আফগান শান্তি সুদূর পরাহত

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২১, ১১:০০ এএম

আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালানোর প্রায় ২০ বছর পর দেশটি থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। 

২০০১ সালে যে ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠী তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল তারা, এবার শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে কার্যত তাদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দেয়া হচ্ছে। কারণ তালেবানকে কখনোই নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। গত কয়েক বছরে ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি করেছে এবং হামলা চালিয়ে গেছে তারা। 

কথিত শান্তি চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের মে মাসের আগেই যদি মার্কিন সেনারা দেশে ফিরে যায়, তাহলে আফগান সরকারের পতন হয়ে পড়বে সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর এতে যে শান্তি আসবে না, তা হলফ করেই বলে দেয়া যায়।

আফগানিস্তানে বর্তমানে মার্কিন সেনাসহ প্রায় ১০ হাজার বিদেশি সেনা আছে। তাদের প্রত্যাহার করা হলে তালেবানরা ফের ক্ষমতায় ফিরে আসবে, এই আশঙ্কায় আফগানিস্তানের ভেতরে ও বাইরে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের দাবি, বিদেশি সেনা প্রত্যাহার মানে দেশটিতে তালেবান আরো শক্তিশালী হবে। কারণ এখনই আফগানিস্তানের অর্ধেকের বেশি এলাকা তালেবানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আফগানিস্তান পুনর্গঠন-বিষয়ক বিশেষ পরিদর্শক জন সোপকো। তিনি বলেছেন, ‘আফগান সরকার ও তালেবানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি ছাড়া মার্কিন সেনাদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেয়া হবে একটি বিপর্যয়।’ 

প্রতিনিধি পরিষদের একটি কমিটিকে তিনি আরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড়া আফগানিস্তান সরকার কয়েক মাসের মধ্যেই সম্ভবত যে কোনো বিমান উড়ানোর সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলবে। এক পর্যায়ে হয়তো তাদের পতন ঘটবে।’

উল্লেখ্য, গত বছরের ফেব্রুযারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের একটি ‘শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই চুক্তিতে বলা হয়, যদি তালেবান তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটোর মিত্ররা ১৪ মাসে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেবে। ওই প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে- তালেবান তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলোয় আল-কায়েদা বা অন্যান্য জঙ্গিদের ভিড়তে দেবে না এবং তারা জাতীয় শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবে। বিদেশি সেনাদের ওপর আক্রমণ করবে না। 

শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে তালেবান যোদ্ধারা আফগান সৈন্যদের ওপর প্রায় নিয়মিত হামলা চালিয়ে গেলেও, হামলা চালায়নি মার্কিন ও ন্যাটো সেনা বহরে। গত মাসে মস্কো আলোচনায় তালেবান প্রতিনিধি সে বিষয়টিও পুনর্ব্যক্ত করেছেন মিডিয়ার সামনে। 

বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের আগেই আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যে শান্তি চুক্তি সম্পাদনে চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি মাসে তুরস্কের আমন্ত্রণে ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যে শান্তিচুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার কথা। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আগেই কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়। এর মধ্যে তালেবানের প্রতিনিধিসহ দেশটির কর্মকর্তাদের নিয়ে অন্তর্বর্তী প্রশাসন গঠনের মাধ্যমে নতুন আইনি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা অন্যতম। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। তালেবানও শরিয়াহ আইনের ভিত্তিতে তাদের ক্ষমতা পোক্ত করার বিষয়টি ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে।

মস্কোতে আফগান সরকার ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার পর তালেবান প্রতিনিধি দলের সদস্য সুহেইল শাহীন বলেছেন, ‘শান্তি চুক্তির শর্ত হিসেবে মে মাসের মধ্যে সব মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্য আফগানিস্তান ছেড়ে যাওযার কথা। আমরা আশা করি, শান্তি প্রক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য এটিই একমাত্র পথ, যা সবাই এগিয়ে নিয়ে যাবে। তবে সৈন্য প্রত্যাহার করতে যদি মে মাস পার হয়ে যায়, তাহলে এটিকে আমরা চুক্তির লঙ্ঘন বলে মনে করব এবং তার ভয়াবহ পরিণতি সবাইকে ভোগ করতে হবে।’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, মে মাসের মধ্যে সব মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করার বিষযটি তাদের বিবেচনাধীন রয়েছে। তবে তিনি এ সময়ে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেননি।

তালেবানের প্রতিনিধি মো. নাঈম বলেন, ‘শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা আফগানিস্তানে শান্তি অর্জন করতে বদ্ধ পরিকর ও পরবর্তী ধাপে সেখানে সম্পূর্ণ ইসলামিক শরিয়া আইন মোতাবেক পরিচালিত একটি সরকার গঠন করা হবে।’ 

যদিও যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা আফগানিস্তানের আবার ইসলামী সরকার গঠনের পক্ষে নয়। তবে সে ব্যাপারে কান দিতে নারাজ তালেবান প্রতিনিধিরা। তাদের সাফ বক্তব্য, ‘আফগানিস্তানের ভবিষ্যত কোন দিকে যাবে, তা ঠিক করা অন্য কোনো দেশের কাজ না, সেটি ঠিক করবে আফগানিস্তানের জনগণ। তাদের নিজের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।’

শরিয়া আইন মোতাবেক পরিচালিত সরকার আফগানিস্থানে নারীদের শিক্ষা অর্জন করতে বাধা দেবে কি-না, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের অধিকার থাকবে কি-না- এমন সব প্রশ্নের জবাবে তালেবান মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা নারীদের শিক্ষা অর্জনে বাধা দেব না; বরং উৎসাহিত করব। নারীরা নির্ভয়ে চাকরি করতে পারবেন। এমনকি তারা যেকোনো আদালতের বিচারক পর্যন্ত হতে পারবেন। তবে কোনো নারীকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট করা যাবে না।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, বিদেশি সেনা প্রত্যাহার মানে দেশটিতে তালেবান আরো শক্তিশালী হবে। মার্কিন সিনেটর লিন্ডসি গ্রাহাম বলেছেন, ‘মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে আফগানিস্তান সন্ত্রাসীদের স্বর্গে পরিণত হবে। আমরা আরেকটি ৯/১১-এর পথ পরিষ্কার করছি।’ 

মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছে, এ অবস্থায় কোনোরকম ছাড় দিতে তালেবান স্বাভাবিকভাবেই উৎসাহী নয় বলে মন্তব্য করেছে মার্কিন রাজনৈতিক পত্রিকা পলিটিকো। তালেবান হামলার তীব্রতা বাড়িয়ে আফগান সরকারকে কোনঠাসা করতে চাইছে। 

এদিকে, ২০১৯ সালে আফগানিস্তানের বেকারত্বের হার ছিল ২৩.৯ শতাংশ, যেখানে ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭.৯ শতাংশ। এই বেকারত্বও তরুণদের সহিংসতার দিকে টেনে নেয়ার একটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কাবুলের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ওয়াহিদ মুজদা বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে তালেবান তো আরো শক্তিশালী হবেই। এমনকি দেখা যেতে পারে, পরবর্তীতে আফগান সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনায় যেতেই রাজি হবে না তারা।’

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি পর্যবেক্ষক দলের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালে আফগান নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল দুই লাখ ২৭ হাজার। এখন তা নেমে এসেছে দুই লাখ আট হাজারে। গত বছরের শেষ তিন মাসে দুই হাজার ৫৮৬ জন বেসামরিক মানুষ তালেবানের আক্রমণে হতাহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৮১০ জন নিহত ও এক হাজার ৭৭৬ জন আহত হয়েছেন। এখন সহিংস আক্রমণ শুধু তালেবানই করছে না, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং তালেবানের অন্য একটি অংশ, যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনার বিরুদ্ধে। তারাও বেসামরিক আফগানদের ওপরই হামলা চালাচ্ছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শান্তি প্রক্রিয়ার মাঝেই বিভিন্ন ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী তাদের শক্তি প্রদর্শন করছে। আফগান সিভিল সোসাইটি ফোরামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজ রাফি বলেন, ‘চলমান শান্তি আলোচনার মধ্যে হামলা কমে আসবে বলে আমরা মনে করি না; বরং রক্তপাত আরো বেড়ে যেতে পারে।’ 

উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে সহিংসতার মাত্রা ক্রগাগত বাড়ছে। সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট, রাজনীতিবিদ ও নারী কর্মকর্তা ও বিচারকদের লক্ষ্য করে হত্যা করা হচ্ছে। এ নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে যাক, বা ভিন্নমত প্রকাশিত হোক, সেটি তালেবান সহ্য করে না। ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের শাসন কাঠামোতেও যেকোনো ভিন্নমত তারা নৃশংসভাবে দমন করেছে। সেখানে না ছিল নারীর কোনো অধিকার, না ছিল মিডিয়া। আগামী দিনে ক্ষমতায় এলে তারা তেমন একটি উগ্রবাদী কাঠামোই গড়তে চায়, যে আকাক্ষার কথা তারা কোনো রাখঢাক ছাড়াই উল্লেখ করে। 

এ অবস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেও দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। যে কাঠামোকে সমালোচনা করে আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে পশ্চিমা গণতন্ত্রের মূলা ঝুলিয়ে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র, এখন সেই মূলা গাছসহ উপড়ে নিয়ে আফগানিস্তান ছাড়ছে তারা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh