পশ্চিমা দুনিয়ায় নারীর অধিকার

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২১, ০৯:২৭ এএম | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২১, ০৯:২৯ এএম

গত বছরের আগস্টে ইস্তাম্বুল কনভেনশনের সমর্থনে তুরস্ক জুড়ে বিক্ষোভ হয়। ফাইল ছবি

গত বছরের আগস্টে ইস্তাম্বুল কনভেনশনের সমর্থনে তুরস্ক জুড়ে বিক্ষোভ হয়। ফাইল ছবি

গত ২০ মার্চ তুরস্ক নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গঠিত ‘কাউন্সিল অব ইউরোপ কনভেনশন’ থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। 

‘ইস্তাম্বুল কনভেনশন’ নামে পরিচিত এই চুক্তিতে ২০১১ সালে ৪৫টি দেশ স্বাক্ষর করলেও এখন পর্যন্ত ৩৪টি দেশের পার্লামেন্টে এই চুক্তি আইন হিসেবে পাস হয়েছে; বাকি দেশগুলো আইন পাস করেনি। এসব দেশের মধ্যে ব্রিটেন, ইউক্রেন, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি রয়েছে। ২০১১ সালে তুর্কি পার্লামেন্টে আইন হিসেবে এ চুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অথচ ২০১২ সালের জুনে স্বাক্ষর করলেও ব্রিটেন এখনো তা করেনি। 

তুর্কি সরকার বলছে, এই আইন পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করাকে উৎসাহিত করা ছাড়াও পারিবারিক সহিংসতা ও বিবাহবিচ্ছেদ বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়াও তুরস্কের সমকামী গোষ্ঠীগুলো এই আইনকে ব্যবহার করে সমাজে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে বলে দেশটির সরকার অভিযোগ করছে। 

তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে এক টুইটার বার্তায় বলেন, তুরস্কের পারিবারিক বন্ধনের পুরনো ঐতিহ্যের মাধ্যমেই নারীর সম্মান নিশ্চিত করা সম্ভব; এর জন্যে বাইরের কাউকে নকল করার দরকার নেই। 

কাউন্সিল অব ইউরোপের হিউম্যান রাইটস কমিশনার দুনিয়া মিয়াতোভিচ এর প্রত্যুত্তরে বলেন, এতে নারী অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তুরস্কে নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার এমন এক সময়ে তাদের উচিত হবে না কনভেনশন থেকে নাম প্রত্যাহার করা; কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে নারীর অধিকার আজকে কতটুকু?

ওশেনিয়া অঞ্চলের উন্নত দেশ অস্ট্রেলিয়া থেকে নারী নির্যাতনের খবর আসছে। ২২ মার্চ দেশটির টেন নেটওয়ার্কের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা গত দুই বছর ধরে দেশটির পার্লামেন্ট অফিসের ভেতর বিভিন্ন যৌনাচারের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করে আসছিল। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থার অংশ হিসেবে পরদিন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ঘোষণা দেন, সেই ব্যক্তিদের বরখাস্ত করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা ব্লুমবার্গ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগেই অস্ট্রেলিয়াজুড়ে হাজারো নারী যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। এছাড়াও মরিসন সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল ক্রিশ্চিয়ান পোর্টারের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সরকার এই অভিযোগের তদন্ত করতে অস্বীকৃত জানানোয় অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। 

গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের একজন উচ্চপদস্থ উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে- তিনি ২০১৯ সালে পার্লামেন্ট ভবনের ভেতর ব্রিটানি হিগিন্স নামের এক জুনিয়র নারী উপদেষ্টাকে ধর্ষণ করেছেন। সে সময় পার্লামেন্টে প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডসের অফিসে কাজ করা ব্রিটানি হিগিন্সকে বলা হয় তিনি যেন পুলিশের কাছে অভিযোগ না করেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস তার অধীনস্ত সেই নারী কর্মকর্তাকে মিথ্যুক আখ্যা দিয়ে আইনি সমস্যায় পড়েন। পরবর্তীকালে তিনি অবশ্য হিগিন্সের কাছে ক্ষমা চান ও তার বিরুদ্ধে আইনি অভিযোগের ব্যাপার গোপনে আর্থিকভাবে দফারফা করেন। 

শুধু তা-ই নয়, হিগিন্সকে ধর্ষণের পরের বছর সেই একই ব্যক্তি বেসরকারি সেক্টরে কাজ করার সময় আরেকজন নারীকে যৌন নিপীড়ন করার অভিযোগ উঠেছে। রাতে একসঙ্গে ডিনার করে নিপীড়নকারীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান; যেখানে সেই ঘটনা ঘটে বলে জানান সেই নারী। এ প্রসঙ্গে স্কট মরিসন বলছেন, অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের সংস্কৃতিতেই ব্যাপক সমস্যা রয়েছে।

আটলান্টিকের ওপাড়ে ব্রাজিলের দ্বিতীয় ডিভিশনের ফুটবল ক্লাব ‘সামপাইও করেয়া’র একটা বিজ্ঞাপন সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে দেশটির মারানিয়াও প্রদেশের ভোক্তা অধিকার সংস্থা। ২৪ মার্চ রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজ্ঞাপনটিতে একজন স্বল্প বসনা নারীর ছবির সঙ্গে ওয়েসিস মোটেলের একটি অফারের কথা বলা হয়। এতে বলা হয় যে, ফুটবল ক্লাবের সমর্থকরা মোটেলে ১২ শতাংশ ডিসকাউন্টে ‘গোল করতে পারেন’ বা নারীসঙ্গ পেতে পারেন। বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মাঝেই ভোক্তা অধিকার সংস্থা এটিকে সরিয়ে বিকল্প বিজ্ঞাপন প্রকাশের নির্দেশ দেয়। একইসঙ্গে তারা জানায়, নারীদের ‘পণ্য সমতুল্য’ করার জন্য তাদের আদালতের সামনে হাজির করে ব্যাখ্যা দিতে বলা হবে। তবে ক্লাবটি ১১ ঘণ্টার মাঝে বিজ্ঞাপনটি না সরিয়ে বরং আরেকটা ছবি পোস্ট করে, যেখানে লেখা ছিল যে, ‘একজন মহিলা সেখানেই থাকতে পারেন, যেখানে তিনি থাকতে চান’। 

প্রকৃতপক্ষে এই দ্বন্দ্ব বিজ্ঞাপনের ভাষা নিয়ে। কারণ একদিকে ওয়েসিস মোটেলে নারীসঙ্গ বেচা-বিক্রি ব্রাজিলে যেমন অবৈধ নয়, তেমনি স্বল্পবসনা নারীদের ছবি বিজ্ঞাপনে ব্যবহারেও নিষেধ নেই। ব্রাজিলে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত কার্নিভাল অনুষ্ঠানে এর চেয়ে আরো কম কাপড়ে প্রায় নগ্ন অবস্থায় নারীদের ‘সাম্বা’ নৃত্য করতে দেখা যায় রাজধানী শহরের রাস্তায়; যা উপভোগ করে ছেলে বুড়ো শিশু সবাই ও মূলত পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আসা বহু পর্যটক। এই অনুষ্ঠান ব্রাজিলের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব রাখে। 

‘সামপাইও করেয়া’র বিজ্ঞাপনে যে নারীর ছবি ব্যবহার করা হয়, তিনি মূলত ২০১৫ সালে ক্লাবের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। প্রতিযোগিতার নিয়ম হিসেবেই সেই নারীকে স্বল্পবসনা হয়ে ছবি তুলতে হয়েছিল। ক্লাব সেই ছবিকে পুঁজি করেই ব্যবসা চালাচ্ছে। ব্রাজিলে ফুটবল ক্লাব ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থার এহেন সুন্দরী প্রতিযোগিতা চলে সারাবছর জুড়ে; যেখানে নারীদের অতিরিক্ত স্বল্পবসনা হয়ে সবার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়। এর মাধ্যমে নারীরা অর্থ উপার্জন করে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু অনুসারী পায়। অনেক প্রতিযোগিতার বিজয়ীরা পুরুষদের ম্যাগাজিনে নগ্ন হয়ে মডেলিং করার ‘সুযোগ’ পায়। নারীদের সৌন্দর্যবর্ধনকে কেন্দ্র করে ব্রাজিলে বিশাল অর্থনৈতিক কার্মকাণ্ডও চলে। এতকিছুর পরও সে দেশের বিজ্ঞাপনে নারীদের ‘পণ্য সমতুল্য’ করার জন্যে যে ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করার হয়েছে, তা অন্তঃসারশূন্যই বটে। 

দেশের সর্বোচ্চ অফিসে কাজ করাও যে নারী নির্যাতন বন্ধের জন্য যথেষ্ট নয়, তা অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের ঘটনাই বলছে। আর ব্রাজিলের ঘটনা দেখিয়ে দেয় নারীকে ‘পণ্য সমতুল্য’ করার সংস্কৃতিকে। পশ্চিমা চিন্তায় নারীর অধিকার কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকেই মূল্যায়িত হয়েছে। নারীর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাই হয়েছে সব কিছুর মাপকাঠি। আইন তৈরির সংস্থা থেকে শুরু করে ফুটবল ক্লাব পর্যন্ত কেউই নারীর সম্মান ও নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়নি। 

একুশ শতকেও তাই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে, পশ্চিমা দুনিয়ায় নারীর প্রকৃত সম্মান আদৌ কোনোকালে প্রতিষ্ঠিত হবে কি-না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh