ফোনালাপ ফাঁস কি বেআইনি?

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৪৯ এএম | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০১:৪৭ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

ফোনালাপ ফাঁস নতুন কোনো ঘটনা নয়। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কয়েকটি আলোচিত ফোনালাপের কথা দেশের মানুষের মনে আছে।

তবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ফোনালাপ ফাঁসের মধ্য দিয়ে।

২০১৫ সালে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপও ফাঁস হয়। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের ফোনালাপও ফাঁস হয়। সেই তালিকায় এবার যুক্ত হলেন হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক যিনি নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে ‘বান্ধবী’ অথবা ‘দ্বিতীয় স্ত্রী’কে নিয়ে আটক হয়েছিলেন। ওই সময় তিনি তার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যে কথা বলেছেন, সেটি গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। 

মামুনুল হক কী করেছেন, স্ত্রীর সঙ্গে কী কথা বলেছেন, তার রাজনৈতিক পরিচয় কী- সেই আলোচনা ভিন্ন। কথা হচ্ছে, ব্যক্তির ফোনালাপ রেকর্ড এবং তা ফাঁস করা নিয়ে। এ তর্কটি বহুদিনের। কেননা এর সঙ্গে মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও গোপনীয়তা এবং সর্বোপরি আইনের শাসনের সম্পর্ক রয়েছে। বিষয়টি এমন নয় যে, হেফাজত নেতার ফোনালাপ ফাঁস করা জায়েজ; কিন্তু অন্যেরটি নাজায়েজ। 

১৯৪৮ সালে ঘোষিত জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার ১২ নম্বর আর্টিকেলে বলা হয়েছে,  ‘‘কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তার গৃহ, পরিবার ও চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়ালখুশীমত হস্তক্ষেপ কিংবা তার সুনাম ও সম্মানের উপর আঘাত করা চলবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আ‌ইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকের‌ই রয়েছে।’’

ফোনে আঁড়িপাতা এবং ফোনালাপ প্রকাশ নিয়ে দেশের কোনো আইনে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। টেলিযোগাযোগ আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, যদি নিরাপত্তা সংস্থা প্রয়োজন মনে করে, তদন্তের ও মামলার স্বার্থে কারও ফোনালাপ নিতে পারে। তাহলে টেলিফোন সেবাদাতা সংস্থা তাদের সব রকমের তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে; কিন্তু তারা যে কারও ফোনে আঁড়িপাততে পারবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা নেই। বরং বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩(খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’ অর্থাৎ নাগরিকরা চিঠিপত্র এবং যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যম যেমন ফোন, ই-মেইল ইত্যাদির মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করলে রাষ্ট্র তার গোপনীয়তা রক্ষা করবে। আইন বলছে, সুনির্দিষ্ট মামলা বা তদন্তের স্বার্থে ফোনকল রেকর্ড করা যাবে। প্রশ্ন হলো, সেই রেকর্ড কি গণমাধ্যমের প্রচার করা যায়? এটি কি আইনসঙ্গত? 

প্রশ্ন হলো, কারা এসব ফোনালাপ ফাঁস করেন, কেন করেন এবং কোনো প্রক্রিয়ায় করেন? এ পর্যন্ত যাদের ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, তারা সবাই সরকার বা সরকারি দলবিরোধী। অর্থাৎ বিরোধী মতের মানুষের ফোনালাপই ফাঁস করা হয়েছে বা গণমাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছে। তার মানে গুরুত্বপূর্ণ সবার ফোনালাপই রেকর্ড হচ্ছে এবং যখন যারটি প্রয়োজন, তখন তারটি সরবরাহ এবং প্রকাশ করা হচ্ছে। যাদের ফোনালাপ ফাঁস হচ্ছে, তাদের বাইরেও রাষ্ট্রের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিজের দল ও সরকার পরিচালনার স্বার্থে নেতাকর্মী ও সংশ্লিষ্টদের নানা ধরনের পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন। এসব নির্দেশনা ও পরামর্শ কি ভবিষ্যতে ফাঁস হবে? সুতরাং প্রতিপক্ষ বা ভিন্ন মতের কারও ফোনালাপ ফাঁস হওয়ায় খুশি হওয়ার কিছু নেই। বরং এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সবারই কথা বলা উচিত। কেননা এটি যতটা না রাজনীতির, তার চেয়ে বেশি নৈতিকতা ও মানবাধিকারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানেই একজন মানবাধিকার কর্মীর এসিড টেস্ট যে, আমরা কি আমাদের প্রতিপক্ষের মানবাধিকার সুরক্ষায়ও যথেষ্ট আন্তরিক, না-কি প্রতিপক্ষ বলে তার মানবাধিকারের বিরোধী? মনে রাখা দরকার, একজন অপরাধীরও মানবাধিকার রয়েছে। বিনা বিচারে তাকে মেরে ফেলা মানবাধিকারের পরিপন্থি। আদালত কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ার আগে যেমন কাউকে ধরে এনে বুকের উপরে ‘সন্ত্রাসী’ বা ‘জঙ্গি’ ট্যাগ লাগিয়ে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা অনৈতিক, তেমনি কারও ফোনালাপ ফাঁস করে দেওয়াও নৈতিক নয়। বরং যতক্ষণ না বিষয়টি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হচ্ছে, ততক্ষণ এটি সংবিধানের ৪৩ (খ) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 

তবে শুধু ফোনালাপ নয়, মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অডিও-ভিডিওসহ নানা তথ্য প্রকাশের ঘটনাও বাড়ছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন তথা ডিজিটাল দুনিয়া যত বেশি প্রসারিত হচ্ছে, মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ইস্যুটি তত বেশি উপেক্ষিত হচ্ছে। মোবাইল ফোনে মানুষ এখন অফিসিয়াল বিষয়ের বাইরে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলতে ভয় পান। কারণ সবার মনেই এই প্রশ্ন বা সংশয় কাজ করে যে, ফোনকলটি রেকর্ড হচ্ছে কি-না বা কেউ আড়ি পেতে আছেন কি-না! এই আতংকে অনেকে মোবাইল ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চান না। অনেকেই মোবাইল ফোনের সাধারণ কলের বদলে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার বা ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথা বলেন। 

এটা ঠিক, ফোনালাপ ফাঁস অনেক সময় বড় কোনো ঘটনারও জন্ম দেয় বা বড় ধরনের অপরাধের হাত থেকে দেশকে বাঁচিয়ে দেয়। সম্প্রতি যশোরের একজন এমপি স্থানীয় এক আইনজীবীকে ফাঁসাতে পুলিশকে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেই ফোনালাপ ফাঁস না হলে এই অপরাধের খবরটি জানা যেত না। সবশেষ হেফাজত নেতা মামুনুল হককে আটকের পরে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে কী কথা বলেছেন, সেটিও প্রকাশিত না হলে জানা যেত না যে, তার সঙ্গে থাকা নারী আসলে তার স্ত্রী নন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলাম যে তা-ব চালিয়েছে, সেই সংগঠনের একজন শীর্ষ নেতা যে অনৈসলামিক কাজে যুক্ত, সেটি তার ফোনালাপ ফাঁস না হলে জানা যেত না। তবে এও ঠিক যে, মামুনুল হকই একমাত্র ব্যক্তি নন, যিনি অন্যের স্ত্রী নিয়ে রিসোর্টে ঘুরতে গিয়েছেন। বরং এই কাজ আরও বহু লোক করেন; কিন্তু সবার ফোনকল ফাঁস হয় না বা গণমাধ্যমে সরবরাহ করা হয় না।

হেফাজত নেতা মামুনুলের ফোনালাপ ফাঁসে হয়তো অনেকে খুশি; কিন্তু যখন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ফোনালাপ ফাঁস হয়েছিল, তখন কি সবাই খুশি হয়েছিলেন? এখন যারা মামুনুলের ফোনালাপ ফাঁসে খুশি, ভবিষ্যতে তারা অন্য কোনো দলের বা আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে বর্তমানে ক্ষমতাসীন কোনো নেতার ফোনালাপ ফাঁস হলে, তারা কি খুশি হবেন বা তখন তাদের প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান কী হবে? 

সুতরাং কার ফোনালাপ ফাঁস হলো, সেটি বিবেচ্য নয়। মূল আলোচনাটি হওয়া উচিত প্রক্রিয়া ও প্রবণতা নিয়ে। আজ যিনি ফোনালাপ ফাঁসে খুশি, কাল যেন তাকে বেজার হতে না হয়, সেরকম একটি আইনি কাঠামো গড়ে তোলা এবং একটি মানবিক ও সহনশীল রাষ্ট্র গড়ে তোলাই দায়িত্ববানদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। 

পরিশেষে, মোবাইল ফোনে প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ কথা বলেন। নিশ্চয়ই সবার কথা রেকর্ড হয় না বা সেটি সম্ভবও নয়; কিন্তু অনেকের কথাই রেকর্ড হয়। যারা রেকর্ড করেন, নিশ্চয়ই তাদের কাছে বিশাল ডাটাবেজও আছে। অনেক সময় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরেও এটি প্রয়োজন; কিন্তু যখন গণমাধ্যম এসব ফোনকল প্রচার করে বা করতে বাধ্য হয়, তখন গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এমনিতেই নানা কারণে গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা দিন দিন কমছে। বিপরীতে প্রভাবশালী হয়ে উঠছে সোশ্যাল মিডিয়া। ফলে মূলধারার গণমাধ্যমকে যখন সোশ্যাল মিডিয়ার হাজারো অপপ্রচার ও গুজবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সঠিক বা বস্তুনিষ্ঠ তথ্যটি দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, পেশাদারিত্ব বজায় রাখা এবং সেই সঙ্গে নিজেদের কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা দিতে গিয়ে নানারকম বাধা অতিক্রম করতে হচ্ছে, তখন এ জাতীয় ফোনালাপ ফাঁসের ব্যাপারে কোনো ধরনের প্রশ্ন তোলাও এখন তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh