৪৭ এ ভারত উপমহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একমাসের মধ্যেই ঢাকায় এক সম্মেলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। সেটি ছিলো এদেশে তরুণদের প্রথম অসাম্প্রদায়িক সংগঠন। অনেক সম্ভাবনা নিয়ে তারা পথ চলা শুরু করেছিলো। পূর্ণ উদ্যম থাকা সত্বেও তারা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি নানা কারণে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে ব্রাত্য বলে নাকচ ঘোষণার সাথে সাথে তারা ফুঁসে উঠেছিলো মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করা ও তাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তারা পালন করেছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। সেই সংগঠনের কেন্দ্রে ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাথী হিসেবে পেয়েছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান, তদানীন্তন ছাত্রনেতা শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার, উত্তরকালের ‘সংবাদ’ সম্পাদক অহমেদুল কবির প্রমুখ। 

এরপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ষাটের দশকের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ব্যাপকতা তার কাছাকাছি সময়ে কয়েকটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্মেলন, সামরিক শাসন হটিয়ে ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের মধ্যেই ঘোষণা উচ্চারণ করেছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, ‘জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ।’ সেদিন ছিলো ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সাল। ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত পেরিয়েছে সেই ক্ষণে আবার ঘোষণা এলো ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ অতঃপর প্রতিরোধ যুদ্ধ- মুক্তিযুদ্ধ। পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেব জন্ম লাভ করলো। এভাবেই দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৪৭ সালের একদল স্বপ্নতাড়িত ছাত্রের স্বপ্ন সফল হয়েছিলো। 

স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রের পথ চলায় আজ সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি আমরা। এর মধ্যে আমরা পেরিয়েছি অনেক চড়াই উতরাই, আমাদের উদ্বেলিত করেছে বহু সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা। ব্যথিত করেছে সীমাবদ্ধতা, সংকীর্ণতা ও সংকট। কিন্তু তাতে কী সত্যিকার চেতনায় কোনো পরিবর্তন এসেছে আমাদের? এ প্রশ্ন তীরের মতো বুকে এসে বেধে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশ লাল সবুজের আলোয় ঝলমল করছে সেই আলোতেই যখন দেখতে পাই সুনামগঞ্জের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গ্রামে হামলার সংবাদ তখন বড় কষ্ট হয়।

এই উপমহাদেশের ইতিহাসকে কেউ কেউ বলেন স্বপ্নভাঙ্গার ইতিহাস। শুরু থেকেই ছিলো দোদুল্যমান। এই জনগোষ্ঠী ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে না কি জাতীয় পরিচয়ের মধ্যে নিজেদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান করবে, কোন স্বপ্নটিকে তারা খুঁজে নেবে? ঠিক এরকম একটি সময়ে হাজার বছরের বাঙালি সত্তা প্রতিবাদী হয়ে উঠলো তাদের মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে। দেখা গেল খুব স্বাভাবিক ভাবেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ব্যাপকতার অভিঘাতে এ দেশের মানুষ ধর্মীয় পরিচয় থেকে সরে আসতে শুরু করে এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালির মাঝে নিজের আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ব্রতী হলেও পুরোপুরি মনোজগৎ তৈরি করা সম্ভব হয়নি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। .... সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই’ এই আদর্শে। বরং কিছু মৌলবাদী নির্দেশনায় দ্বৈততাই কাজ করেছে। এই মনোভঙ্গী তাদের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যসমুহের জন্ম দিয়েছে তা অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি থেকে রক্তারক্তি কাণ্ডে গড়িয়েছে, গড়াচ্ছে। জন্ম দিয়েছে একে অন্যের প্রতি অবিশ্বাসের। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্র ক্ষণে সুনামগঞ্জের ঘটনা কী আমাদের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায় না? ৫০ বছরে এখনো আমরা পরিণত হতে পারিনি। এখনো তাই প্রত্যাশা করে যাই গণতন্ত্র ও জনগণের বাঁচার সুস্থির পরিবেশের সন্ধান। কবে হবে ধর্মীয় ও ভাষাভিত্তিক পরিচয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন?

বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু প্রতিশব্দের মতো। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু কী এই রকম দেশ চেয়েছিলেন?

প্রাণঘাতী করোনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও চরম দুর্নীতিতে দেশ যখন  জর্জরিত, বানভাসি সর্বস্বান্ত মানুষের মানবেতর জীবন যাপন অসহনীয় ঠিক এরকম সময়ে বঙ্গবন্ধুর অভাব বোধ করি। ১৯৭১ সালে আমাদের সমষ্টিগত সংগ্রামের ফলে শুরুতে যুদ্ধ কালে মূলনীতি ছিলো তিনটি। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। জাতীয়তাবাদ যুক্ত হয়েছিল স্বাধীনতার পর।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের শুরুই হয়েছিল মুহম্মদ আলী জিন্নার দ্বিজাতি-তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে। তাঁর দল মুসলিম লীগকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, নিজ সম্প্রদায় তথা ভারতে সংখ্যলঘিষ্ট ধর্মগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে। দ্বিজাতি-তত্ত্বটা ছিলো ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উপর নির্ভরশীল। এর বিপরীতে বাঙালির জাতির অবস্থান ছিলো অসাম্প্রদায়িক সমন্বয়বাদী জীবনাদর্শ তুলে ধরে। 

দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উপর মরণ কমড় দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শুরুতেই ভাষার উপর আক্রমণ। ক্রমে আরো আগ্রাসী হয়েছে। সেই সময় থেকেই ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে নিজেদের স্বার্থে। সাম্প্রদায়িক মুসলিম জাতীয়তার নামে জাতিগত অধিকারের অস্বীকৃতি তথা জাতিগত পীড়নের  জবরদস্তিমূলক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। জাতীয়তাবাদ অবলম্বন করে যারাই এগোবার চেষ্টা করেছে তা বহুক্ষেত্রে সমাজ বা মানুষের জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা হয়নি।

স্বাধীন দেশে সেই বিজাতীয় ধারাবাহিকতা কী চলতে থাকবে? ধর্মাচারকে প্রাধান্য দিয়ে আর যাই হোক আজকের পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি আমাদের সংবিধানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবেই গৃহীত হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল এই চার মূলনীতি রাষ্ট্রের মতাদর্শিক স্তম্ভ এবং একই সাথে গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের স্মারক। কিন্তু এখন রাষ্ট্রের মতাদর্শিক স্তম্ভগুলোতে সর্বত্রই মলিনতা অনুভূত হচ্ছে যা দেখে আশাহত হই। 

আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যখন ইতিহাসের পাতা উল্টাই গর্বে বুক ভরে উঠে। আমাদের পূর্বসূরিরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন করে যেমন বিশ্বের মানুষকে সচকিত করে তুলে ছিলো, বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার অধিকার আদায় করার জন্য, ১৯৭১ সালে সেই তারাই নিজেদের জাতীয় সত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি।

সেই বাঙালিই আবার সজাগ হয়ে উঠুক গণতান্ত্রিকতায়, পারস্পরিক সহযোগিতায়, সহমর্মিতায় অসাম্প্রদায়িকতায় আর সার্বজনীনতায়। ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলে রুখে দাঁড়াক সকল রক্ষণশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে। এই বাঙালির মধ্যেই আছে লোকায়ত স্তরের উদার মানবিকতার বৈশিষ্ট্য। জয় হোক বাঙালির, জয় হোক মানুষের।

লেখক : শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh