স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী দেশের উল্টোযাত্রা

সাইফুল হক

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২১, ০৯:৫৭ এএম | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০২:০৭ পিএম

এই জনপদের মানুষের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম; মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল এদেশের আপামর জনগণের হার না মানা এক জনযুদ্ধ। 

আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করলেও এই সংগ্রামে সকল বাম, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি ও শত ধরনের শ্রেণি ও গণসংগঠনের নেতা, কর্মী, সংগঠকরা জীবনবাজি রেখে অংশগ্রহণ করেছেন এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ মরিয়া সংগ্রাম ও যৌথ নেতৃত্বে এই লড়াইয়ে তারা বিজয়ী হয়েছে। 

মুষ্টিমেয় দালাল, বেঈমান ও বিভ্রান্তরা ছাড়া এই সংগ্রাম ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের অস্তিত্ব, সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক সর্বাত্মক যুদ্ধ। বিশাল আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ এই ঐতিহাসিক সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছে; রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ভুখণ্ড অর্জন করেছে।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রচারিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিশাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠা করাকেই দেশের চলার পথ হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছিল ও এই পথ নির্দেশনার আলোকেই কিছু স্ববিরোধিতা নিয়ে পরবর্তীতে প্রণীত সংবিধানের চার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ নির্ধারণ করা হয়েছিল। জনগণের প্রবল আকাক্ষা, গণচেতনা ও সামগ্রিক পরিস্থিতির চাপে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে এর বাইরে যাওয়া বা তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ ছিল না; কিন্তু এই ধরনের নীতি আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য দল ও তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে ধরনের আদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি দরকার ছিল আওয়ামী লীগের তা ছিল না। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান নিয়ে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের এক বড় অংশের আলাদা রাজনৈতিক দল- জাসদ গঠন করার পর মতাদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ ক্রমে দুর্বল হতে থাকে। সিপিবি ও ন্যাপ মোজাফ্ফর এর সাথে রাজনৈতিক ঐক্য এই ব্যাপারে বিশেষ কোনো ফল দেয়নি। 

বাকশাল গঠন করে বিস্ফোরণ্মুখ পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। আখেরে তাও বিশেষ কোনো কাজে আসেনি; উল্টো নানা দিক থেকে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে; ’৭৫ এর পর রাষ্ট্র-রাজনীতির বড় মোড় পরিবর্তন হয়েছে। 

এই বছর দেশের জনগণ এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের, স্বাধীনতার ৫০ বছর, সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূচকে সাফল্য ও অগ্রগতির স্বাক্ষর রেখেছে সন্দেহ নেই। কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে এখন ৪১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে উঠেছে; উৎপাদনশীলতায়ও ঘটেছে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। গত ক’দশকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাণিজ্যসহ অর্থনীতিতে নানা উত্থান-পতন দেখা গেলেও এইক্ষেত্রে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে কিছু সাফল্য দেখাতে পেরেছে। জাতীয় বাজেটে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। দেশের অর্থনীতিতে দাতা সংস্থাসমূহের ‘প্যারিস কনসোর্টিয়াম’-এর ভূমিকাও এখন গৌণ হয়ে এসেছে। সামাজিক অগ্রগতির বেশ কিছু সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য রয়েছে। তবে এসব অগ্রগতির প্রধান কুশীলব এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি, দেশের শ্রমিক, কৃষক, শ্রমজীবী, মেহনতি ও কর্মজীবী কোটি কোটি উৎপাদনশীল সাধারণ মানুষ। তাদের দেশপ্রেম, উৎপাদনশীলতা ও বৈচিত্র্যময় কর্মকুশলতা এই সাফল্যের প্রধান নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। তাদেরকে যদি দক্ষতার সাথে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও কার্যকর সহযোগিতা প্রদান করা যেত তাহলে আমাদের অযুত সম্ভাবনার উৎপাদনশীল এই মানুষ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাজিকই দেখাতে পারতেন। জনগণের রাষ্ট্র ও সরকার না থাকায় আমাদের বিশাল সম্ভাবনার অনেকখানিই নষ্ট হয়েছে। 

এই সাফল্য ও অগ্রগতির বিপরীত চিত্রটি কী? গত পাঁচ দশকে দেশে পুঁজি ও সম্পদের পুঞ্জিভূতকরণ ও কেন্দ্রীকরণ অসম্ভব দ্রুত গতিতে জোরদার হয়েছে। ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রবল হয়েছে; শ্রেণি মেরুকরণও প্রকট হয়েছে। ভূমিহীন ও শ্রমজীবী মেহনতিদের সংখ্যা আশঙ্কার চেয়েও অনেক বেড়েছে। অর্থ ও সম্পদ পাচার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। পাকিস্তানি জমানার মতো এক দেশে দুই সমাজ, দুই অর্থনীতি কায়েম হয়েছে। সরকারের কথিত মুক্ত বাজার অর্থনীতি বস্তুত এক লুটেরা অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে। ব্যাংক, বীমা, শেয়ার মার্কেটসহ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ও কার্যক্রমে অর্থনৈতিক বিবেচনার পরিবর্তে রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনাই প্রধান হয়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে এক ধরনের ‘আদিম সঞ্চয়ের’ প্রবণতা এখনো বিদ্যমান। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি আশাপ্রদ নয়। আস্থাহীনতার কারণে দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগের পরিবর্তে অর্থ ও সম্পদ পাচারের প্রবণতা এখনো আশঙ্কাজনক রকম ঊর্ধ্বমুখী। আর সামষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার পরিবর্তে নৈরাজ্যই এখনো বড় সংকট। 

দেশের সুবর্ণজয়ন্তীর এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রাষ্ট্র রাজনীতির অবস্থা শোচনীয়। নিরানন্দ, অধিকারহীন ও এক ধরণের অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে আজ দেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পালন করতে হচ্ছে। মানুষের ভোটের অধিকার আজ অস্বীকৃত। পাকিস্তানিরা এদেশের জনগণের ভোটের রায় মেনে নেয়নি বলে যেখানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয়েছিল, আজ পঞ্চাশ বছর পর দেশের মানুষকে এই ভোটের অধিকারের জন্যই লড়াই করতে হচ্ছে। দেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই তুলে নেয়া হয়েছে। আধুনিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন প্রণয়ন বিভাগের মধ্যে যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয় বাংলাদেশে তা ঘুঁচিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপ্রস্তাবে আইন প্রণয়ন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধীন করে তোলা হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অবস্থাও তথৈবচ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা ধরণের নিবর্তনমূলক কালাকানুনের বেড়াজালে নাগরিকদের সাধারণ গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার অনেকটাই নির্বাসিত। সরকারের বেঁধে দেয়া চৌহদ্দির মধ্যে ‘বাকস্বাধীনতা’। জঙ্গীরা যেমন নাগরিকদের বাক স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার বিরোধী, সরকারও তেমনি মানুষের কথা বলা, চিন্তা করার স্বাধীনতাও নানাভাবে কেড়ে নিতে, সংকুচিত করতে তৎপর। সাধারণ সত্য উচ্চারণেও তারা আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কারাবন্দি অবস্থায় লেখককে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। হত্যা, সন্ত্রাস, গুম, অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, মিথ্যা মামলা, হয়রানি, সর্বোপরি গণআতঙ্ক এখন শাসন ও ক্ষমতায় থাকার মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

গত পঞ্চাশ বছর ধরে শাসনের এই ধারা পদ্ধতি কেবল জোরদারই করা হচ্ছে। এটা করতে যেয়ে সমগ্র রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দমন ও উগ্র বলপ্রয়োগের চরম অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অর্জিত যে রাষ্ট্রের মানবিক, গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক হবার অঙ্গীকার ছিল, গত অর্ধ শতাব্দীতে সেই রাষ্ট্র এখন প্রবলভাবে জনবিচ্ছিন্ন ও জনগণের প্রতিপক্ষ হয়ে নিপীড়নমূলক আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা এখন অসীম। এই ক্ষমতা ব্যবহার করে এখন যা খুশি তাই করা যায়। দেশে ভোট ও নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা আরও বেড়েছে। শাসক দল আওয়ামী লীগকে এখন ক্ষমতায় থাকতে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপরই প্রধানত নির্ভর করতে হচ্ছে।  

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একটি ক্ষীণ প্রত্যাশা হয়তো জণগণের একাংশের মধ্যে ছিল; কিন্তু তাও গুড়ে বালি। রাজনীতিতে উল্টো বরং বিরোধ-বিভাজন, হিংসা-বিদ্বেষ বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পথে সরকার পরিবর্তনের সুযোগও রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগ ও আতংকের। টেকসই উন্নয়নের জন্য যে টেকসই গণতান্ত্রিক পরিসর বাড়ানো দরকার সরকারের নীতিনির্ধারকরা তা এখনো আমলে নিচ্ছে না। প্রায় অবরুদ্ধ এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেবল অনাকাক্সিক্ষত চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের জমিন আর চরম দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ ও রাজনৈতিক শক্তির জন্য রাস্তা প্রশস্তই হতে থাকে।

এটা স্পষ্ট যে প্রচলিত গতানুগতিক রাজনীতির মধ্যে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো অবকাশ নেই। শাসকশ্রেণির মধ্যে ক্ষমতার সাধারণ পালাবদলেও এর সমাধান নেই। 

এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দিশা ও কর্মসূচির ভিত্তিতে গণজাগরণ-গণবিপ্লবের লক্ষ্যে জনগণের কার্যকর ঐক্য গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে এসব উপলব্ধি যত গভীর হবে কর্তব্যকর্মও তত পরিষ্কার হবে।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh