তবুও তোমাকে চাই

হিমাদ্রিশেখর সরকার

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২১, ০৫:৩৪ পিএম

গোলাকার চাঁদের দিকে এখন তাঁর চোখ। তাকিয়ে রইলেন কিছুটা সময়। তাঁর ভাবনার শেষ ছিল না। কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না অনেকক্ষণ। হাতে তো আর কিছু নেই, যা কিছু সুন্দর সবই গেছে নর সৃষ্টির পেছনে; কিন্তু নারী? নারী না হলে কেমন করে হয়? এবার তিনি নারী সৃষ্টিতে মন দিলেন। 

আরও কিছুটা সময় কেটে গেল। চাঁদের গোলাকৃতি নারীর মুখে বসিয়ে দিলে কেমন হয়? তিনি তাই করলেন। স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ চন্দ্রাননা নারীর দিকে। ‘চন্দ্রাননা’ ক্ষণকালের জন্য হলেও তাঁকে নেশাগ্রস্ত করল। 

ওর দেহে যদি লতাগুল্মের বক্রগতি আরোপ করা যায়, তাহলে কেমন হয়? আর যদি জুড়ে দেওয়া যায় ফুলের ফুটন্ত স্বভাব কিংবা ঘাসের ডগার কম্পন। অথবা নখ থেকে চুল পর্যন্ত সবুজ পাতার কমনীয়তা। আর সারাদেহে যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায় বাতাসের চঞ্চলতা, কেমন হয় তাহলে? এবার ওর চোখ নিয়ে ভাবনায় পড়লেন সৃষ্টিকর্তা। হরিণীর চাহনি থেকে ধার করলেন নারীর চোখের অবয়ব। না, এখানেই শেষ তো নয়। এবার নারীর স্বভাবের দিকে নজর দেওয়া যাক। প্রথমেই তিনি দিলেন ওকে হাতির শুঁড়ের কর্মমুখরতা। ওর স্বভাবে আরও জুড়ে দিলেন মেঘের ক্রন্দন। আরও দিলেন ময়ূরীর অহংকার। দিলেন তোতা পাখির বুকের লোমের কোমলতা। পাশাপাশি পাথরের কঠিনতা আর বাঘের হিংস্রতা দিতেও ভুললেন না। 

  • প্রভু, যে জীবটি আমাকে দিয়েছেন ‘ও’ আমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। ‘ও’ সবসময় বকবক করে আর আমাকে অসম্ভব রকমের গালাগাল দেয়। আবার আমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও যায় না কোথাও। সবসময় ওকে আদর দিতে হয়। কারণে-অকারণে মেঘের মতো কাঁদে। হরিণীর মতো তাকিয়ে থাকে। আবার ময়ূরীর মতো অহংকারী। অতএব, ওকে ফিরিয়ে নিন প্রভু 

আগুনের দাহ্যতার পাশাপাশি আবার দিলেন বরফের শীতলতা। কণ্ঠে দিলেন কোকিলের কুহুতান আর চড়ুই পাখির কিচির মিচির। নারীর সৌকর্যের কাছে মৌমাছির মধুচাকও হার মানল। সারসের শঠতার পাশাপাশি চক্রবাকের বিশ্বস্ততা দিতেও ভুললেন না সৃষ্টিকর্তা। অতঃপর জীবন দান করে সৃষ্টিকর্তা নারীকে তুলে দিলেন পুরুষের হাতে। 

এক সপ্তাহও কাটল না। পুরুষটি নারীটির সম্পর্কে এন্তার অভিযোগ নিয়ে ওর সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাজির। 

প্রভু, যে জীবটি আমাকে দিয়েছেন ‘ও’ আমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। ‘ও’ সবসময় বকবক করে আর আমাকে অসম্ভব রকমের গালাগাল দেয়। আবার আমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও যায় না কোথাও। সবসময় ওকে আদর দিতে হয়। কারণে-অকারণে মেঘের মতো কাঁদে। হরিণীর মতো তাকিয়ে থাকে। আবার ময়ূরীর মতো অহংকারী। অতএব, ওকে ফিরিয়ে নিন প্রভু। ওর সঙ্গে সহবাস আমার কর্ম নয়। 

সৃষ্টিকর্তা বললেন, তথাস্তু। তুমি আসতে পারো। ‘ও’ আমার কাছেই থাকবে। আবার এক সপ্তাহ পরে পুরুষটি এসে সৃষ্টিকর্তাকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করল। প্রভু, একটা কথা বলি, ওকে ফিরিয়ে দেওয়া অবধি আমি খুব নিঃসঙ্গ। আমার সময় একটুও কাটে না। এখন কেবলি মনে পড়ে, ‘ও’ কোকিলের মতো কি চমৎকার গাইতো, দোয়েল-শ্যামা-ফিঙ্গের মতো নাচতো, হরিণীর মতো আমার চোখের দিকে কেমন নির্নিমিখ তাকিয়ে থাকত! আহা! এসব কেমন করে ভুলি! 

প্রভু, ‘ও’ ছিল মায়াবী লতাগুল্ম। কেমন মায়ায় মায়ায় জড়িয়ে রাখত আমাকে। ওর হাসিতে যাদু ছিল। যাদুর স্পর্শে আমার হৃদয় গলে জল হয়ে যেত। তোতা পাখির বুকের চেয়েও ছিল ওর নরম বুক। আহা! প্রভু, এর তুলনা কোথায়? প্রভু, এখন আমার দুঃখ ভুলাবে কে বলো না? ওর স্পর্শে আমি সব দুঃখ ভুলে যেতাম। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। চুপ করে থেকো না প্রভু। ওকে তুমি আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।

সৃষ্টিকর্তা হেসে বললেন, তথাস্তু। ওকে নিয়ে যাও পুরুষপ্রবর। তিন দিন যেতে না যেতে পুরুষটি আবার এসে হাজির। প্রভু বললেন, আবার কি হলো হে প্রেমিক প্রবর? 

পুরুষটি বলল, প্রভু আমি বুঝতে পারছি না কেন এমন হয়। ‘ও’ আমার কাছে আনন্দের চেয়ে নিরানন্দের কারণই বেশি। ওকে আমার প্রয়োজন নেই। আপনার জীব আপনি ফিরিয়ে নিন। ‘ও’ আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সৃষ্টিকর্তা এবার ক্ষেপলেন। এবার তাঁর জলদগম্ভীর অথচ কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এলো। দূর হয়ে যাও আমার সম্মুখ থেকে। আমি একই কাজের পুনরাবৃত্তি করতে পারব না। আমার হাতে বহু কাজ। তোমাকেই যে কোনোভাবে ওকে আয়ত্তে এনে ওর মন জয় করতে হবে। 

পুরুষটি অনড়। বলল, প্রভু এ কর্ম আমার নয়। একবার আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন। সৃষ্টিকর্তা এবার আরও ক্ষেপলেন। তিনি ধমকের সুরে বললেন, এ কেমন কথা? একবার বলছ ওকে ছাড়া বাঁচবে না আবার বলছ ওর সঙ্গে বাস করা অসম্ভব! ওসব হবে না বাপু। ওকে তোমায় গ্রহণ করতেই হবে এবং এভাবেই চলবে তোমাদের জীবন। 

সৃষ্টিকর্তা এবার পুরুষটির মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের কাজে মন দিলেন। সৃষ্টিকর্তার আদেশ অমান্য করার তো জো নেই। আবার মহাপাপও বটে। পুরুষটি নারীটিকে গ্রহণ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কি আর করা। হায়রে নারী! তোমাকে নিয়ে বাঁচি না আবার তোমাকে ছাড়া বাঁচাও দায়। 

একটি আদিবাসী লোকগাঁথার ছায়া অবলম্বনে

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh