ওড়াকান্দি কী করে তীর্থভূমি হয়ে উঠলো?

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২১, ০৬:৩০ পিএম | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২১, ১০:৪৩ এএম

ওড়াকান্দি হিন্দু দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তীর্থভূমি। নিপীড়িত ও অবহেলিত নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মুক্তির দূত আধ্যাত্মিক পুরুষ পূর্ণব্রহ্ম শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের কারণেই গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ওড়াকান্দি লাখ লাখ মতুয়া ভক্তদের কাছে তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে। 

১৮৩০-১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময় ফরিদপুর-খুলনা-যশোর-বরিশাল অঞ্চলের নমঃশূদ্র তথা নিম্নবর্গের চাষি, চামার, কামার-কুমার, মুচি-মেথর ও তাঁতীদের মধ্যে সব জাগৃতির পথিকৃৎ ও প্রবাদপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৭-১৮৭৮)। তৎকালীন বাংলায় যেসব লোকধর্মের উদ্ভব হয়, তাদের মধ্যে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের পর-‘মাতুয়া’ সম্প্রদায়ই প্রেম-ভক্তিবাদের ক্ষেত্রে বৃহৎ পরিমণ্ডল সৃষ্টিতে সমর্থ হয়। নবজাগরণের চেতনাকে লালন করে-শাস্ত্রের নিরসতত্ত্ব থেকে বের হয়ে এসে ‘মাতুয়া’ সম্প্রদায় সমাজ-সংস্কৃতির আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের জন্য সৃষ্টি করেছিল নতুন পরিচয়। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের দীক্ষামন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে গ্রাম-বাংলার মানুষ মানবতাবাদ ও জাতপাতহীন ভক্তি-প্রেমবাদকে গভীরভাবে হৃদয়ে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এই সময় ‘মতুয়া’ ধর্মের ছায়অতলে থাকা ভক্তরা তাদের অভিজ্ঞতা ও আধ্যাত্ম-ভাবনার সমন্বয় ঘটিয়ে সৃষ্টি করেন ভিন্ন মতবাদ। বলা বাহুল্য যে, মতুয়া ধর্ম সংস্কারের আন্দোলনের সংস্পর্শে থেকেও তাদের মত সাধারণ ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষ গ্রাম-বাংলায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সক্ষম হয়েছিলেন আধ্যাত্মিক চেতনার স্ফুরণ ঘটাতে। এ রকম দুই জন মহামানব হলেন রাধানাথ মিস্ত্রি ও ‘রাইরসরাজ’ ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রবর্তক শ্রী শ্রী রাইচরণ বিশ্বাস (১৮৮২-১৯৭৬)


হরিচাঁদ ও গরুচাঁদ ঠাকুরের প্রবর্তিত আদর্শগুলোই মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা শ্রী শ্রী হরিলীলামৃত গ্রন্থে তারক সরকার তুলে ধরেন। এছাড়াও তারক সরকারের ‘মহানাম সংকীর্তন’ গ্রন্থটি থেকে মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মকর্ম সম্পর্কে জানা যায়। এই গ্রন্থগুলোই হল মতুয়া ধর্মের আদর্শবিষয়ক প্রধান গ্রন্থ। বাংলাদেশে এই সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যাই সর্বাধিক। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা আন্দোলনের ফলে এই সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রায় সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে এবং সমাজের ও রাষ্ট্রের অনেক নীতিনির্ধারণে ভূমিকা পালন করছে।

শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ১২১৮ বঙ্গাব্দে ইংরেজি ১৮১১ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ কাশিয়ানী উপজেলা সাফলীডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের পর থেকে সাফলীডাঙ্গা গ্রাম ধন্য হয়ে ওঠে। হরিচাঁদ ঠাকুরের বাল্য নাম হরি ঠাকুর। কিন্তু ভক্তরা তাকে হরিচাঁদ নামেই ডাকতেন। বাবা যশোবন্ত ঠাকুরের পাঁচ পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। পরে পার্শ্ববর্তী ওড়াকান্দি গ্রাম বসতি গড়ে তোলেন হরিচাঁদ ঠাকুর।

সেখানে হরিচাঁদ ঠাকুর অলৌকিকত্ব ও লীলার জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন।

হরিচাঁদ ঠাকুর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। পাঠশালা অতিক্রম করে তিনি কয়েক মাস মাত্র স্কুলে গিয়েছিলেন। পরে স্কুল জীবন ভালো লাগেনি তার। এ কারণে স্কুল ত্যাগ করে তিনি মিশে যান সাধারণ মানুষের সাথে। প্রকৃতির আকর্ষণে তিনি রাখাল বালকদের সাথে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন।

বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির, বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। তার জীবদ্দশায় ওই এলাকার নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন। তখন নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়ে চৈতন্যদেবের প্রেম-ভক্তির কথা সহজ-সরলভাবে প্রচার শুরু করেন। তার এই সাধন পদ্ধতিকে বলা হয় ‘মতুয়াবাদ’, আর এই আদর্শে যারা বিশ্বাসী, তাদের বলা হয় ‘মতুয়া’। মতুয়া শব্দের অর্থ মেতে থাকা বা মাতোয়ারা হওয়া।

হরি নামে যিনি মেতে থাকেন বা মাতোয়ারা হন, তিনিই মতুয়া। মতান্তরে ধর্মে যার মত আছে, সেই মতুয়া।

১৮৭২ সালের ব্রিটিশ আদমশুমারিতে ৩৬টি বর্ণের উদ্ভব দেখানো হয়েছিল। তার আগে থেকেই সমাজে বর্ণপ্রথা ও অস্পৃশ্যতা প্রচলিত ছিলো। তাই হরিচাঁদ ঠাকুর আদর্শ গার্হস্থ্য ধর্ম ও মতুয়াবাদ প্রচার করেছিলেন। এই মতুয়া মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে তিনি নীল কুঠিরের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন।

সমাজে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছেন। জমিদারের লোকজন মতুয়া মতবাদ প্রচারে হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসারীদের বাধা দিয়ে বর্বর নির্যাতন করেছেন। হরিচাঁদ নিজেও অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

তিনি এটি প্রচার করে মতুয়াবাদ প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। আর মতুয়াবাদ প্রচারের মাধ্যমে তিনি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সংগঠিত করেন।

তাদের বিপদ-আপদে সব সময় তিনি জাগ্রত থাকতেন। আর এভাবে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের কাছে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।  

হরিচাঁদ ঠাকুর ও তার ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের ব্যাপক আধ্যাত্মিক শক্তি ছিলো। এই আধ্যাত্মিক শক্তির বলে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর হিন্দু ধর্মাবলম্বী কাছে অবতার হিসেবে খ্যাত। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের জীবদ্দশায় তাদের আধ্যাত্মিক শক্তির কারণে বিভিন্ন রোগাক্রান্ত মানুষ মুক্তি পেয়েছেন এবং অনেক বন্ধ্যা নারী সন্তান লাভ করেছেন।

এছাড়া কুষ্ঠরোগ ও বিপদ-আপদে পড়লে তাদের নাম স্মরণ করলে মুক্তি মিলতো বলে প্রচারিত রয়েছে। এভাবে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামযশ দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

এভাবে দেশ ও দেশের বাইরে তৈরি হয় অগণিত অনুসারী। তখন থেকে তাদের ভক্ত ও অনুসারীরা ওড়াকান্দি এসে ঠাকুরকে মানত করতেন। প্রতি বছর হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম তিথিতে এখানে দেশ-বিদেশিসহ লাখ লাখ মতুয়া এখানে আসেন। রোগমুক্তি ও কামনা-বাসনে পূরণের জন্য স্নান করেন। এর মাধ্যমে ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করেন। এ সময় যার যার সাধ্যমত ঠাকুরের নামে দান করেন।


এদিকে মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থভূমি ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়ি মন্দিরে পূজা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে ফুল দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো শেষে কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ি মন্দিরে শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি ঠাকুরবাড়ি মন্দিরে পৌঁছান। পরে তিনি সেই মন্দিরে পূজা দেন। এর পরে তিনি সেখানে মতুয়া সম্প্রদায়ের সাথে মতবিনিময় করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের ভোটের মৌসুমে মোদি ঢাকা সফরকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চাইছেন। পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশে বিপুল সংখ্যক মতুয়া সম্প্রদায়ের বসবাস। উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়ার মতো জায়গায় মতুয়া ভোট একটি বড় ফ্যাক্টর। এই পরিস্থিতিতে মতুয়ার ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা হরিচাঁদ ঠাকুরের বাড়ি দেখতে চান মোদী। সেখানে গেলে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায়কে একটি বার্তা দিতে পারবেন তিনি।

গত লোকসভা নির্বাচনে মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁ আসনে বিজেপি জিতেছিল। সেখানকার সাংসদ মতুয়া পরিবারের সদস্য শান্তুন ঠাকুর। কিন্তু বিধায়ক তৃণমূলের মমতা ঠাকুর। তিনিও মতুয়া পরিবারের সদস্য। লোকসভা ভোটের পরে বিজেপি এনআরসি এবং সিএএ নিয়ে যখন অগ্রসর হয়, তখন মতুয়াদের মধ্যে বিজেপি বিরোধী হাওয়া তৈরি হয়েছিল বলে মনে করা হয়। মাঝে মতুয়াদের আপত্তির কারণে বনগাঁয় বিজেপির সভাও বাতিল করতে হয়েছিল। ফলে এবারের নির্বাচনে নতুন করে মতুয়াদের মন পেতে চাইছে বিজেপি। সে কারণেই মোদি হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মস্থানে যেতে চান বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। 

২৭ মার্চ থেকে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন শুরু হয়েছে। আট দফার ভোটগ্রহণ শেষ হবে ২৯ এপ্রিল। এই সময়ে মোদির ঢাকা সফর এবং হরিচাঁদ ঠাকুরের বাড়িতে যেতে চাওয়া, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দেখতে চাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh