এম এইচ রশিদ
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৫০ এএম | আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৫৪ এএম
পয়লা বৈশাখকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট খোলা রাখলেও ক্রেতা ছিল খুবই কম। রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিংমল থেকে তোলা ছবি। -স্টার মেইল
মহামারি করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে প্রতিদিন আক্রান্তের ও মৃত্যুর সংখ্যা নতুন নতুন রেকর্ড ছড়াচ্ছে।
করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা এড়াতে প্রয়োজনীয় অফিস ও কারখানা সীমিত আকারে চালু রেখে সবকিছু এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। তবে দুইদিন পর অভ্যন্তরীণ যানাহন চলাচল সীমিত আকারে চালু করা হয়।
দীর্ঘদিন পর ব্যবসা-বাণিজ্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে ঘোষিত লকডাউনে মাথায় হাত ব্যবসায়ীদের। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা অনেক বেশি। ইতিমধ্যে তারা লকডাউনের প্রতিবাদে আন্দোলনও শুরু করেছেন।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয় গত বছরের ৮ মার্চ থেকে। সংক্রমণ এড়াতে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এই ছুটি কয়েক দফায় বাড়িয়ে ৩০ মে শেষ হয়। এই ছুটির মধ্যে ব্যাংক, চিকিৎসাসামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রির দোকান ছাড়া সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। গত বছর পহেলা বৈশাখ, দুটি ঈদ উৎসবের সময় সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ ছিল। সার্বিক অর্থনীতির চাকা থমকে দাঁড়ায়। সবচেয়ে ক্ষতির মধ্যে পড়ে নি¤œ আয়ের মানুষেরা। প্রায় ৮০ শতাংশের আয় কমে যায় এবং ৬১ শতাংশ মানুষের প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। দেশের দরিদ্রতার হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশে পৌঁছায় বলে জানায় গবেষণা সংস্থাগুলো। দোকানপাট ও মার্কেট বন্ধ রাখায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন।
গত বছরের সাধারণ ছুটি প্রত্যাহারের পর ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে। করোনা সংক্রমণ কমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি; কিন্তু চলতি বছরের মার্চের শুরু থেকে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঁচড় পড়তে থাকে। মার্চের শেষদিক থেকে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা নতুন নতুন রেকর্ড ছড়াচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ৭ দিনের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। সীমিত আকারে খোলা রয়েছে জরুরি প্রয়োজনের সরকারি ও বেসরকারি অফিস। ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দোকানপাট ছাড়া সব ধরনের শপিংমল ও মার্কেট বন্ধ থাকবে।
কয়েক দিন বাদেই পহেলা বৈশাখ। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। দুটি বড় উৎসব পাশাপাশি থাকায় সবখাতের ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতিও নিয়েছিল ব্যাপকভাবে। ইতিমধ্যে প্রায় সব প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন, ফেস্টুন-ব্যানারের মাধ্যমে প্রচারও শুরু করে; কিন্তু এর মধ্যে নতুন করে ঘোষিত লকডাউন সবকিছুই যেন প- করে দিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় লকডাউন এখন ভোঁতা অস্ত্র। এখন সময় স্মার্ট লকডাউনের। কম লোকজন দিয়ে অফিস চালু রাখা যেমন সম্ভব, তেমনি দোকানপাট খোলা রাখাও যাবে ২৪ ঘণ্টা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাকাটা চলবে। মাস্ক ছাড়া কেউ বের হতে পারবে না। তাহলে সবকিছু ঠিক থাকবে। এ জন্য সরকারের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও দ্রুত উন্নত ও সময়োপযোগী করার সুযোগ ছিল। দাতারা যে টাকা দিয়েছে, তা দিয়ে সহজেই হাসপাতালগুলোতে সক্ষমতা বাড়ানো যেত। তাহলে শ্বাসকষ্টে কাউকে মারা যেতে হতো না। এদিকে দ্রুত নজর দিতে হবে। কারণ সামনে আরও বেশি রোগীকে হাসপাতালে নিতে হতে পারে। এটি ঠেকানো না গেলে পরিস্থিতি উত্তরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে অর্র্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে বাস্তবায়ন করছে সরকার। এই প্যাকেজের আকার ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। তহবিলের বড় অংশ ঋণ আকারে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো; কিন্তু এই প্যাকেজ থেকে নানা জটিলতায় ঋণ সহায়তা পাননি অধিকাংশ দোকান মালিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। যদিও বেশি ক্ষতিতে পড়েছেন তারাই। এবারের লকডাউন নিয়ে তারা বেশ শঙ্কিত। এ নিয়ে চাঁদনীচক ব্যবসায়ী ফোরামের সভাপতি মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, গত বছরে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর লাগবে। কেউ সম্পদ বিক্রি ও কেউ ঋণ নিয়ে টিকে আছে। আমরা ভেবেছিলাম, এবারের বৈশাখ ও ঈদে কিছু বিক্রি করে লোকসান সামাল দেব। এখন মনে হচ্ছে, সেই সুযোগও শেষ হয়ে আসছে। পোশাক কারখানা ও খাবারের দোকান খোলা থাকলে, আমাদের দোকান খোলা রাখতে সমস্যা কোথায় ছিল। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কড়াকড়ি করতে হবে।
তবে ফ্যাশন হাউসগুলোর মালিকদের সংগঠন ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) সভাপতি শাহীন আহম্মেদ বলেন, এক সপ্তাহ লকডাউন থাকলে আমাদের তেমন সমস্যা নেই। আমাদের মূল্য লক্ষ্য বৈশাখ ও ঈদ। গতবার ঈদে কোনো ব্যবসা হয়নি। তাই এবার আমরা বড় বিক্রির আশা নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। যদি লকডাউন দীর্ঘ হয়, তাহলে আমাদের জন্য বড় বিপদ হয়ে যাবে।
গত বছরে যে প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া হয়, তার প্রথমটি ছিল পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতা। পুরো সময় কারখানা খোলাও ছিল। এ ছাড়া কম সুদের ঋণেও পোশাক মালিকেরা ভালো সুবিধা পেয়েছেন। রফতানি খাতের জন্য দেওয়া হয় নানা সুবিধা। নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শ্রমিকদের কারখানায় আসা-যাওয়ার সময় ভাগ করে দিতে আমরা উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করেছি। সেটি হলে সড়কে বেশি লোকের গাদাগাদি হবে না। লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। তবে অধিকাংশ শ্রমিকই কারখানার আশপাশেই থাকেন। আর প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গাড়িতে কর্মীরা আসা-যাওয়া করতে পারবেন। আশা করি, এবারও সমস্যা হবে না।
তবে এবারের দোকানপাট বন্ধের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছেন দোকানীরা। লকডাউনে মার্কেট ও দোকান বন্ধ রাখার ঘোষণার আগের দিন গত ৪ এপ্রিল এবং লকডাউনের প্রথমদিন ৫ এপ্রিল প্রতিবাদ করেছেন রাজধানীর নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, নূর ম্যানশন, চাঁদনীচক মার্কেটের দোকান মালিক ও কর্মচারী এবং ব্যবসায়ীরা। তারা সড়কে নেমে বিক্ষোভ করেছেন। নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীদের সারা বছরের ব্যবসা হয় এই সময়ে মানে ঈদের আগের দুই মাসে। গত বছর আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এবারও যদি এই সময় মার্কেট বন্ধ থাকে, তাহলে তো আমাদের পথে বসতে হবে। যেভাবে বিশেষ বিবেচনায় শিল্প-কারখানা চালু রাখা হয়েছে, সেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেট খোলা রাখার সুযোগ দেওয়া হোক।