দিনাজপুর শহরে বাহুল্য ইজিবাইক ও যানজট সমস্যা

মাহবুব আলী, প্রভাষক, দিনাজপুর

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২১, ১০:০৪ এএম

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

দেশের অন্যান্য এলাকার মতো দিনাজপুর শহরেও ব্যাটারিচার্জার রিকশা বা ইজিবাইকের নিয়ন্ত্রণহীন সংখ্যাধিক্যে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভোর-সকাল থেকে রাত নয়-দশ, এমনকি এগারোটা পর্যন্ত চলে চিৎকার-হট্টগোল-শব্দদূষণ-যানজট।

এই সমস্যা নিয়ে বিস্তর লেখা হলেও কোনোরূপ সমাধান বা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। 

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুসারে জানা যায়, শহরে প্রায় দশ হাজার ব্যাটারিচার্জার রিকশা বা ইজিবাইক চলাচল করে। শহর বা পৌরসভার অন্তর্গত রিকশার সঙ্গে শহরতলি ও অল্প ও দূরের এলাকা থেকে আগত কয়েক হাজার রিকশা যোগ হয়ে যানজট ও দুর্ভোগ পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলছে।

দিনাজপুর সদরে পাকা সড়ক ও রাস্তা ১২৫ কিলোমিটার। এসব রাস্তা দিয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করে থাকে, যার মধ্যে ভারী ও হালকা সবই আছে। রাস্তাগুলোর আকার দৈর্ঘে-প্রস্থে উপযুক্ত পরিসরের নয়। বর্তমানে বেশিরভাগ রাস্তার পিচ কার্পেট উঠে গেছে, খানাখন্দকে পরিপূর্ণ ও বিপজ্জনক। শহরের ব্যস্ততম রাস্তার এলাকা হলো স্টেশন থেকে দক্ষিণে সুইহারি, বাস টার্মিনাল এবং হাজী দানেশ কৃষি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। এদিকে শহরের প্রাণকেন্দ্র গণেশতলা থেকে মুনশিপাড়া-নিমতলা-মালদহপট্টি হয়ে রেলবাজার ও নিমনগর-বালুবাড়ি হয়ে একেবারে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এমনকি কাশিপুর পর্যন্ত রাস্তা সবসময় প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকে। শহরের এখানে-সেখানে চা-স্টল, চটপটি-চানাচুর-ফুচকার দোকান, ভ্রাম্যমান ও অস্থায়ী ফেরিঅলা, দোকানদার কর্তৃক ফুটপাত দখল করে বারান্দা এগিয়ে নেয়ার বিবিধ সমস্যার মধ্যে মাথাভার হয়ে আছে রাস্তার দৈন্যদশা। 

অতিসম্প্রতি শহরের দু-একটি রাস্তায় কার্পেটিং করা হয়েছে, কিন্তু ফুটপাত দখলমুক্ত বা উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেই। এই সমস্যা অতি জটিল ও ভয়ংকর হয়ে আছে জেলরোডে অবস্থিত জেলা কারাগার মার্কেট এলাকা ও বাহাদুরবাজার হয়ে স্টেশন পর্যন্ত। পৌরসভা নির্বাচন শেষে পরিস্থিতির উন্নতি না হয়ে বরং এরমধ্যে শুরু হয়েছে ফুটপাত ‘ইজারা বা দখলিসত্ব বন্টন’ ব্যবসা। সুতরাং ব্যাটারিচার্জার রিকশার আধিক্য ও এসবের ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের সীমাহীন অপতৎপরতা জনসাধারণের জন্য শুধু দুর্ভোগ নয়, নরক যন্ত্রণাসম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এসব ব্যাটারিচার্জার রিকশা বা ইজিবাইক অটোরিকশা চালকরা দশ-বারো বছরের কিশোর থেকে পচাত্তর বছর বয়সি। এদের কে লাইসেন্স দেয় বলা মুশকিল। বস্তুত ইজিবাইক অটোরিকশার লাইসেন্স রাখার নিয়ম আছে, কিন্তু চালকের প্রয়োজন নেই। অতিসম্প্রতি চালকের লাইসেন্স থাকতে হবে কথা শোনা যাচ্ছে। এদের বেশিরভাগেরই যানবাহন চালানোর নিয়মকানুন জানা নেই, জানা থাকলেও নেই বিধিবিধান অনুসরণ করার পরিমিত তাগিদ। ফলে কে কাকে ওভারট্র্যাক করে সামনে এগিয়ে যাবে এই প্রতিযোগিতা চলে সারাদিন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাফিক কর্তৃপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করতে অহেতুক ও বেশি শ্রম ব্যয় করতে হয়। 

দিনাজপুর শহরের অবস্থা ঘিঞ্জি বললে অত্যুক্তি হয় না। বিগত কয়েক বছর ধরে চলছে আবাসিক এলাকাগুলোকে ভেঙেচুরে গুড়িয়ে সুপারমার্কেট বা শপিংমল নির্মাণের হিড়িক। ফলে সংকীর্ণ পরিসর রাস্তার উপরেই দিনের পর দিন পড়ে থাকে বাঁশ-রড-ইট-সুরকি-পাথর ইত্যাদি নির্মাণ সামগ্রি। সুতরাং রাস্তায় বাহুল্য ইজিবাইক বা অটোরিকশার সমস্যাটি আরো জটিল আকার নিয়েছে। ইজিবাইক চালকদের আচার-আচরণ চালকসুলভ না থেকে হয়েছে প্রতিযোগিতামুখী। যার কারণে ইজিবাইকের যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা, একে অপরকে টেক্কা দিয়ে অভারট্র্যাক, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, বচসা ও হাতাহাতি ঘটে চলেছে। 

এখানে উল্লেখ্য যে, দিনাজপুর শহরে রিকশাস্ট্যান্ড বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। রাস্তার যেখানে-সেখানে আবর্জনার স্তূপ পড়ে থাকার মতো ইজিবাইক অটোরিকশাগুলো দাঁড়িয়ে থেকে অন্যান্য যানবাহন চলাচলের যেমন বিঘ্ন ঘটিয়ে চলেছে, তেমন পথচারিদের জন্য বিবিধ অসুবিধা ও বিড়ম্বনার কারণ।

ব্যাটারিচার্জার অটোরিকশা বা ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের অবিলম্বে প্রায়োগিক পদক্ষেপ নেয়া উচিত। শহর ইজিবাইকে শুধু পরিপূর্ণ নয়, অতিরিক্ত হওয়ার পরও কয়েকটি নির্দিষ্ট দোকান ইজিবাইক সহজ কিস্তিতে বিক্রয় করে চলেছে। কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাও অল্প সার্ভিস চার্জে ইজিবাইক সরবরাহ করছে। বর্তমানে এমন অবস্থা হয়েছে যে, একজন মালিকের আট-দশটি ইজিবাইক ও তিনি বেকার চালকদের কাছে দিনভাড়ায় রাস্তায় ছেড়ে দিচ্ছেন। 

ইজিবাইকের লাইসেন্সের সঙ্গে সঙ্গে চালকের লাইসেন্স দেয়ার নিয়ম করা দরকার। সেজন্য বিআরটিএ’র নিয়মকানুন অনুসরণ করা যেতে পারে। যারা শহরে অতিরিক্ত ইজিবাইক সরবরাহ করছেন, সে সকল প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মালিকের নিকট থেকে কৈফিয়ত তলব ও কেন পরিবেশ বিনষ্ট করা হচ্ছে সে সম্পর্কে কারণদর্শানো যেতে পারে। নতুন করে ইজিবাইক বিক্রয় নিষিদ্ধ করা দরকার। পুরোনো ইজিবাইক স্ক্র্যাপ বা ধ্বংস করতে হবে। চালকের বয়স অবশ্যই সুনির্দিষ্ট করতে হবে ও যিনি লাইসেন্স পাবেন, তিনিই শুধু নির্দিষ্ট যানবাহন চালানোর অনুমতি রাখেন। যে-সকল চালক ইতোমধ্যে ইজিবাইক চালিয়ে রুটিরুজির কাজে নিয়োজিত তাদের হাতেকলমে কার্যকর মানবিক ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেয়া হোক। শহরের রাস্তা বা মোড়ের নির্দিষ্ট জায়গায় ইজিবাইক স্ট্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা হোক। ইজিবাইকের ভাড়া কিলোমিটার প্রতি সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। 

বস্তুত মানুষের জীবনযাপনের গতিময়তার ক্ষেত্রে ইজিবাইক ফেলে দেয়ার মতো নয়, একে নিয়ন্ত্রণ করে, প্রয়োজনীয় ও সীমিত সংখ্যায় রেখে, নিয়মকানুনের মাধ্যমে পরিচালনা করা গেলে রাস্তায় যানজট ও বিবিধ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh