বাঙালির সম্প্রীতির উৎসব মেলা

অলকানন্দা রায়

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৩৭ পিএম

‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী; কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথাগুলো মিলে যায় বাঙালির সম্প্রীতির উৎসব ‘মেলার’ ক্ষেত্রে। 

কবে, কোথায়, কখন প্রথম মেলার প্রচলন হয়েছিল তা জানা না গেলেও এটি যে আবহমান বাংলার এক প্রাচীন ঐতিহ্য এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ধারণা করা হয়, গ্রামীণ হাট থেকেই আসে মেলার ধারণা। অতীতে রাজা-জমিদাররা মেলার আয়োজন বা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ধর্মীয় কোনো উপলক্ষে মেলা বসত। তাই বাংলার বারো মাসের তেরো পার্বণের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মেলা। বৈশাখ থেকে চৈত্র প্রতি মাসেই মেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এক সময় পীর-ফকির বা সাধু-সন্ন্যাসীদের আস্তানাগুলোও মেলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ধর্মীয় চেতনার বাইরে অন্যান্য সামাজিক বা লৌকিক আচারগুলোও যুক্ত হতে থাকে মেলার সঙ্গে। 

বাঙালি উৎসবমুখর জাতি। বাঙালি অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক। আর তাই বাঙালির যে কোনো উৎসবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনতার ঢল নামে। বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্র-সম্প্রদায়ের সবার অংশগ্রহণে এখানে অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। 

বছরের নানা সময়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে উৎসবকেন্দ্রিক ‘মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ‘মেলা’ বাঙালির লোক-ঐতিহ্যের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হলেও নির্দিষ্ট কিছু মেলা জাতির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে। বাঙালির লোকসংস্কৃতির মেলার সেরা ‘বৈশাখী মেলা’। বছরের প্রথমদিন নতুন জামা-কাপড় পরে বৈশাখী মেলায় যাবার এই রীতি বাংলার বিভিন্ন জনপদে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সুদীর্ঘকাল থেকে। ধারণা করা হয়,  সম্রাট আকবর ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে হিজরি, চন্দ্রাসন ও ইংরেজি সৌর সনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত করেন। নতুন সনটি প্রথমে ফসলি সন নামে পরিচিত থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিতি পায়। সে সময় বাংলার কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীদের খাজনা পরিশোধ করত।

এ উপলক্ষে তখন মেলা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। পরবর্তী সময়ে বৈশাখ উপলক্ষে যে মেলার আয়োজন করা হতো, সেই মেলাকে ‘বৈশাখী মেলা’ নামকরণ করা হয়। সুতরাং বৈশাখী মেলার সূচনার সঠিক তারিখ নির্ধারণ করা না গেলেও এ মেলা যে বাংলা বঙ্গাব্দ পালনের সূচনা থেকেই সূচিত হয়েছে তাতে সন্দেহ থাকার খুব বেশি অবকাশ নাই। আবার কেউ কেউ মনে করেন ১৮৬৭ সালের ১২ এপ্রিল নবগোপাল মিত্র চৈত্রমেলা নামে যে দেশীয় শিল্পোৎপাদনে উৎসাহ দান, দেশীয় প্রতীকগুলোর প্রতি আনুগত্যকে সামনে রেখে একটি জাতীয় মেলার সূচনা করেছিলেন, যা তিন বছর পর মাঘ মাসে অনুষ্ঠিত হতো, পরে যা হিন্দুমেলার নাম নেয়- সেই মেলার অসাম্প্রদায়িক সংস্করণ আজকের বৈশাখী মেলা। 

মেলার আক্ষরিক অর্থ মিলন। বাঙালির সংস্কৃতির ধারাকে বহমান রাখে মেলা। আর তাই বহমান থাকে লোকসংস্কৃতি। মেলার দুটি দিক-সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক। বগুড়ার গাবতলীর সন্ন্যাসী মেলা বা পোড়াদহ মেলা, মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার উভাজানি গ্রামের রাধা চক্করের মেলা, বরিশালের বিপিনচাঁদ ঠাকুরের মেলা, তাড়াইলের মাঘী পূর্ণিমার মেলা, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাতিসার মেলা, বিক্রমপুরের রামপালের মেলা, নেত্রকোনার চণ্ডীগড় মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাতমোড়ার মেলা, পিরোজপুরের খারবাক মেলা, রংপুরের সিন্দুরমতি মেলা, ধামরাইয়ের রথের মেলা, পটিয়ার ঠেগড়মুনির মেলা, পাবনার বোঁথরের চড়ক মেলা, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের বারুণী মেলা, ইছামতী নদীতীরের পোড়াদহ মেলা, সুন্দরবনের দুবলার রাসমেলা, কুষ্টিয়ার লালন মেলা ও দোলপূর্ণিমা, খুলনার কপিলমুনির গুড়পুকুরের মেলা, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও আদমপুরের রাস লীলার মেলা, সোনারগাঁয়ের বটতলার বৌ মেলা, নাগেশ্বরীর মাদাইখেলের মেলা, রাজশাহীর পুঠিয়ার রথের মেলা, গাজীপুরের কালীগঞ্জের বিনিরাইলের জামাই মেলার মতো একসময় সারাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৩০০ মেলা অনুষ্ঠিত হতো।

মেলাকে ঘিরে যে আয়োজন তা বহুধা বিস্তৃত এবং বর্ণাঢ্যতায় ভরা শেকড়ের এসব বিনোদন যুগ যুগ ধরে আমাদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ধারাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। সময়ের বিবর্তনে মেলা ও মেলাকেন্দ্রিক উৎসব এখন অনেক বদলে গেছে। তবুও মেলা কেন্দ্রিক উৎসবের আমেজ এখনো কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা যায়। কোথাও কোথাও এখনো কোনো কোনো মেলার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করা হয় বউ-ঝি’দের নাইওরি নেওয়ার জন্য। মেলা উপলক্ষে বিশেষত মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। নতুন জামা-কাপড় দেওয়া হয়, এটা কোনো কোনো এলাকার আঞ্চলিক রীতি যা মেলাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। 

মূলত বৈশাখে বর্ষবরণকে কেন্দ্র করেই মেলা ও নানা মাত্রিক উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ মাসে মেলার আবেদনটা একটু ভিন্ন; কিন্তু শুধু বৈশাখেই নয়, আমাদের দেশে মেলার পরিধি বর্ষব্যাপী। 

মেলা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটা অংশ, তবু মেলাকেন্দ্রিক কিছু সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এগুলো আমাদের বিনোদন ধারাকে উর্বর করেছে। অধিকাংশ মেলাতেই দেখা যায় জিনিসপত্র বেচা-বিক্রির সঙ্গে চলে যাত্রা প্রদর্শনী, পুতুলনাচ, পালাগান, কবিয়ালদের আসর থেকে শুরু করে বহু কিছু। কারণ, এসব হচ্ছে মেলার বাড়তি আকর্ষণ। মেলা শুধুই কেনাকাটার জায়গা নয়, মেলাগুলো হয়ে ওঠে এক একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিচরণ ক্ষেত্র, সাংস্কৃতিক পরিম-লে এই যে মেলার উপস্থিতি, তার ইতিহাস বেশ পুরনো। 

এখন হাতের কাছেই সব ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা। ইচ্ছেমতো ছবি দেখা, গান শোনা, গেম খেলা, এমনকি ইন্টারনেটের বদৌলতে গোটা পৃথিবী ঘুরে আসাও সম্ভব, আজ থেকে একশ’ বা দুইশ’ বছর আগেও মানুষ কি এ সবের কথা ভাবতে পেরেছে? তবু থেমে থাকেনি মানুষ। বরং যেটুকু উপভোগ করেছে, তা মন-প্রাণ দিয়ে করেছে। আর তাই মেলাকেন্দ্রিক বিনোদনই ছিল তখন সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তরা প্রায় সারা বছর ধরে মেলার অপেক্ষায় থাকতো। মেলার সময় কেনাকাটা বা বেচা-বিক্রি হবে, আমোদ-ফূর্তি হবে। অধিকাংশ পুরনো মেলার স্থান নির্বাচন দেখলে দেখা যায় মেলার স্থানে একটা বটবৃক্ষ আছেই। কেননা সেই সময় বটগাছের ছায়া ও খোলা প্রান্তর, চারদিকে যাতায়াতের জন্য রাস্তা আছে এমন স্থান বাছাই করা হতো মেলার জন্য তাতে মেলাজুড়ে বটগাছের চমৎকার ছায়া পাওয়া যেতো, প্রচলিত অনেক ধ্যান-ধারণা থেকেও মেলার স্থান নির্ধারণ করতে দেখা গেছে। 

মেলাগুলোয় দেখা যায় কুমোররা মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কলসি, বাসন-কোসন, মালসা, সরা, ঘটিবাটি; শিশুদের খেলনা রঙ বেরঙের হাতি-ঘোড়া, নৌকা, পুতুল নিয়ে বসেছে। কাঠমিস্ত্রিরা কাঠের লাঙ্গল-জোঁয়াল, মই, খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, সিন্দুক, পিঁড়ি, বেলনা, লাটাই-লাটিম, খড়ম নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে আছে, কয়েকটি দোকানি বাঁশ- বেতের- কুলা, ডালা, টুকরি, পাখির খাঁচা, দরমা, চাঁটাই, মাদুর, বাঁশি নিয়ে বসে আছে, মেলার একদিকে কামাররা লোহার দা, বটি, খন্তা, কড়াই নিয়ে বসেছে। মেলার একদিকে মন্ডা-মিঠাই, জিলাপি, তক্তি, নাড়ু, চিঁড়া, মুড়ি, বরফি, বাতাসার বিপুল আয়োজন পাশেই আছে নানা রকম তেলেভাজা। এ ছাড়াও শাঁখারি সম্প্রদায় নিয়ে আসে শঙ্খ ও ঝিনুকের শাঁখা, বালা, আংটি, চুড়ি, নাক ও কানের ফুল। কাচের চুড়ি, আয়না, চিরুনি, ফিতা আর পাশাপাশি মৌসুমি ফল তো আছেই। মেলায় বসে খেলনার শব্দময় ঝঙ্কার। রঙিন বাঁশি, ভেঁপু, ডুগডুগি, একতারা, দোতারা, বেলুন, লাটিম, চরকি, টমটম গাড়ি, ঘুড়ি আরও কত কী। 

বাঙালি বার বার বিদেশি শক্তির শাসন-শোষণে, নিপীড়িত-নিঃগৃহীত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-উৎসব পালনে বাঙালি জাতিকে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে যা আজ ইতিহাস। হাজার বছরের বাঙালিয়ানার নিদর্শন মেলা। মেলা ছাড়া বাঙালিত্ব যেন পূর্ণতাই পায় না। মেলায় বাঙালির চেয়ে খুশি আর বুঝি কোনো জাতি হয় না। সব অশুভ তৎপরতা কাটিয়ে বাঙালির সম্প্রীতির মিলন উৎসব মেলা আরও লাখ বছর বেঁচে থাকুক তার স্বতন্ত্র ঐতিহ্য নিয়ে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh