মুক্তি ও কল্যাণের রজনী লাইলাতুল বরাত

মাওলানা লিয়াকত আলী

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২১, ০৮:৫৫ এএম

হিজরি সনের অষ্টম মাস শাবানের ১৪ তারিখ দিনগত রাত লাইলাতুল বরাত নামে প্রসিদ্ধ। আরবিতে এটি লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান হিসেবে পরিচিত, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় মধ্য শাবানের রজনি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের বাণী অনুযায়ী এ রাতে আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। এ জন্য এটি লাইলাতুল বরাত বা মুক্তির রজনি নামে প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে।

কোরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে- শপথ স্পষ্ট গ্রন্থের। নিশ্চয়ই আমরা তা অবতীর্ণ করেছি কল্যাণময় রজনিতে। নিশ্চয়ই আমরা সতর্ককারী। আমাদেরই নির্দেশক্রমে উক্ত রাতে প্রতিটি বিষয় ফায়সালা হয়। আর নিশ্চয়ই আমরাই প্রেরণকারী। (সুরা দুখানঃ ২-৫)

এখানে উল্লিখিত মুবারক বা কল্যাণময় রজনি বলতে বেশির ভাগ মুফাসসিরের মতে, রমজানের কদরের রাত উদ্দেশ্য। তবে আবার নির্ভরযোগ্য মুফাসসিরদের একটি অংশের অভিমত এখানে মধ্য শাবানের রাত উদ্দেশ্য।

হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, এক রাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না। (খুঁজতে বের হয়ে) হঠাৎ (দেখলাম) তিনি বাকি কবরস্তানে। তিনি (আমাকে) বললেন, তুমি কি আশঙ্কা কর যে, আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার ওপর অবিচার করবেন? আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আমি ধারণা করেছিলাম, আপনি হয়তো আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তখন তিনি বললেন, (তা নয়, বরং) নিশ্চয়ই আল্লাহ শাবানের মধ্যভাগের রাতে পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন তারপর তিনি কালব গোত্রের মেষের পশমের চেয়ে বেশিসংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি শরীফ)

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা থেকে আরো বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হে আয়েশা তুমি কি জান, এই রাতে কী সংঘটিত হয়? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, এ রাতে কী সংঘটিত হয়? আল্লাহর রাসূল তখন বললেন, এ রাতে আগামী এক বছরে কতজন সন্তান জন্মগ্রহণ করবে এবং কতজন লোক মারা যাবে, তা লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাতে বান্দার (এক বছরের) আমলসমূহ আল্লাহর নিকট পেশ করা হয় এবং এ রাতে বান্দার (এক বছরের) রিজিকের ফায়সালা হয়। (বায়হাকী শরীফ)

হযরত আবু মুসা আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ শাবানের অর্ধাংশের রাতে নেমে আসেন এবং শুধু মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে মাজা শরীফ)

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন অর্ধ শাবানের রাত উপস্থিত হবে তখন তোমরা সেই রাতে সজাগ থেকে ইবাদত-বন্দেগি করবে এবং দিনের বেলায় রোজা রাখবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ উক্ত রাতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করতে থাকেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিক প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দান করব। কোনো বিপন্ন আছে কি? আমি তার বিপদ দূর করে দেব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত তিনি ঘোষণা করতে থাকেন। (ইবনে মাজা শরীফ)

অতএব, এ রাত আল্লাহ তায়ালার মহান দরবারে ক্ষমা প্রার্থনার বিশেষ সময়। প্রতিটি কল্যাণকামী মানুষের কর্তব্য এ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা এবং মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন হয়ে রাত অতিবাহিত করা। তাৎপর্যপূর্ণ এই রাতে বিশেষ বরকত হাসিলের জন্য নফল নামাজ আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, ইস্তেগফার, তাসবিহ-তাহলিল ও দুয়ায় মশগুল থাকা উচিত ।

লাইলাতুল বরাত রমজান মাসের আগমনি বার্তা ঘোষণার রাত। মাত্র দুই সপ্তাহ পরে এসে যায় রমজান। এ জন্য মুমিন বান্দারা পবিত্র মাসে আরও বেশি ইবাদতে মশগুল হওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা রমজানের খাতিরে শাবানের তারিখগুলোর হিসাব রাখো। (তিরমিজি শরীফ)

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম রমজানের পরে শা‘বান মাসের চেয়ে বেশি রোজা অন্য কোনো মাসে রাখতেন না। আরেক বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল প্রায় পুরো শাবান মাস রোজায় কাটাতেন। এ রাতের নফল আমলসমূহ বিশুদ্ধ মত অনুসারে একাকী করণীয়। ফরজ নামাজ জামায়াতের সঙ্গে অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। তবে নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো প্রমাণ হাদিস শরীফে নেই। আর সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবা তাবেঈনের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। তবে এমনিই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায়, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবেন, একে অন্যের আমলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হবেন না।

বরকতময় এ রজনিতে কিছুসংখ্যক লোক এ রাতে এমন কিছু কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে, যেগুলো ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যেমন : পটকাবাজি, তারাবাজি, আতশবাজি, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা, পোলাও-বিরানি ও হালুয়া-রুটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া ইত্যাদি। এগুলো নিছক কুসংস্কার বৈ কিছু নয়। শরীয়তে এর কোনো ভিত্তি নেই। বরং যেহেতু এদিন সূর্যাস্ত থেকেই আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে এসে বান্দাদের ডাকতে থাকেন, তাই তার ডাকে সাড়া না দিয়ে এসব ভোজনে লিপ্ত থাকা একদিকে যেমন আল্লাহর সেই আহ্বানের প্রতি অবজ্ঞার প্রকাশ, তেমনি এতে ইবাদতেও বিঘ্ন ঘটে। কেননা উদরপূর্তির দরুণ এ মুক্তির রজনিতে ইবাদতে আলস্য চলে আসে। রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে অধিক পরিমাণ ইবাদত-বন্দেগি করার ইচ্ছা করলে হালকা-পাতলা খানা খাওয়া ভালো। অনেক স্থানে এ রাতে গরু-ছাগল-মুরগি জবাইয়ের ধুম পড়ে যায়। এ সবই সুন্নাত পরিপন্থী।

অনেক স্থানে দেখা যায়, বরাত রজনিতে মুসল্লিদের একত্র করে রাতব্যাপী ওয়াজ-নসিহতের আয়োজন করা হয়। যেহেতু এ রাতে নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, দরুদ পাঠ, কবর জিয়ারতের মতো বিভিন্ন ইবাদত করতে নবী করিম (সা.) হতে ইঙ্গিত এসেছে, তাই অন্যান্য ইবাদত ব্যতীত শুধু ওয়াজ-নসিহত করে জাগরণ করা উচিত হবে না। তবে রাতের শুরুতে ইবাদতের নিয়ম-কানুন জানানোর উদ্দেশ্যে এ রাতের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য কিছু সময় আলোচনা করা যেতে পারে।

মুক্তির বারতা নিয়ে আগত পবিত্র বরাত রজনিতে প্রতিটি মুসলমানের উচিত যাবতীয় ফজিলত অর্জনের জন্য প্রয়াসী হওয়া। এজন্য পূর্বদিনেই নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুমিয়ে নেয়া প্রয়োজন, যাতে রাতের বেলা ঘুম আমাদেরকে কাহিল করতে না পারে। নবী করীম (স.) আল্লাহর দরবারে আগ থেকেই এই বলে দুয়া করতেন এবং দুয়া করতে বলতেন- হে আল্লাহ! আমাদেরকে রজব ও শাবান মাসে বরকত দাও এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছাও। এ হাদিসের দ্বারা এ রাতের গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। 

এ রাতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে নফল নামাজ পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে এটাই কাম্য। আরো উচিত নফল নামাজের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দুই রাকআত করে যত রাকআত সম্ভব হয় নামাজ পড়তে থাকা, কোরআনুল কারীম তেলওয়াত করা, গভীর ধ্যানে বেশি বেশি দরূদ পড়া, ইস্তেগফার করা, দুয়া করা ও তাসবিহ তাহলিল পাঠ করা। আর সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই নিজের জন্য, নিজের পিতা-মাতা, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী ও সব মুসলমানের জন্য কল্যাণ কামনা করা, তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।

লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh