করোনার ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউ, প্রস্তুতি আছে কি?

ড. মো. কামাল উদ্দিন

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৫৯ এএম | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০১:৪৭ পিএম

বাংলাদেশে করোনার নতুন ঢেউ শুরু হয়েছে মার্চ মাসের মাঝামাঝি। এবারের করোনার ঢেউ গত বছরের তুলনায় অনেক ভয়াবহ। লক্ষণেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে এবার। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই অক্সিজেন লেভেল কমে যাচ্ছে বলে ডাক্তারদের অভিমত। 

গত কয়েক মাস ধরে জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সকল কিছু চলছিল পুরোদমে; কিন্তু এখন পরিস্থিতি আবার বেসামাল। যে গতিতে শনাক্তকরণ ও মৃত্যুর হার বাড়ছে সে গতি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটুকু পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে তা এখন বড় প্রশ্ন। 

প্রশ্ন জাগে গত এক বছরের করোনার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কি পেরেছি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি করতে? আইসিইউর পরিমাণ আগের থেকে বেড়েছে কিনা কোনো হিসাব নেই। আর স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি যদি কিছুটা হয়েও থাকে জনগণ সচেতন না হলে, সরকার যদি সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে করোনার মতো মহামারি কখনো নির্মূল করা কি সম্ভব?

গত কয়েক মাস ধরে যেন সবকিছু স্বাভাবিক। টিকা নেয়ার পর পরিস্থিতি আরো ঢিলেঢালা হয়ে গেল। যদিও টিকা পরিপূর্ণ প্রতিরোধ করে না, সাময়িক সুরক্ষা দেবে বলে বলা হলেও জনগণের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে, টিকা নেয়ার পর তারা আক্রান্ত হবেন না; কিন্তু পরিস্থিতি সেরকম নয়। টিকা নেয়ার পর আক্রান্ত হয়ে ভয়াবহ অবস্থার খবর প্রকাশিত হয়েছে।

এখন প্রায় প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ইন্নালিল্লাহ লিখতে লিখতে হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে অনেক পরিচিত আপনজনের মৃত্যুর সংবাদ চোখের সামনে ভেসে উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কেন জানি এ বিষয়গুলো এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মিছিলে গুলি, রোড এক্সিডেন্ট, গণপিটুনিতে হত্যা, ক্রসফায়ার ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশ মানুষের লাশ দেখলে আর আগের মতো প্রতিক্রিয়া হয় না। ফলে করোনার মৃত্যুও আমাদের কাছে স্বাভাবিক! আমরা মৃত্যুকে ভুলতে বসেছি! 

বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার ফেসবুক স্ট্যাটাস আমার নজরে এসেছে। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি ছিল ঠিক এই রকম ‘এবারের করোনা ভ্যারিয়্যান্ট অত্যন্ত জঘন্য! সব বয়েসীদের আক্রমণ করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অক্সিজেন লেভেল পড়ে যাচ্ছে! আইসিইউ-তে যাওয়ার হার বেশি, ফেরার হার কম।’ 

আক্রান্ত অনেকেই কান্নার সঙ্গে আইসিইউ ম্যানেজ করে দেয়ার জন্য বারবার অনুরোধ জানাচ্ছেন। পরিচিত ডাক্তার যারা আছেন তারা লজ্জায় কিছু না বললেও অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন। আবার অনেককে টেলিফোনে পাওয়াও যায় না। পরিচিত কারো কারো পুরো ফ্যামিলি আক্রান্ত। যেহেতু সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছি তাই অনেকে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ফোন করেন, কিন্তু সব প্রত্যাশা ইচ্ছা থাকলেও হাজার চেষ্টায়ও পূরণ করা যায় না। এটাই বাস্তবতা। যারা এখনো সুস্থ আছেন তাদেরকে বিনীত অনুরোধ আসুন, সবাই সচেতন হই। মাস্ক পরি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।

বাংলাদেশের মানুষ প্রথম ধারণা করেছিল যে বাংলাদেশ সরকার ভ্যাকসিনের আয়োজন করতে পারবে না। বাংলাদেশ সরকার একটি সুন্দর অ্যাপসের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সকলের জন্য ভ্যাকসিনের আয়োজন করেছে, তাও আবার বিনামূল্যে কিন্তু আমরা দেখেছি অনেকেই ভ্যাকসিনের জন্য রেজিস্ট্রেশন করেও ভ্যাকসিন নেননি। আবার অনেকেই রেজিস্ট্রেশন করেননি। এমন খবর শোনা গেছে জনগণ ভ্যাকসিন গ্রহণ না করার কারণে ভ্যাকসিনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে বা হতে চলেছে। আসলে ভেবে দেখা দরকার কেন জনগণের ভ্যাকসিন নিতে এত অনীহা! বাংলাদেশের মানুষ ফ্রিতে যে কোনো কিছু নিতে চায়! কথিত আছে বাংলাদেশের মানুষকে ফ্রিতে কলাপাতা দিলেও খায়, কিন্তু জীবন বিধ্বংসী করোনা থেকে সুরক্ষার জন্য ফ্রি ভ্যাকসিন নিতে মানুষের এত অনীহা কেন তা ভেবে দেখা দরকার। এটি কি ভ্যাকসিনের প্রতি, না কোনো সুনির্দিষ্ট দেশের মাধ্যমে ভ্যাকসিন আনার কারণে, নাকি সরকারের প্রতি অবিশ্বাস! 

মনে হচ্ছে সরকার ও জনগণের মধ্যে এক ধরনের সাপলুডু খেলা চলছে। যেকোনো মুহূর্তে জনগণ ভয়ে আছে কখন সাপের ছোবলে পড়ে অনেক নিচে নেমে যাবে। সরকারও জনগণকে বিশ্বাস করছে না। সবকিছুতে যেন অবিশ্বাস আর নিয়ন্ত্রণ।

করোনাকে নিয়ে আমরা দোষারোপের খেলা দেখেছি প্রথম থেকেই। জনগণ সরকারকে, সরকার জনগণকে; কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা আমাদের নিজেদের জায়গা থেকে নিজের ভুলটা দেখি না। ধরুন সরকার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও আপনি যদি আপনার স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় গাইডলাইন না মানেন তাহলে আপনাকে কেউ সুরক্ষা দিতে পারবে না। আমরা আসলে আইন ভাঙতে ভালোবাসি। অসচেতন থাকা আমাদের মজ্জাগত। অন্যায় করাকে ক্ষমতা বলে মনে করি। যে যত বেশি অন্যায় করে পার পেয়ে যেতে পারে সে তত বেশি আমাদের কাছে ক্ষমতাবান; কিন্তু তাকে আমরা অপরাধী হিসেবে গণ্য করি না। অন্যকে সমালোচনা করার ক্ষেত্রে আমরা বড়ই চ্যাম্পিয়ন। 

আপনজনের মৃত্যুর খবর দেখলে নিজে সচেতন না হয়ে ফেসবুকে একটি সুন্দর স্ট্যাটাস দিয়ে বা ইন্নালিল্লাহ লিখে আমাদের দায়িত্ব শেষ। কেন জানি আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই না। করোনার প্রকোপ বাড়ার মধ্যেও বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে দেখেছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা হলো, এগুলো নিয়ে জনগণের অনেক প্রতিক্রিয়া দেখেছি, সরকারের সমালোচনা দেখেছি; কিন্তু সরকারের কঠিন সিদ্ধান্ত নেই। এই ধরনের অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। হয়তো এই সব পরীক্ষা নিয়ে সরকারের ব্যাখ্যা থাকতে পারে, কিন্তু জনগণের কাছে কী মেসেজ যাচ্ছে? একদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম করে পরীক্ষা নেয়া, অন্যদিকে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতো। 

বাংলাদেশে বর্তমানে করোনার এই ভয়াবহতা দেখে হয়তো অনেকেই খুশি! কারণ তারা করোনা নিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন, যেরকম গতবছর নকল টেস্ট রিপোর্ট দিয়ে একশ্রেণীর হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবসায়ীরা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। করোনায় সবকিছু বন্ধ হলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারি প্রণোদনা পাওয়া যাবে। প্রান্তিক জনগণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া রিলিফের চাল চুরি করা যাবে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে করোনার সরঞ্জাম নিয়ে ব্যবসা করা যাবে। 

হয়তো সরকার আবার হার্ডলাইনে যাবেন কিন্তু গত বছর করোনার কারণে ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি দেখেছি। তখনো কিন্তু অনেকে নিয়ম মানেননি নানা অজুহাতে। তবে এও ঠিক লকডাউন ও হোম কোয়ারেন্টিনে প্রান্তিক জনগণের জীবনের ওপর মারাত্মক হুমকি আসে, সেই বিষয়ে সরকারের সঠিক ব্যবস্থা থাকা দরকার। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া যেমন দরকার, তেমনি তাদের জীবন টিকিয়ে রাখাও দরকার। সরকারের সাম্প্রতিক ১৮ দফা নির্দেশনায় তেমন কঠোর কিছু দেখিনি। হয়তো পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হলে কঠোর নির্দেশনা আসবে।

তবে জনগণকে বিনীত অনুরোধ করব সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজে সচেতন হোন। আপনার সুরক্ষা আপনি বজায় রাখুন, তাহলে হয়তো করোনার ভয়াবহতা কমতে পারে। স্বপ্ন দেখতে পারেন আবার বেঁচে থাকার।

লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh