গ্রন্থমেলা-২১ ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ শেষে

জোবায়ের মিলন

প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২১, ১০:৩৮ পিএম | আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২১, ১১:৩২ পিএম

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২১’ শুরু হয়েছিল মার্চের প্রায় শেষ দিকে। শারীরিক দূরত্বের মতো মেলা চত্বরেও স্থাপনা কাঠামোয় সেই দূরত্ব বজায় রাখা হয়েছিল। মহামারিকালের ভয়াবহতা জ্ঞানে রেখে দূরত্ব বজায় রাখার সাথে সাথে পরিসরও বেড়েছিল আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। গ্রন্থঘরগুলোর গড়নে তেমন ভিন্নতা দেখা না গেলেও আয়োজকদের আয়োজনে কালের কথা সর্বাগ্রে যে ভাবা হয়েছিল, তা সুস্পষ্ট। এই গ্রন্থমেলায় করোনার সাবধানতায় প্রস্তুতি যেমন ছিল, তেমনি ছিলো ঋতুর বৈপরীত্যের বিপরীতে সাবধানতা। ছিল সাম্প্রদায়িক উৎপাত, তৎপরতা কঠোর নজরে রেখে কঠিন নিরাপত্তা। বিলম্বে মেলা শুরু হলেও গত বছরের তুলনায় কমতি ছিল না কিছুতে, বরং বৃদ্ধি ছিল অনেক কিছুতে। প্রবেশে আর বহির্গমনে আগতদের সুবিধার বিষয় চিন্তায় আনা হয়েছে, ভাবনায় আনা হয়েছে মেলা মাঠ বিচরণে দর্শনার্থীদের অন্যান্য সুযোগের বিষয়াদিও। গ্রন্থমেলায় একজন নাগরিক মেলা সংক্রান্ত যে যে সুবিধা প্রাপ্ত হবার কথা দৃশ্যত সে সে নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির উপকরণগুলো রাখা ছিল ক্রমে। কোথাও কেউ হোঁচট খাবে, সে বিচ্যুতি আপত দেখা যায়নি। ছিমছাম ছিল পাঠকবান্ধব গ্রন্থমেলা-২১।

মেলা নিয়ে যে দুর্ভাবনা ছিল, যে আশঙ্কা ছিল, যে উৎকণ্ঠা ছিল তার অবসান হয়েছিল সুচারুভাবে। যদিও প্রশ্ন আছে, জিজ্ঞাসা আছে। মত আছে, দ্বিমত আছে। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা আছে। সমালোচনাও আছে ঢের। কিন্তু বিপদসঙ্কুল এ সময়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২১ শুরু হয়েছিল, তা মোটেই চারটিখানি কথা নয়। অল্প সময়ে, অনেক সিদ্ধান্তের ভেতর থেকে একটি সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়া একেবারেই সহজ ছিল না; যখন সারা পৃথিবীর সব কিছু ফের সীমিত করা হচ্ছে, বন্ধ করা হচ্ছে। এখানেও নতুন করে সে ঢেউ লেগেছে। আবার আক্রান্ত হচ্ছে, শনাক্ত হচ্ছে, মৃত্যু ঘটছে কিন্তু তার মধ্যেই পূর্বের ঘোষণা মতো গ্রন্থমেলা উদ্বোধন। এ অবশ্যই সাহসের সিদ্ধান্ত এবং সাহসের বিষয় ছিল। সকলের না হোক, অধিকাংশের কাছে তা প্রশংসা কুড়িয়েছে।

পৃথিবী যখন পেছনের দিকে হাঁটছে, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে খানখান। উৎপাদন নেই, উদযাপন নেই, প্রচার নেই, প্রসার নেই। যোগাযোগের পথও স্থবির। যাপিত জীবনের পারস্পরিক লেনদেন, ইকোসিস্টেমিক প্রক্রিয়া অচল। মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। মন্দাভাবের প্রভাবে মানুষের খরচে ভাটি, আয়েও ভাটি। হিসাবের নিক্তিতে মানুষের চোখ কাটায় কাটায়। এর মধ্যে প্রকাশনা শিল্পের এ আগ্রহ, আয়োজন, বিনিয়োগ কতটুকু ফল দেবে? কেমন দর্শনার্থী ভিড় করবে মেলায়? এই অনলাইন জগৎ-সময়ে কেমন পাঠক আসবে সশরীরে, যেখানে পাঠক চাইলেই তার ঘরের দরজায় পৌঁছে যাচ্ছে বই? যে মিলন মেলার কথা বলছি, সে মিলন কি ঘটবে? দূর দূরান্ত থেকে উৎসাহিত বইপ্রেমী কি ছুটে আসবে মূল মাঠে? যদি না আসে, যদি কমতি হয়, কেমন ক্ষতি হবে? গত এক বছরের অলস সময়, অর্থনৈতিক, মানসিক চাপের মধ্যে কি এ চাপ আরও বাড়বে না! ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যাশায় কি হতাশা দেখা দেবে না! এবারের গ্রন্থমেলা কি পারবে এসব জটিলতার মীমাংসা করতে? বের হয়ে আসতে পারবে কি ধারণার ছক থেকে? সে ভিন্নতর পরিকল্পনা, পরিশ্রম, নকশা, মার্কেটিং কি ছিল প্রকাশন শিল্পের বা আয়োজন সমন্বয়ক বাংলা একাডেমির? নাকি নিয়ম মানার জন্য নিয়ম মানা, মেলা করতে হবে- নানান দিক বিবেচনা করে সে মেলা আয়োজন? এমন অনেক অনেক প্রশ্ন ছিল মেলার শুরু থেকে অঘোষিত শেষদিন (৪ এপ্রিল) পর্যন্ত। লেখক, প্রকাশক, পাঠক, দর্শনার্থীদের মাঝেও এ ভাবনা ছিল কম-বেশি।

অর্থনৈতিক হিসাবের দিক থেকেও চিন্তা ছিল। ২০২০সালে বাংলা একাডেমির তথ্য ও হিসাব মতে, বই বিক্রি হয়েছিল মোট ৮২ কোটি টাকার। ২০১৯ সালে মেলায়  ৮০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। ২০১৮তে বিক্রি হয়েছিল ৭০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে ৪২ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে বই বিক্রি হয়েছিল ২২ কোটি টাকা। ২০২০-এ নতুন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমিতে জমাকৃত বইয়ের হিসাবে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে বই প্রকাশিত হয়েছিল ৪ হাজার ৯১৯টি।

সে বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমাপনী দিনে জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে জানা যায়, সর্বোচ্চ বই প্রকাশ হয়েছিলো কবিতার বই ১ হাজার ৫৮৫টি। গল্পের বই ৬৪৪টি। উপন্যাস ৭৩১টি। প্রবন্ধের বই ২৭১টি। গবেষণা গ্রন্থ ১১২টি, ছড়ার বই ১১১টি, শিশুতোষ বই ২০৩টি। জীবনী গ্রন্থ ১৮৯টি। বরনাবলি ৮টি। মুক্তিযুদ্ধের বই ১৫২টি। নাটক রচনা ৩৪টি। বিজ্ঞান বিষয়ক বই ৮৩টি। ভ্রমণ কাহিনি ৮২টি। ইতিহাস ৯৬টি। রাজনীতি ১৩টি। স্বাস্থ্য ৩৬টি। রম্য ৪০টি। ধর্মীয় ২০টি। অনুবাদ ৫৭টি। অভিধান ১৪টি। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ৬৭টি। বঙ্গবন্ধুবিষয়ক ১৪৪টি। অন্যান্য বিষয়ে বই ২৬৮টি। (প্রকাশ: ইত্তেফাক, ০১:৫১. ০১ মার্চ, ২০২০)।

এই বছর, এই গ্রন্থমেলা কি এ হিসাব ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হবে? অর্থনীতির সাথে জড়িত এ প্রশ্নগুলো বড় হয়ে আওয়াজ করেছিল। প্রকাশ্যে অতটা না হলেও এই প্রশ্নগুলোই ছিল এ গ্রন্থমেলা-২১ এর বড় জিজ্ঞাসা। বড় চ্যালেঞ্জের আলাপ। তবু বলা হয়েছিলো, এ এক বিরাট বাজি। বিরাট ভার। টিকে থাকতে, টিকিয়ে রাখতে এ চাপ সইতে হবে। এ ভার নিতে হবে। পথ উৎরে যেতে পথকে আরও পলিশ করতে হবে। না হলে চ্যালেঞ্জে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা এড়ানো কঠিন। কালের পিচ্ছিল পথে পিছলে পড়ার মধ্যে পিছলে পড়লে ব্যথাটা যে বড় লাগবে। মেলা চলাকালীন সময়ে ভার্চুয়াল সুবিধাকে ব্যবহার করে পাঠকের হাতে হাতে দিতে হবে বই। পাঠকের চাহিদা মিটাতে হবে, প্রকাশকের ইনভেস্টও তুলতে হবে। তা না হলে ক্ষতিই হয়ে যাবে মূলে। যদিও অমর একুশে গ্রন্থমেলা লাভ-ক্ষতির হিসাবের সাথে মিলানো যাবে না কিন্তু না মিলিয়েও পারা যায় না। যেহেতু এর সাথে অর্থলগ্নির বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

অবশেষে বিপদ সামনে এসে দাঁড়াল। যেই শঙ্কা, সেই ঘটল। উদবোধনের দিনের সতর্কবার্তা ( করোনা বাড়তে থাকলে কঠিন সিদ্ধান্ত আসতে পারে) সত্য হলো। সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী- ফের ফিরে এসেছে লকডাউন, নিত্য প্রয়োজনীয় ও জরুরি সেবা ছাড়া আর সব বন্ধ কিন্তু গ্রন্থমেলা-২১ বন্ধ হলো না পুরোপুরি। বাংলা একাডেমির পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত মেলা চলবে প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। অদ্ভুত সিদ্ধান্ত! নৌ, সড়ক, রেল পথে কিছু চলবে না, অফিস আদালত সীমিত; দেশজুড়ে লকডাউন; তবে কী করে মানুষ পৌঁছবে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গনে! সব কিছু যখন বন্ধ, ঢাকা ছেড়ে যখন অনেক অনেক মানুষ ফিরে গেছে, যাচ্ছে যার যার নিরাপদ স্থানে, মানুষ যখন ঘরে ঢুকতে বাধ্য হচ্ছে, রিকশা বা ভ্যান থামিয়ে প্রশাসন জানতে চাচ্ছে- কোথায় যাচ্ছেন, অকারণে বাহিরে বের হলে শাসন করছে তখন মেলা বন্ধ ঘোষণা না করে সময় সীমিত করে মেলা খোলা রাখার কী মানে?

এমন সমালোচনা হচ্ছে লেখক-পাঠক-প্রকাশক মহলে। আলোচনা হচ্ছে, কার স্বার্থে, কী স্বার্থে, কী কারণে, কোন বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হলো! তার চেয়ে কি বন্ধ ঘোষণা ভালো ছিল না? মেলা চলবে, স্টল খুলবে কী করে? পাঠক আসবে কী করে? লেখক আসবে কী করে? প্রকাশক না হয় নিজস্ব বাহনে চড়ে আসলেন, স্টলের কর্মচারী বা স্বেচ্ছাসেবীরা আসবেন কী করে? ভূতুরে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আলাপ-আলোচনা তুঙ্গে। আক্ষরিক অর্থেই গ্রন্থমেলার শেষদিন রবিবার মেলাপ্রঙ্গণ ঘুরে সব পক্ষের কাছে শোনা গেল সেই আপেক্ষপই। মুখে মুখে শোনা গেল অবিবেচিত সিদ্ধান্তের হতাশার কথা। কারো মুখেই শেষ পর্যন্তের তেমন হাসি আর দেখা গেল না। ব্যক্তিগতভাবে তিনপক্ষের সাথেই বিস্তর আলাপে দেখা গেছে সেই ছাপ। বাকি যে দিনগুলো চালু থাকবে গ্রন্থমেলা সে দিনগুলোতে তারা কী করবেন, তা তারা জানেন না। দোটানায় তারা অস্থির। অনেককে দেখা গেছে স্টল একেবারে বন্ধ করতে, অনেককে দেখা গেছে মতের কাছে ঝুলে থাকতে। বড় বড় স্টল বা প্রকাশকদের মাঝে যেমন ক্ষোভ, তেমনি ছোট ছোট প্রকাশকদের মাথায় হাত। আবার অনেক স্টল পক্ষকে দেখা গেছে, সবকিছু গুছিয়ে শেষ বিদায় নিয়ে নিতে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের যারা আছেন তারা সোমবার থেকে লকডাউন কার্যকর হওয়ার কারণে নিজ শহরে রওনা দিয়েছেন শনি আর রবিবারেই। যারা আছেন তারা হয়তো চরম ভোগান্তি আর মনোকষ্ট আর অসহনীয় সহনশীলতা নিয়ে আসবেন আর যাবেন, আসতে হবে বলে, যেতে হবে বলে। কিন্তু এই কথোপকথন, এই আলাপ-আলোচনা, সমালোচনা, হতাশা, ভোগান্তি, নিরর্থকতা কি আয়োজন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হবে? কানে পৌঁছবে তাদের? তারা কি এর থেকে কোনো কিছু শিক্ষা নেবে? প্রস্তুতি নেবে? ০৫.০৪.২১ থেকে মেলার অবশিষ্ট দিন আরও প্রায় অর্ধ মাসে কী হবে, কী করা উচিত, কী করলে লেখক পাঠক বিশেষ করে প্রকাশক উপকৃত হবে তা কি ভাবা হবে? বাংলা একাডেমি বা সরকার কি এ বিষয়ে  নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে?

অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের মত, নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হোক। সময় বিবেচনা করা হোক, প্রকাশকদের ক্ষতির বিষয়টি আমলে আনা হোক। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সহায়তা করা হোক। এক মুঠোতে বা কিস্তিতে বা ভেঙে ভেঙে কিছুটা প্রণোদনা দিয়ে তাদের আগামী দিনগুলোতে টিকে থাকার পথ বাতলে দেয়া হোক। তার উপর আবার কালবৈশাখীর হানা শুরু হয়ে গেছে। এখন হয়তো দুয়েক দিন পরপরই মেঘ-বাদল-বৃষ্টি নামবে। মাঠে কাদা জমবে, পরিবেশ নষ্ট হবে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে মেলা মুখো আর সহজ নয়। এমতাবস্থায় সঠিক সিদ্ধান্তটি নির্বাচন করা কঠিন, তবু একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারলে ভালো। অন্তত বাকি ক্ষতিটুকু থেকে বাঁচা যাবে।    

যাই হোক, এখন ভেঙে পড়লে চলবে না। অর্থলগ্নি করে যারা মাঠে নেমেছিল, তাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। যদিও প্রশ্ন, কতবার ঘুরে দাঁড়াবো? তারপরও ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে হবে বারবার। যতক্ষণ না ঘুরে দাঁড়ানো যায়। হতাশ হলে চলবে না। নিরাশ হলে চলবে না। এপাড় ভাঙলে আরেক পাড়ে যেয়ে মাথা তুলতে হবে। এখন আরেক চ্যালেঞ্জ নিতে হবে অর্থলগ্নিকারীদের। মেলা ভেঙে গেছে তো কী হয়েছে, মহামারিকাল তো কী হয়েছে। অনলাইন সুযোগকে ব্যবহার করতে হবে পুরোপুরি। প্রকাশিত বই পাঠকের হাতের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। পাঠককে নানান পথ অবলম্বন করে জানাতে হবে বই সম্পর্কে। এই সময়টি অবশ্য প্রকাশক, লেখকদের একটি নতুন সতর্কবার্তা দিয়ে গেল যে, যেনতেন বই লিখলে আর প্রকাশ করলে চলবে না। ধান্ধাবাজি আর করা যাবে না। এই গ্রন্থমেলায় যদি ধীরে ধীরে পাঠক চিরতরে আসা কমিয়ে দেয়, পাঠক যদি অনলাইনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তখন কিন্তু মলাট আর পৃষ্ঠার চমকে বই বিক্রি করা যাবে না। ভালো বই, ভালো মানের বই নির্বাচন করতে হবে। তখন ভালো বই ছাড়া পাঠক অর্ডার করবে না। যার-তার বই নেবে না। তখন লেখকের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মীরা মুখলজ্জায়, সম্পর্কের খাতিরে বই কিনবে না। বিক্রিও হবে না। পাঠক তখন দেখে দেখে সময় নিয়ে বিবেচনা করে বই কিনবে, যে বইয়ে জ্ঞানের কিছু আছে, বোধের কিছু আছে, আনন্দের কিছু আছে। বস্তাপচা মাল চালিয়ে দেয়ার দিন ফুরবে। প্রকাশকদের সে কথা বিবেচনায় রেখে তাদেরও কারেকশন হতে হবে। লেখকদেরও বুঝতে হবে, কী লিখতে হবে, কী লিখলে পাঠক তা পড়বে। নতুন চ্যালেঞ্জে এগুতে হবে এখন।

গত বইমেলার আয়োজন সম্পর্কে জ্যেষ্ঠ কথাশিল্পী সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘এবারের মেলায় মানহীন প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে। এ ধরনের প্রকাশনা সংস্থাকে মেলা থেকে বাদ দিতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় স্টল বরাদ্ধ না দেয়ার বিষয়ে বাংলা একাডেমিকে কঠোর হতে হবে। মেলা যদি শুধু ভালো প্রকাশকদের নিয়ে হয়, তাহলে মেলার পরিবেশ এবং বইয়ের বিক্রি দুটোই ভালো হবে। প্রকাশনা নয়, এমন বিক্রেতারা যদি নেট ও পাইরেটেড বই এবং অননুমোদিত বিদেশি লেখকদের বই নিয়ে মেলায় আসে সেক্ষেত্রে প্রকৃত প্রকাশকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি পাঠকরাও প্রতারিত হয়। বিশাল পরিসরের মেলা করার চাইতে গোছানো ও নিয়মতান্ত্রিক মেলা করাটাই বাঞ্ছনীয়।’

আর প্রকাশক সমিতির সভাপতি ও সময় প্রকাশনের প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বলেছিলেন, ‘আয়তন, নকশা কিংবা সাজসজ্জার বিবেচনায় এবারের মেলাটি ছিল নান্দনিক। তবে এর মাঝে কিছু ত্রুটি ছিলো।’

দুই অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞজনের বলার বিষয়ের সুদিক কি এবার পেয়েছে পাঠক? এবার গ্রন্থমেলা কি ত্রুটিহীন সাজতে পেরেছে? গতবছরের অভিজ্ঞতা, আলোচনা বা সমালোচনাকে আমলে নিয়ে, মনজুরুল ইসলামের বলাকে কি এবার নজরে রেখেছে বাংলা একাডেমি, প্রকাশনা সমিতি? মনে হয় অতটা পরিবর্তন আসেনি এক্ষেত্রে। এবারও অনেক ত্রুটি চোখে পড়েছে। পাইরেসি, বিদেশি, মানহীন, গাইডবই, উগ্রবাদ বইয়ের ছোঁয়া ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন বেশ কিছু গ্রহণযোগ্য পোস্ট দেখেছি। এ দিকটিতেও নজর দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে আয়োজক পক্ষ ও প্রকাশক পক্ষকে সবার আগে হুমকিতে পড়তে হবে। লেখকদেরও পড়তে হবে। 

যে চ্যালেঞ্জকে কাঁধে নিয়ে এবার বাংলা একাডেমি ও প্রকাশনা শিল্প আর লেখকরা আশায় বুক বেঁধে মেলায় নেমেছিলেন, সে চ্যালেঞ্জে সওয়া হইলো না। চ্যালেঞ্জের সাথে পারা হলো না আর।  যতগুলো সন্দেহ, আশঙ্কা ও চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল তার কোনো একটিও পেরিয়ে যেতে পারল না গ্রন্থমেলা-২১। হিমশিম খেয়ে যদিও এগিয়ে চলছিল, মহামারির গতি তা থামিয়ে দিলো। যাত্রা ভঙ হলো। এখন হিসাব আসবে কত ক্ষতি হলো, কত চলে গেল আলো আর সাজ-সজ্জার পেছনে। প্রশ্ন আসবে কী লাভ হলো? কাঠখড় পুড়িয়ে যার যাত্রা, যে উদ্দেশ্যে সে উদ্দেশ্যও কি হাসিল হলো? মেধার বিকাশে কতটুকু দিতে পারলো গ্রন্থমেলা-২১? নাকি রান্নার বই আর মোটিভেশনাল বই বিক্রি হলো শেষতক বেশি? যাক, যার শুরু আছে, তার শেষও আছে। যার আশা আছে, তার নিরাশাও আছে। এবার না হয় তা-ই হলো। মাকড়শা থেকে শেখার কথা তো সারা জীবনই পড়া হলো, এবার না হয় দেখা হলো। এর থেকে নিশ্চয় সকল পক্ষ শিখবে, আগামী দিনের প্রস্তুতি নেবে ভিন্নভাবে। ভিন্ন রকম করে। প্রত্যাশা করি, আগমীবার এ বছরের তুলনায় আরও বেশি বই বিক্রি হবে। আরও বেশি পাঠক মেলায় আসবে। আরও বড় পরিসবে মেলার আয়োজন হবে। শুধু মেলা নয়, সারা বছর ধরে বইয়ের আয়োজন থাকবে, পাঠক বই সংগ্রহ ও পাঠ করবে; আগামী মেলায় গত বছরের  বিক্রি রেকর্ড ৮২ কোটি পেরিয়ে ১০০ কোটি কিংবা ১৫০ কোটি টাকার ঘর ছোঁবে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাকেও হার মানাক সে গ্রন্থমেলা। আরও প্রত্যাশা করি, এবার গ্রন্থমেলা-২১ যেভাবে আছড়ে পড়ল, এখান থেকে সামনের বছর উঠে  দাঁড়িয়ে সাজসজ্জা আর আয়োজনের পারঙ্গমতা নয় মেধার বিকাশে, মানবিক জাতি নির্মাণের লক্ষ্যে যে গ্রন্থ, যে গ্রন্থমেলা তার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ সার্থক হবে। এবার না-হয় না-হলো, সকল প্রতিকূলতাকে জয় করে সামনে বিজয়ী হবে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ সে আশা করতেই পারি। তবে শেষ মন্তব্যে, এই বছরের গ্রন্থমেলা-২১কে কি চ্যালেঞ্জের বিপরীতে হেরে যাওয়া বলবো নাকি বলবো, অনেক কিছু শেখার পূর্বপাঠ? আসলে পাঠকই বলতে পারবে কোনটি ঠিক।


লেখক: জোবায়ের মিলন
কবি, প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী
সহকারী প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh