খ্রিস্টান উগ্রপন্থা জেঁকে বসেছে যুক্তরাষ্ট্রে

রাবেয়া আশরাফী পিংকি

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৪৭ এএম

 সপ্তাহে একবার অথবা একবারের বেশি চার্চে আসেন, এমন শ্বেতাঙ্গ অনুসারীদের ৫০ শতাংশই বিশ্বাস করেন ট্রাম্প স্বয়ং ঈশ্বরের মনোনীত।  ফাইল ছবি

সপ্তাহে একবার অথবা একবারের বেশি চার্চে আসেন, এমন শ্বেতাঙ্গ অনুসারীদের ৫০ শতাংশই বিশ্বাস করেন ট্রাম্প স্বয়ং ঈশ্বরের মনোনীত। ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা ভোট চুরি করেছে, এমন অভিযোগ তুলে দেশটির আইনসভা ‘ক্যাপিটল ভবন’- এ হামলা চালায় সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা। 

এই হামলাকারীদের দলে ছিলেন আলাবামার বাসিন্দা জশোয়া ম্যাথাও ব্ল্যাক। ক্যাপিটল হিলে বেআইনিভাবে প্রবেশের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে গত ৮ জানুয়ারি ইউটিউবে একটি ভিডিও পোস্ট করেন তিনি। গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের কাছে আত্মসমর্পণের কয়েক ঘণ্টা আগে এই স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিওটি রেকর্ড করেন ব্ল্যাক। 

ক্যাপিটল ভবনে প্রবেশের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমি (ক্যাপিটল হিলের) ভেতরে প্রবেশ করতে চেয়েছিলাম, যাতে করে যিশুর জন্য রক্ত প্রার্থনা করতে পারি। আমি ভেতর থেকে অনুভব করছিলাম প্রভু আমাকে সিনেট কক্ষে যেতে বলেছেন।’ 

ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করে চলেছেন এমন ধারণা থেকে ব্ল্যাক যদি ক্যাপিটল ভবনে ঝড় তুলতেন তাহলেও অবাক হওয়ার মতো কিছু ছিল না। কারণ তিনি গত চার বছর ধরে শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ও ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্বগুলোর মধ্যে চলমান এক জটিল সম্পর্ককে অনুসরণ করছিলেন। গত বছরের গ্রীষ্মে খ্রিস্টিয়ানিটি টুডের ধর্মপ্রচারক ও কন্সপারেন্সি থিওরির মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি সবার সামনে নিয়ে আসে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্ম নির্বিশেষ আমেরিকার অর্ধেক নাগরিকই কমপক্ষে একটি করে কন্সপারেন্সি থিওরিতে বিশ্বাস করে। অতিপ্রাকৃত বিষয় ও ভালোর বিপরীতে শয়তান ধরনের মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে ধার্মিক ব্যক্তিরা কন্সপারেন্সি থিওরির প্রতি আরো সংবেদনশীল হয়ে থাকেন। 

২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মযাজকরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেন যে, তাদের দলের সদস্যরা তাদের দর্শনের সঙ্গে কন্সপারেন্সি থিওরিগুলো খুব দ্রুত একত্রিত করে ফেলছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্লানডেমিকের মতো ডকুমেন্টারি শেয়ার করছে, যেখানে গতানুগতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে অবিশ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে এবং কিউঅ্যানন কন্সপারেন্সি থিওরিগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে। এই থিওরিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজাতদের পরিচালিত যৌন পাচারকারী নেটওয়ার্ক ধ্বংসকারী গুপ্ত বাহিনীর নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সাউদার্ন ব্যাপিস্ট কনভেনশনের হয়ে জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থা লাইফওয়ে রিসার্চ জানিয়েছে, জানুয়ারিতে ৪৯ শতাংশ ধর্মযাজক তাদের সদস্যদের কাছ থেকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো শুনেছিলেন। 

২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে ব্যাপক সমর্থন দিয়েছেন। ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখনো এই ধর্মপ্রচারকদের পাশে পেয়েছেন। সপ্তাহে একবার অথবা একবারের বেশি চার্চে আসেন, এমন শ্বেতাঙ্গ অনুসারীদের ৫০ শতাংশই বিশ্বাস করেন ট্রাম্প স্বয়ং ঈশ্বরের মনোনীত। ২০২০ সালের নির্বাচনী প্রচারণার পুরো সময়টিতেই বাইডেনের বিশ্বাসে আঘাত করতে ধর্মপ্রচারকদের সমর্থন পেয়েছেন। ধর্মপ্রচারকরা দাবি করেছেন যদি প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেন বিজয়ী হন তাহলে ‘ঈশ্বর বলে কেউ নেই।’ 

প্রেসিডেন্ট হিসেবে চার বছর দায়িত্বপালনকালে ট্রাম্পের গৃহীত নীতিমালাগুলো শ্বেতাঙ্গ ধর্মপ্রচারক খ্রিস্টানদের মধ্যে অনুরণিত হয়েছে। বিশেষ করে জীবনপন্থী আন্দোলনে ট্রাম্পের সমর্থন ও রক্ষণশীল বিচারক নিয়োগের মতো নীতিগুলো ছিল চোখে পড়ার মতো।  

কিউঅ্যানন কন্সপারেন্সি থিউরিগুলো খ্রিস্টধর্মের জন্য কিছু না হলেও ধর্মপ্রচারক খ্রিস্টানরা অস্বাভাবিক উৎসাহ নিয়ে ভিত্তিহীন দাবি করতে থাকে। ক্যাপিটাল ভবনে হামলার আগে ও পরের দিনগুলোয় কিউঅ্যানন থিউরি সমর্থনকারীদের তাদের কর্মকাণ্ডের পক্ষে টুইটার ও যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রোব্লগিং ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সার্ভিস পার্লারে বাইবেলের বিভিন্ন অংশ পোস্ট করতে দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনাপ্রধান মাইকেল ফ্লিন ছিলেন ট্রাম্পের শক্তিশালী সমর্থকদের একজন ও কিউঅ্যানন থিওরিগুলোর একজন শীর্ষস্থানীয় প্রবক্তা। তিনি ট্রাম্পকে জাতির মুক্তিদাতা হিসেবে উল্লেখ করে গত ১০ জানুয়ারি পার্লারে একটি পোস্ট প্রকাশ করেন। 

মহামারির শুরু থেকেই আমেরিকানদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে কিউঅ্যানন পোস্টের সংখ্যা ফেসবুকে ১৭৫, ইনস্টাগ্রামে ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ ও টুইটারে ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে যায়। এই সংখ্যাগুলো আমাদের একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করিয়ে দেয় যে, ধর্মপ্রচারক খ্রিস্টানদের একটি বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে কিউঅ্যানন কন্সপারেন্সির গভীরতা ছড়িয়ে দিতে চাইছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব ও সিঙ্গাপুর ব্যক্তিদের চরমপন্থা থেকে (বিশেষ করে ইসলামপন্থী চরমপন্থা) উত্তরণে সহায়তা করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ পরখ করে দেখেছে। অগণিত কৌশল ও কর্মসূচির মধ্যে কার্যক্রমের মধ্যে সম্মিলিত উন্নয়নের ব্যবহার, পুনরায় সম্প্রদায় একত্রীকরণ, আদর্শগত সংস্কার ও মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ প্রদান উল্লেখযোগ্য। গত দুই দশক ধরে এই দেশগুলোর সরকার ইসলামপন্থী উগ্রবাদের বিস্তার দমাতে যেমন কার্যক্রম পরিচালিত করেছে, তেমনি তাদের এখন খ্রিস্টান মৌলবাদ রুখতেও কাজ করতে হবে। 

এফবিআই ও সমাজবিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে, অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসীরা বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের পরিচালিত সহিংসতা আল কায়েদা অথবা ইসলামিক স্টেটের মতো ইসলামপন্থী উগ্রবাদীদের কর্মকাণ্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সদ্য উদাহরণ হচ্ছে, ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসী হামলা। এ হামলায় ৪৯ জন মুসলিম ধার্মিক প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে, কোস্টগার্ড লেফটেন্যান্ট ক্রিস্টোফার হ্যাসনের ঘটনা। হ্যাসন ‘শ্বেতাঙ্গদের জন্মভূমি’ গড়ার উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মজুদ করেছিলেন ও হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিসহ উচ্চপদস্থ ডেমোক্রেটদের নিশানা করে তিনি একটি ডিজিটাল স্প্রেডশিট তৈরি করেছিলেন। এ অবস্থায় দেশের ভেতরে সন্ত্রাসী হুমকিগুলো প্রতিরোধে মার্কিন সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

ইসলামপন্থী উগ্রবাদীদের দমাতে রেডিকালাইজেশন প্রতিরোধ কৌশলের ওপর ঐতিহাসিকভাবেই নির্ভরশীল। তবে অন্যদের অবনতি ঘটাতে উগ্রপন্থী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সংশোধনের চেষ্টা না করে বরং দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়।

এ দিকে যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই ডিরেডিকালাইজেশন কর্মসূচি চালু করতে হলে অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের মতো নতুন হুমকির পরিবেশের মোকাবিলা করতে হবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh