আপনি কি স্ত্রীর সঙ্গে সত্য বলেন?

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৩৭ এএম | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ১২:১৬ পিএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

স্ত্রীকে খুশি করতে ‘সীমিত পরিসরে সত্য গোপন করা জায়েজ’। সম্প্রতি এ ফতোয়া দিয়ে আবারও আলোচনায় এসেছেন হেফাজতে ইসলামের বিতর্কিত নেতা মামুনুল হক, যিনি সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে নিজের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে অন্য এক ব্যক্তির সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। 

ওই দিন তিনি গণমাধ্যম ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে রিসোর্টে যাওয়া নারীকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করলেও, ওই সময়ে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যে কথা বলেছেন, তাতে এটি স্পষ্ট যে, রিসোর্টে যাওয়া নারী তার দ্বিতীয় স্ত্রী নন। 

এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হলে তিনি নতুন করে এর একটি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, স্ত্রীকে খুশি করতে সীমিত পরিসরে সত্য গোপন করা ইসলামসম্মত। শুধু তা-ই নয়, তিনি তার স্ত্রীর মধ্যে ফোনালাপ ফাঁসকে অপরাধ দাবি করে এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানান। 

অন্যের ফোনালাপ ফাঁস করা আইনসম্মত না- কি আইনবিরোধী- তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে বিষয়টি যতটা আইনি, তার চেয়েও নৈতিকতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়- সংবিধান যার সুরক্ষা দিয়েছে। আবার স্ত্রীকে খুশি রাখতে তার সঙ্গে সীমিত পরিসরে সত্য গোপন বা মিথ্যা বলা জায়েজ কি-না, তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, আপনি কি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে সব সময় সত্য কথা বলেন বা তার কাছে কি কিছু গোপন করেন না?

হেফাজত নেতা মামুনুল হকের এই ব্যাখ্যা বা ফতোয়া নিয়ে বিতর্ক আছে। হেফাজতের মতো একটি সংগঠনের একজন শীর্ষ নেতা ইসলামের কোন বিধানের কী ব্যাখ্যা দিলেন এবং সেই ব্যাখ্যা দেশের মানুষ মানবে কি মানবে না- সেটিও অন্য তর্ক; কিন্তু কথা হচ্ছে, আমরা কি প্রত্যেকে এই প্রশ্নটি নিজেদের কাছে করতে পারি বা করার সাহস রাখি যে, আমরা আমাদের স্ত্রীর সঙ্গে সব সময় সত্য বলি বা তার সঙ্গে কোনো সত্য গোপন করি না? 

টেলিভিশনের টকশো বা পত্রিকার কলামে যারা নিয়মিত জাতিকে জ্ঞান দেন, নীতি-নৈতিকতার কথা বলেন, তাদের কতজন স্ত্রীর সঙ্গে সত্য কথা বলেন? সঠিক অনুসন্ধান করলে সমাজ ও রাষ্ট্রের বহু ‘নীতিবান’ লোকের গোমর ফাঁস হয়ে যাবে। কে কার সঙ্গে কোন রিসোর্টে বা ফ্ল্যাটে গিয়ে সময় কাটান- তা যদি রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সত্যিই ফাঁস করে দিতে থাকে- তাহলে বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পড়নের কাপড় থাকবে না। 

২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দৈনিক যুগান্তরের একটি খবরের শিরোনাম ছিল- ‘পারিবারিক অশান্তির মূলে পরকীয়া।’ একটি গবেষণার বরাতে খবরে বলা হয়, প্রায় ৯০ ভাগ সংসার ভাঙার অন্যতম কারণ সন্দেহ ও পরকীয়া। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে পরকীয়া আসক্তির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম্পত্য কলহ, নতুন-পুরনো সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের তারতম্য, স্ত্রীকে রেখে স্বামীর বিদেশ গমনসহ অনেক সময় কৌতূহলের কারণেও পর পুরুষ বা নারীর প্রতি আগ্রহ জন্মায়। 

গবেষণার ফল উল্লেখ করে আরো বলা হয়, নারীর জন্য একতরফা আইন এবং চাকরি ও ইন্টারনেটের কারণে আধুনিক নারী স্বেচ্ছাচারী মনোভাব পোষণ করে থাকে। এছাড়াও ভরণপোষণের দায়িত্ব শুধু পুরুষের কাঁধে থাকার কারণে অনেক চাকরিজীবী নারী-পুরুষকে অর্থিক সহযোগিতা করতে চান না। এভাবে নারী শৌখিনভাবে চাকরি করার কারণে অনেক সময় সংসারে অশান্তি তৈরি হয়। 

পরকীয়া বাড়ার পেছনে আরো অনেক কারণ চিহ্নিত করা যায়। যেমন- প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে কারও বিয়ে হলে, বিয়ের কিছু দিন পর স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কজনিত সমস্যা সৃষ্টি হয় এবং এতে করে তাদের কেউ একজন অথবা উভয়ই অন্য নারী-পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে পারেন। বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্কের রসায়ন কার্যকর না হলেও, পরকীয়ায় আসক্ত হওয়ার শঙ্কা বাড়ে। অনেক সময় পরিবার বা সমাজের নানাবিধ পরিস্থিতিও নারী-পুরুষকে পরকীয়ায় জড়ানোর সুযোগ করে দেয়। পারিবারিক নানা বিষয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য বা সম্পর্কের অবনতি হলে, সে কারণেও তারা পরকীয়ায় জড়িয়ে যেতে পারেন। 

অনেক সময় পেশাগত সাফল্য পেতে বা দ্রুত উপরে উঠতে-বসকে খুশি করতেও অনেকে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন- এমন অভিযোগও রয়েছে। তবে যে কারণেই পরকীয়া এবং তার ফলে সংসারে অশান্তি বাড়ুক না কেন, মূল সংকট স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের। আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতির সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরো নানা বিষয়- বিশেষ করে সুযোগের সমন্বয় ঘটলেই মানুষ পরকীয়ায় জড়িত হয়ে পড়ে। আর যখনই মানুষ এরকম বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ায়, তখন তারা নিজেদের সংসার ঠিক রাখার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সত্য গোপন করেন বা মিথ্যা বলেন; কিন্তু এসব মিথ্যা বা সত্য গোপন আর সীমিত পরিসরে থাকে না। 

সীমিত পরিসরে সত্য গোপন বা মিথ্যার সীমারেখা কী? ধরা যাক, কেউ একজন অফিস থেকে বের হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গেলেন। তার বাসায় পৌঁছানোর কথা রাত ৮টায়। ৯টা বেজে গেলে স্ত্রী ফোন করলেন। স্বামী তখন স্ত্রীকে বললেন, অফিসে জরুরি মিটিং চলছে। এটি হলো সীমিত পরিসরে সত্য গোপন বা মিথ্যা। একে বলা যায় নির্দোষ মিথ্যা। এতে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক থাকল। আবার বন্ধুদের সঙ্গে তার আড্ডাও দেওয়া হলো। আবার স্ত্রীকে খুশি করতে সীমিত পরিসরে মিথ্যা মানে স্ত্রীর সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে গিয়ে কিছু বাড়তি বিশ্লেষণ যোগ করা; স্ত্রীর রান্না খুব বেশি সুস্বাদু না হলেও, সেটি বাড়িয়ে বলা যে, এত সুস্বাদু খাবার কোনো দিন খাইনি- এসব হচ্ছে সীমিত পরিসরে মিথ্যা, যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটায়। কিন্তু আপনি আরেকজনের স্ত্রীর সঙ্গে রিসোর্টে গেলেন; কিন্তু ধরা খাওয়ার পরে স্ত্রীর সঙ্গে মিথ্যা কথা বললেন। এটি আর সীমিত পরিসরে থাকে না। এটি ভয়াবহ মিথ্যা, যা শাস্তিযোগ্য। ইসলাম এ জাতীয় মিথ্যা বা সত্য গোপনকে সমর্থন করে না। 

সুতরাং স্ত্রীকে খুশি রাখতে তার সঙ্গে সীমিত পরিসরে সত্য গোপনের যে ফতোয়া মামুনুল হক দিয়েছেন, সেটির প্রয়োগ হতে থাকলে সমাজে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। কারণ এই ব্যাখ্যার পরে সীমিত পরিসরে পরকীয়া, অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে রিসোর্টে যাওয়া ও ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি শুরু হয়ে যাবে। 

বস্তুত রিসোর্টে ধরা পড়ার পরে মামুনুল হক একটি মিথ্যা ঢাকার জন্য আরো অনেক সত্য গোপন করেছেন। এটিই মিথ্যার ধর্ম যে, একটি ঢাকতে গেলে আরো ১০টি মিথ্যা বলতে হয়। তাতে করে সত্যটিই বেরিয়ে আসে যে, তিনি মিথ্যা বলেছেন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh