অলকানন্দা রায়
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২১, ০৪:৫৪ পিএম | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২১, ০৫:১৮ পিএম
হাজার হাজার বছর ধরে নানা নৃ-তাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী ও শাখা-গোষ্ঠী, নানা শ্রেণির মিলন, পারস্পরিক প্রভাব এবং সমন্বয়ের ফলে গড়ে উঠেছে বঙ্গীয় সংস্কৃতি। বহু শতাব্দী ধরে সংস্কৃতির বিভিন্ন, এমনকি পরস্পর-বিরোধী উপাদানের সহাবস্থান এবং সমন্বয়ের ফলে বঙ্গীয় অঞ্চলে বাঙালিত্বের এমন এক বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে যাকে বলা যায় বঙ্গীয় সংস্কৃতি এবং এক কথায় বলা যায় বঙ্গদেশ ও বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি।
বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তি বঙ্গীয় সংস্কৃতি। বাংলাদেশ এবং বাংলাভাষীদের সংস্কৃতি, সে কারণে ‘বাঙ্গালা’ নামে একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল গড়ে ওঠার আগে অথবা বাংলা ভাষা পুরোপুরি বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করার আগেকার আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে বাঙালি সংস্কৃতি বলে অন্তত তত্ত্বগতভাবে আখ্যায়িত করা যায় না। আবার এটাও ঠিক যে, সুলতানি আমলের বাঙ্গালা রাজ্য অথবা বাংলা ভাষা গড়ে ওঠার মুহূর্ত থেকে বাঙালি সংস্কৃতির জন্ম হয়নি। বঙ্গীয় সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে উঠেছিলো আরো অনেক আগে থেকে।
ইতিহাস মতে ১২০৪ সালের আগে, অঞ্চল, ভাষা বা সংস্কৃতির বিচারে, জাতি হিসেবে বাঙালির কোনো আলাদা পরিচয় গড়ে ওঠেনি। সে সময় বেঙ্গল বা বাংলা বলে কোনো অঞ্চল ছিল না। পরবর্তীকালেও বাংলা বলতে যে অঞ্চল বোঝাত, তা বহু রাজত্বে বিভক্ত ছিল। পাল রাজত্বের দীর্ঘস্থায়িত্বেও তা বজায় ছিল। কিন্তু বাংলা বলতে যে অঞ্চলকে আমরা বুঝি তা রূপ পেয়েছিল ১২০৪ সালের পর। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের কয়েক যুগ পর অঞ্চল হিসেবে বাংলা এক কেন্দ্রীয় শাসনাধীন হয়। যদিও একটা সময় সোনারগাঁ গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব নিয়ে ছিল, চট্টগ্রাম বা ত্রিপুরাকে দীর্ঘকাল বাংলার অংশ বলে ধরা হতো না। কিন্তু এই ভূ-ভাগের অধিকাংশ অঞ্চল একই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বাঙালি সভ্যতার প্রধান কান্ডারি কৃষি। সমাজতাত্ত্বিক ও নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণায় এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, কৃষিসভ্যতা মাতৃতান্ত্রিক। যদিও বাণিজ্যের খবরও ইতিহাসে-গল্পে কিংবদন্তিতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। তবু বাঙালি সংস্কৃতি কৃষি নির্ভর আর তাই বাঙালি সংস্কৃতি নারী-স্বাধীনতার পক্ষশক্তি; আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতির ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে আমরা এ কথার প্রমাণ পাই। নারীর সমুন্নত মর্যাদার কথা এমন কি কখনো কখনো নারীর মর্যাদা খানিকটা বেশি বলে মনে করারও যৌক্তিকতা আছে বাঙালি সংস্কৃতির মজ্জায়।
সংস্কৃতি বা কৃষ্টি হলো সেই জটিল সামগ্রিকতা যাতে অন্তর্গত আছে জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিল্প, আইন, আচার এবং সমাজের একজন সদস্য হিসেবে মানুষের দ্বারা অর্জিত অন্য যে কোনো সম্ভাব্য সামর্থ্য বা অভ্যাস। এক কথায় বললে সংস্কৃতি হচ্ছে চেতনা বা মানসিকতার ব্যাপার, আর এই চেতনা বস্তুভিত্তি থেকে জন্মায়। বস্তুর প্রভাবে সংস্কৃতি অস্তিত্বমান, জাগ্রত ও ক্রিয়াশীল। মানুষের সব চিন্তা-ধ্যান-ধারণা, আচরণ ও কর্মের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে। সংস্কৃতি বাস্তব প্রয়োজনে জন্মে; দানা বাঁধে এবং জীবন সংগ্রামের শক্তি-সামর্থ্যের জোগান দেয়। জীবনযাত্রায়, জীবন চলার পথে ঘাত-প্রতিঘাতে সংস্কৃতির রূপ-রঙ্গ পরিবর্তিত হয়। গোপাল হালদার তার সংস্কৃতির রূপান্তর গ্রন্থে বলেন, ‘মানুষের জীবন-সংগ্রামের বা প্রকৃতির ওপর অধিকার বিস্তারের মোট প্রচেষ্টাই সংস্কৃতি’। অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি সমাজ কাঠামো তথা উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদন পদ্ধতিকে নির্ভর করে গড়ে ওঠে। মার্কসীয় দৃষ্টিতে সংস্কৃতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সমাজ কাঠামো একটি কেন্দ্রীয় প্রত্যয়। জীবন যেমন এক জায়গায় থেমে থাকে না, স্বাভাবিকভাবেই সমাজও এক স্তর থেকে অন্য স্তরে পা রাখে। ঘূর্ণায়মান যন্ত্রের মতো তার দৃশ্য পালটায়। দৃশ্য বলতে বোঝায় বিশ্বাস-ধর্ম-কর্ম-মূল্যবোধ, সর্বোপরি জীবন সংগ্রামের সবকিছুই।
১৩৫০-এর দশকে গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁ জয় করে ‘শাহ-ই বাঙালিয়ান’ অর্থাৎ বাঙালিদের শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। বৃহত্তর ‘বাঙ্গালা’র জন্ম তার আগে হয়নি। অন্য দিকে, বাংলা ভাষাও আবার মোটামুটি ওই সময়েই নিজের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে স্বতন্ত্র ভাষার রূপ লাভ করে। দু’দিক থেকেই বিবেচনা করলে বঙ্গীয় সংস্কৃতির বয়স তাই আট’ শো অথবা বড়জোর এক হাজার বছর। এর চেয়ে একে পুরানো বলে গণ্য করা যায় না। কিন্তু এই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলের হাজার হাজার বছরের পুরানো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে। একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় যে, খাদ্যাভ্যাসের কারণে বাঙালিদের নাম ‘ভেতো’ বাঙালি। আর্য অথবা মুসলমানরা এ দেশে ধান আনেননি, ধানের চাষ এ অঞ্চলে আরম্ভ হয়েছিল অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগে। পরে কখনো আর্য, কখনো সেন, কখনো তুর্কি, কখনো আফগান, কখনো মোগল এবং সবশেষে ইংরেজরা বঙ্গভূমি দখল করেছেন, তবু বাঙালিদের ভাত খাওয়ার অভ্যাসে পরিবর্তন হয়নি। ভাত বাঙ্গালীর একটি সাংস্কৃতিক ভিত্তি।
বঙ্গদেশের সবচেয়ে পুরানো যে রাজার কথা নিশ্চিতভাবে জানা যায়, তাঁর নাম শশাঙ্ক। সপ্তম শতাব্দীর এই রাজা ছিলেন হিন্দু। তারপর আসে বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক পাল এবং পাল রাজাদের পরে সেন বংশ ক্ষমতায় বসে সেনরা, তদুপরি, বর্ণভেদ প্রথাকে কঠোরভাবে প্রচলিত করেন এবং সংস্কৃত শাস্ত্র ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষণা করেন।
১২০৪ সালে লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বখতিয়ার খলজী মুসলিম শাসন প্রবর্তন করলে পরিবর্তনের আরও একটা ঢেউ আসে। খলজীর পরপর বঙ্গভূমিতে এসেছিলেন অনেক মুসলমান ধর্মপ্রচারক ।
বাঙ্গালীর সাহিত্য চর্যাপদকে বাংলার নিদর্শন হিসেবে মেনে নিলে বাংলা সাহিত্যের ঐশ্বর্যমন্ডিত ঐতিহ্য প্রায় হাজার বছরের। অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের মতো বাংলাও তার যাত্রা শুরু করেছিল ধর্মীয় কাব্য দিয়ে, আরও সঠিক করে বললে, ভক্তিবাদী গান দিয়ে। উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত বাঙালি কবিরা তাঁদের নিজেদের ‘মনের কথা’ বলতে গেলে প্রকাশই করেননি। সাহিত্যে আরেকটি ঐতিহাসিক বিকাশ লক্ষ করা যায় তার আঙ্গিকের ক্ষেত্রে। মধ্যযুগে রচিত হয়েছিল কেবল আখ্যানমূলক কাব্য, কিন্তু উনিশ শতকে ইংরেজি সাহিত্য থেকে নতুন আঙ্গিক নিয়ে লেখা হয় মহাকাব্য, পত্রকাব্য, সনেট, খন্ড কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ। বাংলা সাহিত্যের মতো বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে উনিশ শতক থেকে আরম্ভ করে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত সৃজনশীলতার একটা স্ফূরণ ঘটে। ইংরেজি নাটক বাংলায় অনুবাদ করে বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাহায্যে ১৭৯৫ সালের শেষে এবং ১৭৯৬ সালের গোড়ার দিকে মঞ্চস্থ করার মাধ্যমে বাঙালি প্রথম নাটক দেখে। ব্রিটিশ আমলে বঙ্গদেশে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে। এই শ্রেণিও গড়ে উঠেছিল উপনিবেশিক কারণে। উপনিবেশিক আমলে বাঙালি সমাজের অগ্রগতি হয়েছিল অসমানভাবে এবং প্রধানত সমাজের ওপর তলার লোকেরাই এর ফলে উপকৃত হয়েছিলেন। তারপরেও উনিশ শতকের সমাজ এবং সংস্কৃতির অনেক দিকেই সৃজনশীলতার একটা অসাধারণ স্ফূরণ ঘটেছিলো। বিশেষ করে ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাটকসহ প্রদর্শনমূলক শিল্পকলা, স্থাপত্য, ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার, এমন কি, অনেক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেও এই স্ফূরণ লক্ষ করা যায়। রেনেসাঁর কেবল দুটি দিকের কোনো বিকাশ এ সময়ে তেমন দেখা যায় না- চিত্রশিল্প আর ভাস্কর্যের। ছয় শতাব্দীর মুসলিম শাসন এর আংশিক কারণ হতে পারে। স্থাপত্যেরও সেই অর্থে কোনো পুনর্জাগরণ হয়নি, যা হয়েছিল, তা হলো বিশেষ করে কলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্য স্থাপত্যের বিকাশ।
তথ্যসূত্র: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বাঙ্গালীর সংস্কৃতি, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৮; শিবনারায়ণ রায়, বাঙালিত্বের খোঁজে এবং অন্যান্য আলোচনা, কলকাতা: দেজ পাবলিশিং, ২০০৪; মুহাম্মদ এনামুল হক, বঙ্গে সূফী-প্রভাব, কলকাতা, মহসিন অ্যান্ড কোং, ১৯৩৫; নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস, কলকাতা: দেজ পাবলিশিং, ২০০১; গোপাল হালদার, গোপাল হালদারের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, কলকাতা: কলকাতা, নবার্ক, ১৯৮৫; গোলাম মুরশিদ, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, ঢাকা: অবসর, ২০০৬।