চীন নীতিতে ভুল ছিলেন ট্রাম্প, বাইডেনও হাঁটছেন সে পথে

রাবেয়া আশরাফী পিংকি

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২১, ০৯:২৭ এএম

গত ১৮ মার্চ বাইডেন প্রশাসনের সাথে চীনের প্রথম আলোচনাতেই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়। ফাইল ছবি

গত ১৮ মার্চ বাইডেন প্রশাসনের সাথে চীনের প্রথম আলোচনাতেই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়। ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে গ্রহণ করা পররাষ্ট্রনীতির অনেক সিদ্ধান্তই ভুল ছিল। এর মধ্যে চীনের বিরুদ্ধে তার বিরোধপূর্ণ আচরণ সবচেয়ে বেশি কুরুচিপূর্ণ ছিল। বাণিজ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত করারোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। 

চীনও বসে ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রকে জবাব দিতে তারাও পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। দেশটির থেকে কৃষি পণ্য কেনা কমিয়ে দেয়, এতে করে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় মার্কিন কৃষকরা। কৃষকদের এ কঠিন সময়ে পাশে থাকতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে হাজার হাজার কোটি ডলার প্রণোদনা দিতে হয়েছিল। 

এছাড়া চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও কঠোর অবস্থানে থাকলেও, তা মূলত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কারণ ট্রাম্প এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করতে পারেনি। বহুপাক্ষিক জোট ট্রানস-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়ায় ট্রাম্পের হুমকিগুলো আরো গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল।

এমনকি যদি কখনো কেউ একমত হয় যে, কিছু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। তবে দেখা গিয়েছে ট্রাম্পের মনোভাব কেবলমাত্র বৈরিতা বৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনে বিনিয়োগ ও বিক্রি হ্রাসেই সফল হয়েছে। এটি দেশ দুটির সম্পর্কের বুনিয়াদ নয়, মৌলিক পরিমিতিগুলো পরিবর্তন করেছে। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি একইরকম রয়ে গিয়েছে (এটি খুব নেতিবাচক বিষয় নয়, তবে চীনবিরোধী নীতিতে এটিকে একটি বড় কারণ হিসেবে দেখে এসেছিলেন ট্রাম্প)। কলকারখানাগুলো এখনো দেশের বাইরে রয়েছে, চীনে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ হয়নি ও বিশ্বব্যাপী চীনের প্রভাব বেড়েই চলেছে। 

ধারণা করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করলে দেশটির পররাষ্ট্রনীতি অনেকটাই পরিবর্তিত হবে; কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট  জো বাইডেন তার পূর্বসূরির অনেক নীতিমালাই গ্রহণ করছেন। এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্টের অনেক মৌলিক ধ্যান-ধারণাও বাইডেনকে অনুসরণ করতে দেখা যাচ্ছে। যেমন- চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিরোধী দেশ ও অনেক বিষয়ে তাদের পারস্পরিক আগ্রহ ও সহযোগিতা থাকলেও চরম প্রতিযোগিতা দেশ দুটির সম্পর্ককে ক্রমে আরো উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলছে। ট্রাম্পের মেয়াদে এই ধারণাগুলো ভুল ছিল, যা এখন বাইডেন প্রশাসনেও দেখা যাচ্ছে। 

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বৈঠকটিও ছিল উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। বৈঠকে দুই দেশের কর্মকর্তাদের আচরণ নিয়ে বেশ মুখরোচক সংবাদ প্রকাশ হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ও চীনের শীর্ষ কূটনীতিবিদ ইয়াং জায়েসির বিতর্ক দু’দেশের সম্পর্কের চরম বৈরিতাকেই নির্দেশ করেছিল। 

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন বলেন, উইঘুরদের ওপর নির্যাতন থেকে শুরু করে হংকংয়ের গণতন্ত্রের ওপর চড়াও হওয়ার মতো চীনের বহুকার্যকলাপ ‘নীতিমালাভিত্তিক বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।’ চীনের ইয়াংও পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার নামে যুক্তরাষ্ট্রের জুলুম স্বাভাবিক বাণিজ্য বিনিময়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে ও কিছু দেশকে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ইন্ধন দিচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, এটি এক ধরনের ভণ্ডামি; চীনের মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা মানায় না, কারণ দেশটি নিজেই কালো ও এশিয়ান আমেরিকানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকে। 

বৈঠকের পুরো আলোচনায় নতুন ক্ষমতায় আসা বাইডেন প্রশাসন বারবার নিশ্চিত করেন চীন নিয়ে ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতিই তারা বজায় রাখবেন। আলোচনায় শত্রুতা বজায় রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়; সেখানে পরবর্তী দফায় বাণিজ্য চুক্তি অথবা চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যে আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি; বরং বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বমুহূর্তে হংকং ও শিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বেশ কয়েকজন চীনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। 

তবে বাইডেন প্রশাসনের জন্য একটি ভালো দিক হচ্ছে, তারা চীনবিরোধী অবস্থানের ক্ষেত্রে ব্যাপক জনসমর্থন পাচ্ছে। দেশটির সবার মধ্যে এই ধারণাটি রয়েছে যে, চীন একটি উদীয়মান প্রতিপক্ষ, যারা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অবস্থানের জন্য হুমকিস্বরূপ। 

সম্প্রতি এক গ্যালপ জরিপে দেখা গিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই চীনকে তাদের শত্রু  বলে মনে করে, আর এই হার গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। এছাড়া দেশটির সিংহভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চীন অর্থনৈতিক হুমকিস্বরূপ। অন্যদিকে চীনেও একই পরিস্থিতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন পোস্ট ও অন্যান্য উপায়ে সংগৃহীত মতামতের মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায়, চীনা নাগরিকরাও যুক্তরাষ্ট্রকে একই ধরনের শত্রুর চোখে দেখছে। 

তবে সর্বোপরি বিষয়টি এমন হওয়া উচিত নয় যে, জনগণ যেভাবে চীনকে শত্রু  হিসেবে ভাবছে, ঠিক সেভাবেই দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করতে হবে। পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে জনমত মূলত বিভাজিত ও পরিবর্তনশীল হয়ে থাকে। মূলত কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম কীভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করছে, তার ওপর নির্ভর করেও জনমত প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৯ সালে বেশিরভাগ আমেরিকান বিশ্বাস করতো যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবধানই তাদের দেশকে বিধ্বস্ত করেছিল; মূলত সে সময় এ কথাটি তারা বারবার শুনতো। ফলে তাদের মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিছুটা বেশি হলেও একটি বৈধ আশঙ্কা ছিল যে, কমিউনিস্ট দেশগুলো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করলে যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বর্তমানে একটি অভ্যন্তরীণ আদর্শের সঙ্গে উদীয়মান শক্তি নিয়ে একটি সামন্তরাল ভয়ও কাজ করছে। বলা হচ্ছে, চীন একটি পুঁজিবাদী স্বৈরাচারী দেশ- যাদের কমিউনিজমের বিশেষ রূপ বিশ্বায়নে বিশ্বাসী নয়। যদিও এর স্থানীয় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে সমৃদ্ধ করেছে। মেধাসম্পদ চুরি নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিযোগ থাকলেও, বর্তমানে চীনের কোম্পানিগুলোর নিজস্ব ফাইভজি নেটওয়ার্ক ও কৃত্রিম মেধাসম্পদ রয়েছে। চীনের এই উত্থান যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই জাপান, থাইল্যান্ড ও জার্মানির মতো উন্নত দেশগুলোর জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।

এদিকে চীনকে অনেক দেশই গভীর হুমকি হিসেবে দেখলেও, ট্রাম্প ও বর্তমানের বাইডেন প্রশাসন যে ধরনের কৌশল নিয়েছে, তাতে করে কিন্তু বেইজিংকে তাদের আচরণ পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারছে না। শিনজিয়াং ও বেইজিংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জেরে কয়েকডজন চীনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কোনো পরিবর্তনই আনতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর শুল্ক পর্যাপ্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারলেও তারও পাল্টা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। 

এদিকে অভ্যন্তরীণভাবে জনপ্রিয় আগ্রাসী মনোভাব অব্যাহত রাখার ফলাফল হিসেবে বাইডেন প্রশাসন মহামারি পরবর্তী বিশ্বে সম্পূর্ণ নতুন প্রতিযোগীর জন্য বাস্তবমুখী কৌশল গ্রহণের সুযোগ পাবেন। চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব বজায় রাখা ভালো অভ্যন্তরীণ রাজনীতি হতে পারে; কিন্তু লক্ষ্য যদি মার্কিন অর্থনৈতিক শক্তি ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে এটি অবশ্যই একটি বাজে নীতি হবে। 

ট্রাম্প প্রশাসন এসব লক্ষ্যের একটিও পূরণ করতে পারেননি; ফলে বাইডেন প্রশাসন যত তাড়াতাড়ি নতুন কৌশল গ্রহণ করবেন তাতই মঙ্গল।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh