স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৩৫ এএম
মিয়ানমারে প্রতি বছর ২৭ মার্চ দিনটি ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। গত ২৭ মার্চও বরাবরের মতোই জমকালো আয়োজনে দিবসটি উদযাপন করা হয়।
এদিন রাজধানী নেপিদোতে যখন বর্ণাঢ্য বার্ষিক কুচকাওয়াজ চলছিল, তখন ইয়াঙ্গুনসহ অন্যান্য শহরে চলছিল সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ। সামরিক বাহিনী অন্তত ১১৪ জন গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে।
উল্লেখ্য, এ বছর অনেক দেশই কুচকাওয়াজের ওই রাষ্ট্রীয় আয়োজনে প্রতিনিধি পাঠায়নি। মাত্র আটটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা হাজির হন ওই জমকালো অনুষ্ঠানে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে রয়েছে- রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, লাওস ও থাইল্যান্ড। রাশিয়া বাদে বাকি সাতটি দেশের প্রতিনিধিই ছিলেন সামরিক অ্যাটাশে। সাধারণত প্রতি বছর এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিদেশি রাষ্ট্রসমূহ তাদের সামরিক অ্যাটাশে পাঠিয়ে থাকে; কিন্তু এ বছর সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ এই আয়োজনে যোগ দেয়নি।
১৯৪৫ সালে মিয়ানমারে জাপানি উপনিবেশের বিরুদ্ধে দেশটির সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহের ঘটনার স্মরণে পালন করা হয় দিনটিকে। কভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ সালে কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছিল। তবে এবার বিক্ষোভরত জনগণকে সামরিক বাহিনীর শক্তি দেখানোর দরকার পড়েছে। এটি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। আর এতে এগিয়ে থাকতে কুচকাওয়াজটি সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়।
এ মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে ভীতি প্রদর্শনের বিকল্প নেই। যে ভীতির ফলে রোহিঙ্গারা তাদের নিজ ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে; তেমনই ত্রাসের খেলায় মেতে ওঠে সামরিক বাহিনী। গত ২৭ মার্চ একদিনেই নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নারী ও শিশুসহ ১১৪ জন মানুষ নিহত হয়েছেন ও ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত চার শতাধিক আন্দোলনকারী নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছেন।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ চালানোর মানসিকতা নতুন করে গড়ে ওঠেনি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ‘তাতমাদাও’ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগে ফ্যাসিবাদী চেতনা ধারণ করা জাপানি সামরিকবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এটি গড়ে ওঠে। রোহিঙ্গা গণহত্যার খবর সমসাময়িক ও বহুল প্রচারিত বলে, এর মধ্য দিয়েই মিয়ানমার রাষ্ট্রের গণবিরোধী, অমানবিক রূপটা বেশি দেখা যায়। অথচ অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তার প্রতিও মিয়ানমার রাষ্ট্র ও সেখানকার সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন কোনো অংশে কম ছিল না। বিদ্রোহ দমনের নামে একের পর এক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবিরাম সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার রেকর্ড শুধু মিয়ানমার আর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীরই রয়েছে। যেখানে সচেতনভাবেই বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে এ বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে তিন হাজার করা হয়। ওই বছরই ‘তাতমাদাও’ কমিউনিস্ট ও কারেন বিদ্রোহীদের দমনে নৃশংস অভিযান চালাতে শুরু করে।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মিয়ানমার বাহিনীর সামরিক অভিযানের ক্ষেত্র প্রশস্ত হয় কেন্দ্র থেকে সীমান্ত এলাকার পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা অঞ্চলগুলোতে। সেখানে বসবাসকারী শান, কারেন, কাচিন ও রাখাইন জাতিসত্তার মানুষ যখন কেন্দ্রের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান, তখন মিয়ানমার বাহিনী চালাতে শুরু করে ভয়ংকর আগ্রাসন। এখানে কোনোকালেই মানবাধিকারের প্রশ্ন আমলে নেয়া হয়নি। উচ্ছেদ অভিযান যেন একটি নিয়মিত ঘটনা!
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে যে সংবিধান পাস করা হয়েছিল সে অনুযায়ী, দেশটির আইনসভার ২৫ শতাংশ আসন ও প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সামরিক বাহিনীর হাতে রাখা হয়। কোনো দল সংবিধান পরিবর্তন করতে চাইলে তাদের ৭৫ শতাংশ আসন পেতে হবে। অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর ২৫ শতাংশ বাদ দিলে বেসামরিক সব আসনে না জিততে পারলে কোনো দলের পক্ষে সংবিধান পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এর মানে হলো- মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গত দশ বছরে গণতন্ত্রের নামে দেশটির রাজনীতির কোনো মৌলিক উন্নয়নের সুযোগ দেয়নি। অন্যদিকে, মিয়ানমারে কথিত এই গণতন্ত্রের সময়কালেই বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকটের সৃষ্টি করা হয়েছে। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোসহ ১১ লক্ষাধিক মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে একুশ শতকের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরের মানবেতর জীবনের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয়সহ নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের কথিত ‘গণতন্ত্রের প্রতীক’ নেতা অং সান সুচিও এই ভয়াবহতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অংশীদার হয়েছেন নীরবে। আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জেনারেলরা কথিত ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থায়ই পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পেয়ে আসছেন। ওই জেনারেলদের পক্ষে আন্তর্জাতিক আদালতে সাফাই গেয়েছেন সুচি। এসবই প্রমাণ করে- মিয়ানমার আসলে গত এক দশকে গণতন্ত্রায়নের পথে মোটেও এগোয়নি। সু চিকে সামনে রেখে যে বেসামরিক নেতৃত্ব প্রদর্শিত হচ্ছিল গত এক দশক ধরে, তা মূলত সামরিক বাহিনীর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন গণতন্ত্রের একটি ছায়া। ১০ বছর এমন একটি গণতন্ত্রের প্রদর্শনী করে এবার ফের আসল রূপে ফিরে গেল মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।
তবে এবার সামরিক আগ্রাসনই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে।
সেই সঙ্গে এবারের আন্দোলনে অগ্রসর ভূমিকা ছিল নারীদের। জান্তাবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখা জেনারেল স্ট্রাইক কমিটি অব ন্যাশনালিটিজ নামে একটি সংগঠনের নেতা ন। তিনি জানান, এক বছর বয়সী কন্যার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন। কন্যার জন্য রেখে যেতে চান একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ।
ন বলেন, ‘আমি মিয়ানমারের সংখ্যালঘু কারেন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। কাজেই এ রকম বিক্ষোভ আমার কাছে নতুন কিছু নয়। আজ বিক্ষোভকারীরা স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের মুক্তি এবং ২০২০ সালের ভোটের ফল বহাল করার দাবি জানাচ্ছে; কিন্তু আমরা যারা সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ, আমাদের দাবিগুলো আরো গভীর। আমরা এমন এক ফেডারেল গণতান্ত্রিক দেশ চাই, যেখানে মিয়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জায়গা হবে। সামরিক বাহিনী বছরের পর বছর ধরেই মিয়ানমারের মানুষকে বিভক্ত করে শাসনের কৌশল চালিয়ে গেছে; কিন্তু এখন আমরা সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এক হয়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের জীবনেই এই বিপ্লব শেষ করে যাব। আমাদের সন্তানদের জন্য এই কাজ ফেলে রাখব না।’
উপরোক্ত বক্তব্যে ন খুব পরিষ্কার কথাতেই চলমান আন্দোলনের দিক-নির্দেশ দিয়েছেন। বিদেশনির্ভর আন্দোলন যে সফলতা পারে না, সেটিও নিশ্চিত করেই বলে দেয়া যায়। আর যদি এ গণতন্ত্রের লড়াইয়ে আবারও বিভক্তি আসে, তবে সেটি নিশ্চিতভাবেই সামরিক বাহিনীকে আরো দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকে থাকার রসদ জোগাবে।