প্রাণহীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সর্বত্র হেফাজতের তাণ্ডবের চিহ্ন

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২১, ০২:২৭ পিএম | আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২১, ০২:৫৮ পিএম

ছবি: ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

ছবি: ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

প্রাণহীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া। হেফাজতের তিনদিনের আন্দোলন-হরতালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারদিকে ধ্বংসস্তূপ আর পোড়া গন্ধ। ক্ষয়ক্ষতির শেষ নেই। 

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২৬ মার্চ ফুঁসে উঠে জেলা শহর। হেফাজত নেতা-কর্মীরা ভাদুঘরে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে বিক্ষোভ শুরু করে ওইদিন বিকাল ৩টায়। এক পর্যায়ে শহরজুড়ে শুরু হয় তাদের তাণ্ডব। শহরের কাউতলী মোড়ে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো পুড়িয়ে দেয়া হয়। 

এরপর একে একে হামলা চলে ডিসি-এসপির অফিস, সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ জেলা পর্যায়ের প্রায় সব অফিসে। হামলা হয় সার্কিট হাউসে। শহরের কাচারীপুকুর পাড়ে বঙ্গবন্ধু স্কয়ারে হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভেঙে দেয়া হয়। রেলস্টেশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষসহ সবকটি কক্ষে গানপাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে মালামাল পুড়িয়ে দেয়া হয়। স্টেশনটির কোনো কার্যক্রম নেই এখন। কোনো ট্রেন যাত্রাবিরতী করে না স্টেশনে।


তবে হরতালের দিনে তাণ্ডব সীমা ছাড়িয়ে যায়। এদিন হেফাজতকর্মীদের দেয়া আগুন পুড়ে ছাই হয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র নামে প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতাঙ্গন। সঙ্গীতাঙ্গণের মিলনায়তনের সরোদমঞ্চের পাশাপাশি পুড়ে গেছে মিউজিয়ামে রক্ষিত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা ভবন, সদর উপজেলার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, পৌর ভবন, আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন, জেলা পরিষদ কার্যালয় ও মার্কেট, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের কার্যালয় ও বাড়ি, তার শ্বশুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বারের সাবেক সভাপতি ফরিদ উদিদ্দন আহমেদের বাসভবন, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন রুবেলের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে হেফাজতকর্মীরা। এ ছাড়া হেফজাতকর্মীরা ব্যাংক এশিয়ার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবেও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। 

হেফাজতকর্মীদের চালানো ধ্বংসযজ্ঞে খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা ভবনের সকল জিনিসপত্র পুড়ে যাওয়ায় থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। হরতালের দিনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধের পর হেফাজত কর্মীদের সাথে প্যান্ট-শার্ট পরা কিশোর-তরুণরাও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ায়। একপর্যায়ে তারা থানায় আগুন দেয়। পুলিশের একটি এপিসি ভাঙচুরের পর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। 


আগুনে পৌরসভা ভবনের দ্বিতীয় তলার সবকটি কক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েকটি কক্ষে থাকা প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মেয়র ও সচিবের কক্ষে পোড়া আসবাবপত্র পড়ে থাকতে দেখা গেছে। যে জিনিসপত্রগুলো আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছে- সেগুলোই এখন ভেতর থেকে বের করছেন পৌরসভার কর্মচারীরা। কবে নাগাদ পৌরসভার কার্যক্রম শুরু হবে সেটি স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

হেফাজতকর্মীদের দেয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে সুনশান নীরবতা। কয়েকজন কর্মচারীকে নিয়ে সহকারী কমিশনারকে কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করতে দেখা গেছে। আগুনে কার্যালয়ের রেকর্ড রুমে রক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ সকল নথিপত্র পুড়ে গেছে। অফিসের সামনে পুড়ে যাওয়া সেই নথিপত্রগুলো পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কিছু নথিপত্র না পুড়লেও আগুন নেভানোর জন্য দেয়া পানিতে ভিজে সেগুলোও নষ্ট হয় গেছে।

হেফাজত কর্মীদের চালানো তাণ্ডবের শিকার আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তনটিতে এখন ছাই ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মিলনায়তনের কয়েকশ চেয়ার ও দরজা-জানালা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। দেয়ালের পলেস্তারাও খসে পড়েছে। সবকটি পাখা আগুনের তাপে বাকা হয়ে নিচের দিকে হেলে পড়েছে।


হরতাল চলাকালে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্ত্বরে জেলা প্রশাসন আয়োজিত উন্নয়ন মেলার ৩২টি স্টলে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে হেফাজতকর্মীরা। ভাঙচুর-আগুনে বিধ্বস্ত ভাষা চত্ত্বরজুড়ে কেবল ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ। ভাঙচুর ও আগুনে পোড়া জিনিসপত্রের স্তুপ দেখা গেছে সেখানে। 

হেফাজতকর্মীরা জেলা শহরের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের ব্যক্তিগত কার্যালয়টি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। কার্যালয়ে গিয়ে আগুনে পোড়া জিনিসপত্রের ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এছাড়া শহরের ফুলবাড়িয়ায় আল মামুন সরকারের বাড়িতেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগুনে ঘরের কযেকটি কক্ষের সোফা, পাখা ও এসিসহ অন্যান্য আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া আসবাবপত্রগুলো এখনো ঘর থেকে সরানো হয়নি।

জেলা পরিষদ কার্যালয় : হরতাল সমর্থনে হেফাজতকর্মীরা জেলা পরিষদ কার্যালয়েও আগুন দেয়। আগুনে জেলা পরিষদ মিলনায়তনের চেয়ার, এসি ও পাখা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জেলা পরিষদের কার্যায়ের বিভিন্ন কক্ষ ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সরকারি গাড়িটি হেফাজত কর্মীদের দেয়া আগুন পুড়ে গেছে। ভবনে থাকা প্রয়োজনীয় নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। 


ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব : ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে হামলা হয় কয়েক দফা। এর সম্মুখভাগে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। এসময় প্রেস ক্লাব সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামিকে রাম দা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। 

হামলা হয়েছে আরো অনেকস্থানেই। জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার, জেলা আনসার-ভিডিপি কার্যালয়, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স, ব্যাংক এশিয়ার শাখায়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর কার্যালয়, মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র, আনন্দময়ী কালীবাড়ি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। 

জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও আয়কর উপদেষ্টা জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়ার কার্যালয়ও ভাঙচুর করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এ. বি. এম. মশিউজ্জামান বলেন, ‘আমার কক্ষসহ অন্যান্য কক্ষে আগুন দেয়া হয়েছে। সবকিছু পুড়ে গেছে। রেকর্ড রুমে আগুন দেয়ার কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়ে গেছে। এতে করে সাধারণ মানুষেরই বেশি ক্ষতি হয়েছে’। 

খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গাজী শখাওয়াত হোসেন বলেন, পুরো থানায় ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছে হেফাজত কর্মীরা। অস্ত্রাগারেও হামলা চালিয়েছে। এপিসিসহ কয়েকটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সব ক্ষয়ক্ষতি এখনো নিরূপণ করা হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পরিদর্শনের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

এদিকে সরাইলের অরুয়াইল ফাড়িতে হামলা হয়। হামলা হয় আশুগঞ্জ আওয়ামীলীগ নেতা আবু নাছেরের বাড়িতে। তার বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। হামলা হয় আশুগঞ্জ টোলপ্লাজায়। 

এসব ঘটনায় এপর্যন্ত মোট ১৯টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে সদরে ১৬টি, আশুগঞ্জে দুইটি ও সরাইলে একটি মামলা হয়। এসব মামলায় আসামি ২১ হাজার। 

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার বলেন, হেফাজতকে ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াত, মাদক ব্যবসায়ী, অবৈধ অস্ত্রধারীরা এই তাণ্ডব চালিয়েছে। বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে এই তাণ্ডব মোকাবেলায় ব্যর্থতার দায় চিহ্নিত করে, ধারণকৃত ফুটেজ দেখে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির সুপরিকল্পিত চক্রান্ত এই ঘটনা। 

আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনের সাধারন সম্পাদক মঞ্জরুল আলম বলেন, বিশ্ববিখ্যাত সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটিতে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানান নেই। তিনি ভিডিও ফুটেজ দেখে এই হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। 

সাহিত্য একাডেমির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জয়দুল হোসেন এই তাণ্ডবের নিন্দা জানান। তিনি হেফাজতীদের কঠোর বিচার দাবি করেন। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh