নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় পুতিন

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২১, ১০:৩৭ এএম

ভ্লাদিমির পুতিন

ভ্লাদিমির পুতিন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শুধু সংবিধান সংশোধন ও আইন করে আজীবন ক্ষমতাসীন থাকার পথই বের করেননি, একইসাথে ভিন্নমত দমনেও তিনি সিদ্ধহস্ত। 

অনলাইনসহ সব ধরনের মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বন্দি করা, বা ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘বিদেশি চর’ বলে প্রপাগান্ডা চালানো- এসব কাজ রাশিয়ায় বেশ সফলভাবেই করছে ক্ষমতাসীন সরকার। সেখানে রাষ্ট্র, সরকার ও পুতিন হয়ে উঠেছে এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা।

সাংবিধানিক কর্তৃত্ববাদ

গত ৬ এপ্রিল রাশিয়ার সরকার প্রেসিডেন্টের মেয়াদ সংক্রান্ত এক আইনে পুতিনের স্বাক্ষর করার কথা জানিয়েছে। নতুন আইনের ফলে পুতিন চলতি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নির্বাচনের মাধ্যমে আরো দুই দফা প্রেসিডেন্ট পদে থাকার সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ বলা যায়, ২০৩৬ সাল পর্যন্ত রাশিয়ায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকার ব্যবস্থা পোক্ত করেছেন পুতিন। 

আইন অনুযায়ী, পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। ২০২৪ সালে পুতিনের চলতি শাসনামল শেষ হবে। পরের মেয়াদে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। তবে এই আইন ও গত বছরের সংবিধান সংশোধনীর ফলে এখন ২০২৪ সাল থেকে আবার নতুন করে নির্বাচনী মেয়াদের গণনা শুরু হবে। তাই ধরে নেয়া যায়, আজীবন প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকছেন পুতিন।

এর আগে ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন সংবিধান সংশোধনের ঘোষণা দেন। এরপর গত বছরের ২০ জানুয়ারি তিনি পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষ ডুমায় সংশোধনী প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। ওই প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধানের ১৪টি ধারায় পরিবর্তন আনা হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপনের সময়ই পুতিন গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট রুশ পার্লামেন্ট ও আদালতে তার প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ায় আইনত গণভোটের আয়োজন না করলেও চলত। তবে পরবর্তীকালে এ সংশোধনী যেন প্রশ্নের মুখে না পড়ে, সেজন্য গণভোটের মাধ্যমে এর স্থায়ীকরণ নিশ্চিত করা হয়। 

রাশিয়ার নির্বাচন কমিশন জানায়, গত বছর সপ্তাহব্যাপী (২৫ জুন থেকে ১ জুলাই) চলা গণভোটে অংশগ্রহণকারী ভোটারদের প্রায় ৭৮ শতাংশ ওই সংবিধান সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। যদিও অভিযোগ রয়েছে, ওই গণভোটে প্রচুর কারচুপি করা হয়। 

সংবিধান সংশোধনে প্রধানভাবে যে বিষয়গুলো যুক্ত হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে- সাংবিধানিকভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করাকে স্বীকৃতি; সমলৈঙ্গিক বিয়ে নিষিদ্ধ; রাশিয়াজুড়ে রুশ ভাষা ও ইতিহাসের বিকাশে সাংবিধানিক স্বীকৃতি; আন্তর্জাতিক আইনের ওপর রাশিয়ার আইনকে প্রধান্য দেয়া; সরকারি কর্মচারীদের অন্য দেশের নাগরিকত্ব থাকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা; প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে হলে নির্বাচনের আগে অন্তত ২৫ বছর রাশিয়ায় বসবাস করার বাধ্যবাধকতা, আগে এটি ছিল ১০ বছর। 

সংশোধনীতে স্টেট সিকিউরিটি কাউন্সিলকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এ সংস্থাটিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন ‘পুতিনের মিনি সরকার’- রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অতিগুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এ সংস্থা থেকে। 

প্রতিপক্ষ দমন

পুতিন দিন দিন ক্ষমতার পরিধি বাড়িয়েই চলেছেন। ভিন্নমত দমনে একের পর এক সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের মধ্যে যার প্রতিফলন দেখা যায়। পুতিনের কঠোর সমালোচক আলেক্সেই নাভালনির ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল গত বছরের ২০ আগস্ট। ফলে সাইবেরিয়া থেকে আকাশপথে মস্কো যাওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। নাভালনিকে মস্কো শহরের একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে তাকে জার্মানিতে নেওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। 

পরে জার্মান সরকার জানায়, নাভালনির ওপর নোভিচক গ্রুপের নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করা হয়েছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এজন্য রাশিয়া সরকারকে দায়ী করলেও, তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। 

গত ১৭ জানুয়ারি জার্মানি থেকে সুস্থ হয়ে মস্কোর শেরেমেতিয়েভো বিমানবন্দরে নামার পর ৪৪ বছর বয়সী নাভালনিকে আটক করে রুশ পুলিশ। পরে তাকে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেয় রুশ কর্তৃপক্ষ। এরপর এক রায়ে নাভালনিকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ

কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা কাঠামো গড়ে তুলতে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ অনেকটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। ২০১২ সালের ‘বিদেশি চর’ আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিদেশি ও মুক্ত সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় রাশিয়ার সরকার। ২০১৪ সালের সংশোধনীতে বিচার বিভাগকে ক্ষমতা দেয়া হয় বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিওকে ‘বিদেশি চর’ বলে অভিযুক্ত করার। 

আইনটি সংশোধিত আকারে পাস হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই নয়টি মার্কিন সরকারি প্রচারমাধ্যম- রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টি (আরএফই/আরএল), সাতটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এবং ভয়েস অব আমেরিকাকে ‘বিদেশি চর’ আইনে অভিযুক্ত করা হয়। 

এখানেই শেষ নয়। ২০১৯ সালে আইনটি আবারো সংশোধন করা হয়। এবার শুধু প্রতিষ্ঠানই নয়, ব্যক্তিকেও এর আওতায় আনা হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তিন সাংবাদিক, একজন শিল্পী-অ্যাকটিভিস্ট ও ৭৯ বছর বয়সী মানবাধিকারকর্মী লেভ পোনোমারিয়ভকে এ আইনে অভিযুক্ত করা হয়। এর আগে লেভের গড়ে তোলা এনজিও ‘ফর হিউম্যান রাইটস’-এর কার্যক্রমও বন্ধ করা হয়।

চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রচারমাধ্যম আরএফই/আরএলকে দেড় লাখ ডলার জরিমানা করা হয়। মূলত নাভালনির হত্যাচেষ্টা, অন্তরীণ রাখা ও এ নিয়ে গড়ে উঠা আন্দোলন নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জন্যই প্রতিষ্ঠানটিকে ‘বিদেশি চর’ আইনে অভিযুক্ত করা হয় বলে মনে করা হচ্ছে।

রুশ সংস্থা লেভাদা সেন্টার ২০১৯ সালে এক জরিপে জানায়, টেলিভিশনের ওপর রাশিয়ার জনগণের আস্থা কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ সময়ে তথ্যের ইন্টারনেটভিত্তিক উৎসের ওপর রুশদের আস্থা পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। রাশিয়ার ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের ৮২ শতাংশই সংবাদ পেতে ইউটিউবে চোখ রাখছেন। আলেক্সেই নাভালনি খুব ভালো করেই জানেন, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেলে তার খবরাখবর আসার সুযোগ নেই। তাই দুটি ইউটিউব চ্যানেল খুলে তাতে নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রচারণা শুরু করেন। 

ইন্টারনেট সেন্সরশিপ

বিশ্বকে একটি ছোট গন্ডিতে এনে দাঁড় করিয়েছে ইন্টারনেট। তথ্য মানুষের কাছে কম পৌঁছানো যেখানে কর্তৃত্ববাদী কাঠামোর মূল বৈশিষ্ট্য, তাই ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়ে পুতিনের জন্য। সরকারবিরোধী কথাবার্তাকে ‘ফেক নিউজ’ বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা সরকার-সমর্থিত মিডিয়া ও ইন্টারনেটে ব্যাপক প্রপাগান্ডা তো আছেই। 

বছর দুয়েক আগে রাশিয়ায় ফেক নিউজ প্রতিরোধে ‘ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব’ শীর্ষক নতুন আইন পাস হয়েছে। এই আইনের আওতায় যে তথ্যকে সরকারের কাছে মিথ্যা বলে মনে হবে, তা নিষিদ্ধ করে দেওয়া যাবে। এ ছাড়া যে তথ্য জনজীবনে বিশৃঙ্খলা আনতে পারে বলে মনে করবে সরকার, সেটিও নিষিদ্ধ করা যাবে। এর শাস্তি হিসেবে চার লাখ রুবল (রাশিয়ার মুদ্রা) পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ তুলে যেকোনো ওয়েবসাইট ব্লকও করে দিতে পারবে সরকার। এখন পর্যন্ত লক্ষাধিক ওয়েবসাইট কালো তালিকাভুক্ত করেছে রুশ কর্তৃপক্ষ। রুশ তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানায় ঢোকানো হচ্ছে পুতিনের অনুসারীদের। এজন্য বলপ্রয়োগও করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়া হচ্ছে সরকারের হাতে।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেই সোলদাতোভ বলেন, ‘কোনো বিদেশি হুমকি বা ফেসবুক, গুগল ঠেকাতে এই আইন করা হয়নি। ওই কাজ আগের আইনেই করতে পারে রুশ সরকার। বেসামরিক বিক্ষোভের সময় কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ইন্টারনেটের পুরো ট্রাফিক সিস্টেমই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এই আইনের আওতায়। ফলে সরকারবিরোধী প্রচার সহজেই শনাক্ত করে দমন করা যাবে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের পথেই হাঁটতে চাইছে রাশিয়া। তবে রাশিয়ার ক্ষেত্রে সব বন্ধ রাখাটা প্রায় অসম্ভব। কারণ, ইন্টারনেটের বৈশ্বিক অবকাঠামোয় রাশিয়ার বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে বন্ধ করার চেয়ে, বন্ধ হতে পারে- এমন বার্তাই বেশি ভয়ের। রাশিয়া সে পথেই এগিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে অভিযুক্তদের আইনি ও সামাজিকভাবে হেনস্থা করাও নিয়ন্ত্রণের একটি বড় মাধ্যম, যা ব্যাপকহারে জনগণের মধ্যে সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করছে। 

আর এসবের মধ্য দিয়ে জনগণকে বিচ্ছিন্ন রেখে এক কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা গড়ে তুলছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যে ব্যবস্থায় তিনি সব মতের ঊর্ধ্বে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh