অস্থির কেন নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার?

কে এম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৫১ এএম | আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৩৭ এএম

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, চাকরির বাজার, আয়-ব্যয় নিয়ে রীতিমতো হতাশ সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। জীবন ধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসেরই অগ্নিমূল্য। 

করোনার মধ্যে রমজানের আয়োজন করতে গিয়ে মাথায় হাত সাধারণ মানুষের। ফর্দ মিলিয়ে অর্ধেক জিনিস কেনার আগেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে পকেট। অপরদিকে রোজার আগেই ক্রেতারা বেশি পণ্য কিনে মজুদ করায় দাম বাড়ছে বলে দাবি বিক্রেতাদের। 

রমজান মাস শুরু হবে এপ্রিলের মাঝামাঝি। অথচ দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে উত্তাপ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারে। সবকিছুই বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। তেল বিক্রিতে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও, কে শোনে কার কথা! সিন্ডিকেটের কারসাজিতে দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফার নেশায় মাতোয়ারা অসাধু ব্যবসায়ীরা। অথচ দেশের বড় বড় পাইকারি বাজারগুলোতে কোনো সংকট নেই পণ্যের সরবরাহে। 

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘প্রতিবছর রোজা এলেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরেই চাল, ডাল, ছোলা, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সরকার এখনই যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, রোজার মাসে ভোগান্তিতে পড়বেন ভোক্তারা। তাই এখন থেকে আমদানি, বিতরণ ও ভোক্তা পর্যায়ে বিপণনে কঠোর তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে বাজার স্বাভাবিক রাখতে জোরদার করতে হবে আইনের কঠোর প্রয়োগ, ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম। অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে নগদ অর্থদণ্ডের পাশাপাশি প্রয়োজনে জেল-জরিমানা নিশ্চিত করতে হবে।’

দেশের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। সেখান থেকেই আমদানি পণ্য সারাদেশের বাজারগুলোতে সরবরাহ করা হয়। সম্প্রতি খাতুনগঞ্জ বাজার ঘুরে জানা যায়,পাইকারিতে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ছোলায় মণপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়েছে। প্রতি কেজি সাধারণ মানের খেজুর ১৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। চিনিতে মণপ্রতি ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে পাইকারি বাজারেই। মসুর, মুগডাল ও দেশি পেঁয়াজ ১০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে কেজিতে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বেড়েছে ৪৫ টাকা। গুঁড়া দুধ কোম্পানিভেদে কেজিতে ৪০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ১৯ হাজার ২১৮ টন ছোলা খালাস হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২ হাজার ৫২৬ টন বেশি। সবচেয়ে বেশি ছোলা আমদানি করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৮ টন মসুর ডাল আমদানি করা হয়েছে। গত মাসে ৬০ হাজার ৩৩১ টন চিনি আমদানি করা হয়েছে। 

এছাড়া সরকার ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেদিকে কর্ণপাত করছেন না কোনো ব্যবসায়ী। নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে কেজিতে ৬ টাকা বেড়েছে চিড়ার দামও। ভারত থেকে আমদানি করা হলুদ দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ২০ টাকা বেড়েছে। আর ৫০ থেকে ৬০ টাকার নারিকেল বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে।

বাজার চড়ার ১১ কারণ 

রমজানকে সামনে রেখে এবার হঠাৎ করেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়নি অসাধু সিন্ডিকেট সদস্যরা, একটু সময় নিয়েছে। গত দুই মাসে ধাপে ধাপে বাড়িয়েছে চাল, ছোলা, ডাল, সবজি, মসলা, ভোজ্যতেল, খেজুর, চিনি, ডাল, পিঁয়াজ, মাছ-মাংস ও গুঁড়া দুধসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। আর এই দাম গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। 

দাম বাড়ার ১১টি কারণ তুলে ধরা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। সেগুলো হলো- প্রথাগত বাজার সরবরাহ প্রক্রিয়া, অতিরিক্ত মজুদের মাধ্যমে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, অপর্যাপ্ত ও সমন্বয়হীন বাজার মনিটরিং, রমজানে পণ্যের বাড়তি চাহিদা, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, যানজট ও অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয়, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি, স্বার্থান্বেষী মহলের অপতৎপরতা, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদের হার, ঋণপ্রাপ্তিতে জটিলতা ও ব্যবসা পরিচালনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়া। 

সংস্থাটির আশঙ্কা, রমজানকে ঘিরে চালের বাজারে আরেক দফায় অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে থানা ও জেলা পর্যায়ে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কার্যক্রম বেগবান ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসৎ ব্যবসায়ীদের শাস্তি নিশ্চিতের সুপারিশ করা হয়েছে।

রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আল-মামুন অভিযোগ করেন, রোজা আসার আগেই ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। রোজা শুরু হলে এই দাম আরো বাড়তে পারে- এই আশঙ্কায় তিনি আগাম ছোলা কিনেছেন। তার মতে, ‘অন্য দেশে দেখেছি উৎসবে পণ্যের দাম কমে আর আমাদের দেশে এর উল্টো। উৎসব এলেই এখানে নির্লজ্জভাবে দাম বাড়িয়ে দেন বিক্রেতারা। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’ 

উত্তর বাড্ডার গৃহিণী তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। আর আমরা অসহায়ের মতো নীরবে সব সয়ে যাচ্ছি, বাড়তি টাকা দিয়ে পণ্য কিনছি। দাম বাড়ায় একদম সীমিত পরিসরে কেনাকাটা করতে হচ্ছে রমজানকে সামনে রেখে।’

আমদানিকারকদের একাধিক সূত্রও জানায়, দেশে মজুদ ঠিকই আছে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী মজুদ বাড়িয়ে বেশি দামে ছোলা বিক্রি করছেন। রাজধানীর শ্যামবাজারের আল মদিনা ট্রেডার্সের ব্যবসায়ী আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি নেই। তবে রোজার আগেই বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই খুচরা ব্যবসায়ীরা বেশি পরিমাণে পণ্য কিনে মজুদ বাড়ানোর কারণে দামটাও বেড়ে গেছে।’ 

তবে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘রমজানকে ঘিরে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ভালোই রয়েছে। তবে আমাদের বাজারের সাথে আন্তর্জাতিক বাজারদরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়লে আমাদেরকেও বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে হয়।’ 

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘রমজানে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তবে সে চাহিদা মোকাবেলায় যথেষ্ট পরিমাণে পণ্য আমদানি করা হয়েছে। মার্চেও আসছে, এপ্রিল মাসেও পণ্য আমদানি করা হবে। রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং সেল গঠনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’

টিসিবির প্রস্তুতি কতটুকু 

গোয়েন্দা পর্যক্ষণে বলা হয়েছে, টিসিবি বর্তমানে বাজার চাহিদার ৮-১০ শতাংশ জোগান দেয়। প্রতিষ্ঠানটির ওপর সাধারণ মানুষের আগ্রহও অনেক বেশি। তাই বাজার স্থিতিশীল রাখতে টিসিবির সেবার পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি এখনই নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক আমদানির উদ্যোগ নেয়া জরুরি। কেননা রমজানে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা ও খেজুরের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। 

এর বাইরে মসুর ডাল, বেসন, পেঁয়াজ, ময়দাসহ কয়েকটি পণ্যের চাহিদাও অনেক বাড়ে। এরমধ্যে স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে সয়াবিন, পামসহ ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে দেড় থেকে দুই লাখ টন, যার ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। রোজায় এ চাহিদা ২০ শতাংশের মতো বাড়ে। একই অবস্থা চিনির ক্ষেত্রেও। বছরব্যাপী দেশে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। রমজানে সেটা বেশি থাকে। আর চিনির মোট চাহিদার ৯৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়।

টিসিবি সংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় দ্বিগুণ মজুদ সক্ষমতা নিয়ে তারা রোজার আগেই মাঠে নামছেন। আরো কিছু পণ্যের মজুদ বাড়াতে বিভিন্ন উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। রোজার সময়ে চাহিদার কথা বিবেচনা করে ১৭ হাজার টন ডাল, ৬০০ টন ছোলা, আড়াই কোটি লিটার ভোজ্যতেল, ১৩ হাজার টন চিনি ও অন্যান্য পণ্যের মজুদ নিয়ে সুলভ মূল্যের বাজার ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি নিয়েছে। এ বছর প্রায় ৫০০টি খোলা ট্রাকে পণ্য বিক্রি করা হবে সারাদেশে।

 তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান অবশ্য শুনিয়েছেন আশার বাণী, ‘সারাদেশের সব আমদানিকারককে নিয়ে একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ, ছোলা ও খেজুরের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কাজ শুরু হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ বাজারের সাথে অচিরেই অনলাইন মার্কেটেও কিছু পণ্য বিক্রি করবে টিসিবি।’

নিত্যপণ্যের দাম বাড়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এমএম আকাশ বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য দুই কারণে বাড়তে পারে। একটি হচ্ছে পণ্য কম, মানুষের চাহিদা বেশি। আর অন্যটি পর্যাপ্ত পণ্য থাকার পরও চাহিদা দেখে দাম বাড়িয়ে দেয়া। এখন দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণ কোনটি সেটিই খুঁজে বের করতে হবে। তবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণেই সাধারণত ব্যবসায়ীরা পণ্যমূল্য বাড়িয়ে থাকেন।’ 

এদিকে বাজারে ক্রেতার আচরণেও পণ্যের দাম বাড়ে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘রমজানের এলেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়- এমনটা ভেবে দয়া করে আমরা যেন অতিরিক্ত কেনাকাটা না করি। সবাই কেনাটা স্বাভাবিক রাখুন। সীমানার মধ্যে রাখুন। অন্যথায় সুযোগ দিলে তো ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ নেবেন।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh