আক্ষেপ আর হতাশার বইমেলা

মাহমুদ সালেহীন খান

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২১, ০৩:৫৯ পিএম

ছবি: স্টার মেইল

ছবি: স্টার মেইল

আবহাওয়ার কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই কালবৈশাখী আর লকডাউনের ফলে বইমেলায় পাঠকের ভিড় অনেক কমে গেছে। যদিও বইমেলাকে লকডাউনমুক্ত রাখা হয়েছে। 

দ্বিতীয় দফা লকডাউনের প্রথম দিন অর্থাৎ ১৯তম দিন ৫ এপ্রিল একাডেমির একুশে গ্রন্থমেলায় ছিল পুরো নিষেধাজ্ঞার প্রভাব। কোনো ভিড় ছিল না। ভুতুড়ে পরিবেশে এ দিন অলস সময় কাটিয়েছেন স্টলগুলোর বিক্রেতারা। 

সরেজমিনে কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আক্ষেপ আর হতাশার সুর। তাদের অনেকেই বইমেলা বন্ধেরও দাবি জানান। 

স্টলে যতজন বিক্রয়কর্মী ছিলেন মেলায় আগতদের সংখ্যা ছিল এর অর্ধেকের চেয়েও কম। লকডাউনের প্রথম দিন মেলায় প্রবেশদ্বারে দায়িত্বরতরা গেট খোলা থেকে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অলস সময় কাটিয়েছেন। জনমানবহীন মেলায় ছিল ভুতুড়ে পরিবেশ। অন্যদিন বইপ্রেমীদের পরিবর্তে দর্শনার্থী দেখা গেলেও এ দিন দর্শনার্থীও ছিল হাতে গোনা কয়েকজন। এই পরিবেশে মেলায় প্রকাশক, বিক্রয়কর্মী ও গণমাধ্যমের দখলে ছিল মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণ। 

প্রকাশকদের বেশিরভাগই এখন মেলার চালু রাখার বিপক্ষে। মেলা চালু রেখে প্রকাশকদের আরো বেশি ক্ষতি হচ্ছে বলেও মনে করেন বেশিরভাগ প্রকাশক। প্রকাশকদের বেশিরভাগই বলেন, স্টল ও প্যাভিলিয়নের ভাড়া ফেরত দিতে হবে বলে এই লকডাউনেও তারা মেলা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলা একাডেমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মেলা বন্ধ ও সচল রাখার বিষয়ে একাডেমি কর্তৃপক্ষের কোনো হাত নেই। সরকারের উচ্চ মহল থেকে যে নির্দেশনা আসছে, তারা শুধু সেই নির্দেশনাই বাস্তবায়ন করছেন।

এবারের বইমেলাতেও সংখ্যায় কম হলেও বেশ কিছু নতুন বই প্রকাশ হয়েছে। সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে যত বই বেরিয়েছে তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি রয়েছে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত।

নতুন বই  

করোনাভাইরাস নিয়ে এবারের মেলায় প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু বই। করোনা রোগের পরিচিতি ও প্রতিকারবিষয়ক বই যেমন আছে, তেমনি আছে কারোনাকালে সৃষ্ট সাহিত্য ও করোনার অভিঘাত নিয়ে বই। ড. জাহাঙ্গীর আলমের ‘কৃষি খাতে করোনার অভিঘাত’ প্রকাশ করেছে পালক পাবলিশার্স। আবুল বাসার অনূদিত ড. মাইকেল মোসলির ‘কোভিড-১৯ : করোনাভাইরাস’ বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা। সৌমেন সাহার ‘কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোগের ইতিহাস’ ও সৌমিত্র চক্রবর্তীর ‘করোনা বৃত্তান্ত’ এনেছে অনুপম প্রকাশনী। জাগৃতি প্রকাশনীও এনেছে দুটি বই নুরুন নেছা বেগমের ‘করোনা মহামারি ও পরিবর্তিত বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’ এবং ডা. ফাহমিদা রশিদ স্বাতির ‘কোভিড দিনে নারী স্বাস্থ্য’। আদনান আরিফ সালিমের ‘মহামারির ইতিহাস’ প্রকাশ করেছে অন্যধারা। মাছুম বিল্লাহর ‘করোনাক্রান্ত বিশ্বে শিক্ষার হালচাল’ প্রকাশ করেছে মূর্ধণ্য।

করোনা নিয়ে সাহিত্যের বইও এসেছে মেলায়। শাইখ সিরাজ লিখেছেন ‘করোনাকালের বহতা জীবন’। খসরু পারভেজ সম্পাদিত ‘করোনাকালের কবিতা’ প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। কামরুল হাসান সোহাগের কবিতার বই ‘করোনাকাহন’ প্রকাশ করেছে ভাষা প্রকাশ।

অন্যান্য বিষয়ের ওপর লেখা বইয়ের মধ্যে শিল্পসমালোচক অধ্যাপক নজরুল ইসলামের ‘বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ’ প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। আমীন আল রশীদের গবেষণাগ্রন্থ ‘জীবনানন্দের মানচিত্র’ প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। রাজীব নূরের গল্পের বই ‘পুরুষ, পিতৃত্ব ও অন্যান্য গল্প’ প্রকাশ করেছে বাতিঘর। মুহাম্মদ শামসুল হকের ‘বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক’ প্রকাশ করেছে ইতিহাসের খসড়া প্রকাশন।

সিরাজুল ইসলামের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘গুহা’। এই উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ আছে; কিন্তু স্পষ্ট কোনো রণাঙ্গন নেই। মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে অন্য এক অন্তহীন মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান। বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস। আলমগীর নিষাদের কবিতার নতুন কবিতার বই ‘মোকসেদুল বাংলা’। 

আক্ষেপ আর শূন্যতা

এবারের মেলায় বই প্রকাশ যেমন কম হয়েছে, তেমনি বেচা-কেনাও কম বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা। সাড়া না জাগা বইমেলায় লেখক, প্রকাশকদের মাঝে তাই এক ধরনের শূন্যতা রয়েছে। এবারে শিশুতোষ বইও প্রকাশ হয়েছে কম। নতুন বই প্রকাশের সংখ্যাও খুবই কম। মেলায় বিক্রিও নেই বললেই চলে। অন্যবারের তুলনায় শিশুদের আনাগোনাও কম। তাছাড়া এবার মেলায় শিশুপ্রহরের আয়োজন নেই।

করোনার কারণে এবার বেশিরভাগ মানুষই মেলায় আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এমনকি কবি-লেখকদের আনাগোনাও ছিল কম। কবি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ফেব্রুয়ারিতে যে বইমেলা সেটি মার্চে করলে মাঠ খালি থাকে। এ বিষয়টি আমাদের প্রকাশকরা অবগত থাকলেও, সেটার টেস্ট জানতেন না। এবারের বইমেলা তাই শুধু হাহাকারের প্রতিধ্বনি।

তরুণ লেখক নাহিদা আশরাফি জানান, বইমেলাতে এসে কোনোভাবেই মনে হচ্ছে না এটা বইমেলা! মনে হচ্ছে এটা বিকাশমেলা। কারণ করপোরেট ব্রান্ড বিকাশের বিজ্ঞাপনে বইয়ের বিজ্ঞাপন হারিয়েছে। নওরোজ কিতাবিস্তানের স্বত্বাধিকারী মঞ্জুর খান চৌধুরী চন্দন বলেন, অনেক টাকা লগ্নি করেছি। করোনার কারণে প্যাভিলিয়নের অর্ধেক ভাড়া দিয়েছি এবার। বেচাকেনা একেবারেই খারাপ। ক্রেতাদের সাড়া নেই। এ সময়ে মেলাটা করা উচিত হয়নি। বাঙালি এখনো আবেগে ভাসে। মাত্র ৫-৭টি বই প্রকাশ করেছি মাত্র, যেখানে অন্যবার ১৫ থেকে ২০টি বই প্রকাশ করে থাকি।

মাওলা ব্রাদার্সের বিক্রয় উন্নয়ন কর্মকর্তা শাহীন শিকদার মনে করেন, এবারের বইমেলাটি জোর করে হচ্ছে। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রকাশকদের মন রক্ষার্থে এবারের মেলাটি আয়োজন করেছে। মেলায় ক্রেতাসংখ্যা কম। আর লকডাউনে ক্রেতা কেমন হবে, তা বোঝার আর অপেক্ষা রাখে না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh