ভিনদেশি রুপালি পর্দায় মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

জয় শিকদার

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২১, ১১:৫১ এএম

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে ভীনদেশি নির্মাতাদেরও। তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেমন দৃষ্টিকে উপলব্ধি করেছেন। তার ভাবনায় নির্মাণে মুক্তিযুদ্ধ রুপালি পর্দায় দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। 

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এমন কিছু ছবি নিয়ে এবারের ফিচার-

‘মুক্তির গান’ (১৯৯৫)

‘মুক্তির গান’ বাংলা ভাষায় নির্মিত তথ্যচিত্র হলেও পরিচালক হিসেবে এতে তারেক মাসুদের পাশাপাশি মার্কিন নির্মাতা ক্যাথরিন মাসুদের নামও দেখতে পাই আমরা। তবে ১৯৭১ সালে মূল তথ্যচিত্রটি ধারণ করেছিলেন মার্কিন চলচ্চিত্রনির্মাতা লিয়ার লেভিন। ১৯৭১ সালে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামের একটি সাংস্কৃতিক দলের সদস্যরা যুদ্ধ-কবলিত বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলগুলোতে ঘুরে ঘুরে ‘মুক্তির গান’ পরিবেশন করত। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে গান, কবিতা, ছায়া নাটক, পুতুল নাচ ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের অণুপ্রাণিত করত। শিল্পী গোষ্ঠীর সাথে দেশের বিভিন্ন অংশ ও ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে অসহায় ও দুঃস্থ জনগণের দুর্দশার চিত্র ক্যামেরাবন্দি করেন লিয়ার লেভিন। পরবর্তীতে এ ফুটেজগুলো তার কাছ থেকে সংরক্ষণ করেন বাংলাদেশি চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদ।

ফুটেজের সাথে সুর ও ন্যারেটিভজুড়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ষিত কিছু ফুটেজ ব্যবহার করে একে ‘মুক্তির গান’ (সং অফ ফ্রিডম) শিরোনামে প্রামাণ্যচিত্র আকারে সবার সামনে আনেন তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ। একাত্তরের দুর্লভ দলিল হিসেবে আজও দেশে-বিদেশে সমাদৃত ‘মুক্তির গান’।

‘১৬ ডিসেম্বর’ (২০০২)

বলিউড অ্যাকশন স্পাই থ্রিলার ‘১৬ ডিসেম্বর’ পরিচালনা করেন মনি শঙ্কর। এতে অভিনয় করেন ড্যানি ডেনজংপা, গুলশান গ্রোভার, মিলিন্দ সোমান, দীপান্বিতা শর্মা, সুশান্ত সিং প্রমুখ। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় বরণ করে নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে। আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক ঘটনাকে পটভূমি করে নির্মিত হয়েছে এ সিনেমাটি।

সিনেমায় দেখা গেছে, একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য পরাজয়ের অপমান ভুলতে না পেরে ‘কালাখানজার’ নামের একটি অপরাধী চক্র গড়ে তোলে। ভারতে এ দলটি গোপনে মানি লন্ডারিংসহ নানা অনৈতিক কাজ চালিয়ে যায়। ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর চার সদস্যকে দেয়া হয় ‘কালা খানজার’ ধ্বংস করে দেয়ার মিশন। ঘটনাচক্রে ২০০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয়া দিল্লিতে একটি জঙ্গি হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে ‘কালা খানজার’।

১৯৭১ সালের সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের দিনটির কথা মাথায় রখেই এই তারিখ নির্ধারণ করেন তারা। অসীম সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সাথে এ জঙ্গি হামলা প্রতিহত করে চার গোয়েন্দা বিজয়, বিক্রম, শীবা ও ভিক্টর।

‘১৯৭১’ (২০০৭) 

অমৃত সাগর পরিচালিত বলিউড ওয়ার সিনেমা ‘১৯৭১’ এ পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছয় ভারতীয় সৈন্যের পালিয়ে ভারতে আসার গল্প বলা হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে লড়তে আসা ছয় ভারতীয় সৈনিক বন্দি হয় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। ছয় বছর কারাবন্দি থাকার পর ১৯৭৭ সালে জেল পালিয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন তারা। এমনই এক চমকপ্রদ গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি।

রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরপুর এ সিনেমাটিকে বলিউডের অন্যতম সেরা ক্ল্যাসিক ছবির স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সিনেমার শুরুতে দেখানো হয় বাংলাদেশে যুদ্ধরত ছয় ভারতীয় সৈন্যকে। এ সিনেমায় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ দেখানো না হলেও ঘটনা পরম্পরায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন খণ্ডচিত্র। এতে অভিনয় করেছেন মনোজ বাজপায়ী, রবি কিষান, কুমুদ মিশ্র, মানব কউল, দীপক দব্রিয়াল, পীযূষ মিশ্র প্রমুখ।

অসাধারণ নির্মাণশৈলী ও চমৎকার অভিনয়ের জন্য সিনেমাটি সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়ে। ২০০৭ সালের সেরা সিনেমা হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে ‘১৯৭১’।

‘গয়নার বাকস’ (২০১৩) 

অপর্ণা সেন পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় হরর কমেডি ‘গয়নার বাকস’তে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। তিন প্রজন্মের তিন নারীর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গহনা নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতার গল্প মজার ছলে উঠে এসেছে এ সিনেমায়। সিনেমায় দেখা গেছে ১৯৪৭-এর দেশভাগে পূর্ববাংলা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমানো হিন্দু বিধবা নারী রশোমনির গচ্ছিত গহনা মৃত্যুর পর পায় তার ভাইয়ের ছেলের বউ সোমালতা।

মারা যাওয়ার পরও গহনার মায়া ভুলতে না পেরে ভূত হয়ে গহনা পাহারা দিতে আসেন রশোমনি। তারই পরামর্শে গহনার কিছু অংশ বিক্রি করে স্বামীকে ব্যবসার অর্থ জোগান দেয় সোমালতা। পরবর্তীতে গহনার মালিকানা পায় সোমালতার মেয়ে চৈতালি। আধুনিক যুগের মেয়ে চৈতালি যখন বড় হয় তখনই পূর্ববঙ্গে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। ২৫ মার্চের নির্মম গণহত্যার পর পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে পালিয়ে আসে অসংখ্য শরণার্থী। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে শুরু হয় মুক্তিবাহিনী গঠন। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে চৈতালি তার সমস্ত গহনা দান করে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে। এ সিনেমায় অত্যন্ত আবেগী ও মর্মস্পর্শীভাবে উঠে এসেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

এ সিনেমায় ভূত রশোমনি ও সোমালতা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন অভিনেত্রী মৌসুমী চ্যাটার্জী ও কঙ্কনা সেন শর্মা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh