এম এইচ রশিদ
প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৩৯ এএম | আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৪৮ এএম
করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নিম্নআয়ের বিপুল জনগোষ্ঠী। ফাইল ছবি
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের তীব্রতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত বছরের মার্চে দেশে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসের সংক্রমণে প্রতিদিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।
ভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক। ক্ষতি কাটাতে সরকার ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। বড় শিল্পপতিদের প্রণোদনার বরাদ্দ বেশি ছিল এবং বিতরণও সম্পন্ন হয়েছে। আবার তাদের জন্য নতুন প্যাকেজের চিন্তাভাবনা চলছে।
করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন পেশাজীবী ও নিম্নআয়ের বিপুল জনগোষ্ঠী। তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল নিতান্ত কম। আবার সেই কম বরাদ্দের অর্থ এখন পর্যন্ত বিরতণ করা সম্ভব হয়নি। প্রক্রিয়াগত নানা জটিলতার অজুহাতে ছোট ব্যবসায়ীদের মাঝে প্রণোদনা বিতরণ করেনি বণ্টনের দায়িত্বে থাকা ব্যাংকগুলো।
গত বছরের ৮ মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা ও নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে সরকার সর্বমোট ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এই প্যাকেজের আকার ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা ছিল। এই তহবিলের অর্থঋণ হিসেবে বিতরণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর দায়িত্ব দেয় সরকার; কিন্তু সবার মাঝে সঠিকভাবে প্রণোদনার অর্থ বিতরণ করেনি ব্যাংকগুলো। প্রণোদনার প্রথম প্যাকেজ দেওয়া হয় রপ্তানিমুখী শিল্প তথা পোশাক শিল্প মালিকদের জন্য। এককালীন ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ প্রদান করে শিল্প মালিকরা ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ পান। পরবর্তীতে এই তহবিলের আকার আরও আড়াই হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। এখন শিল্প মালিকরা আবার এই প্রণোদনা দাবি করছেন। এরপর সবচেয়ে বড় অঙ্কের ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ দেওয়া হয় বড় বড় শিল্পপতিদের জন্য। এই প্যাকেজের ঋণ বিতরণ দ্রুত শেষ করে ব্যাংকগুলো। শিল্পপতিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই তহবিলের আকার আরও ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। এই অর্থও অনেক আগেই বিতরণ করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
এদিকে সারাদেশের কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতের লাখ লাখ উদ্যোক্তাদের জন্য মাত্র ২০ হাাজার কোটি টাকার একটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়; কিন্তু বার বার সময় বাড়িয়েও এই টাকা বিতরণ করেনি ব্যাংকগুলো। সর্বশেষ হিসাবে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৭২ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। অর্থাৎ তহবিলের ২৮ শতাংশ অর্থ এখনো পড়ে আছে। অথচ সারাদেশের হাজার হাজার উদ্যোক্তা ঋণের জন্য হাহাকার করছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘করোনার প্রথম ধাক্কা এখনো কাটেনি। প্রথম ধাক্কায় দিন আনে দিন খায়- তথা এক দিন আয় না করলে সংসার চালানো দায় এমন মানুষ তাদের যৎকিঞ্চিত সঞ্চয় ভেঙে অথবা আত্মীয়স্বজনের সহায়তা নিয়ে অথবা জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখে সংসার চালিয়েছিল। এখন তো সঞ্চয় নেই। প্রণোদনার অর্থ তারা পাননি। এখন জরুরি ভিত্তিতে অভিঘাত মোকাবেলায় প্রত্যেক মানুষের কাছে নগদ অর্থ পৌঁছে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সর্বজনের কাছে অর্থ পৌঁছালেই অর্থনীতির চাকা ঘুরবে।’
সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণের বিষয়ে নারী উদ্যোক্তার ওপর একটি জরিপ চালায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। দেশের ৩৪টি জেলার ৭০ জন নারী উদ্যোক্তাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই জরিপ করা হয়। ওই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, এই উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে জানতেনই না। আর ৯৩ শতাংশ উদ্যোক্তা ঋণের জন্য আবেদনই করেননি। ব্যাংকের নানা জটিলতার কারণে উদ্যোক্তারা ঋণের জন্য যাননি। অথচ করোনাভাইরাসের ভয়াবহ ছোবলে ৪১ শতাংশ নারী ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের অতিমারির সময়কালে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো নারীদের জন্য তেমনভাবে কার্যকর হয়নি। বেশিরভাগ নারী এসব প্যাকেজ সম্পর্কে অবগত নয়। যারা অবগত ছিলেন, তাদের মধ্যে ঋণের জন্য আবেদনের অনিচ্ছা লক্ষ্য করা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কারণে নারীরা এই ঋণের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। বরং নগদ সহায়তাই বেশি প্রয়োজন। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য নারীবান্ধব নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ প্রয়োজন।’
সারাদেশের দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষদের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগে ৭টি প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্যাকেজগুলোতে মোট বরাদ্দ মাত্র ১০ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা। অথচ এখন পর্যন্ত মাত্র ৪ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য এই স্বল্প বরাদ্দেরও ৫৬ শতাংশ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবার এবং কাজ হারানো শ্রমিকদের সহায়তা দিতে বরাদ্দ ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার মধ্যে বিতরণ হয়নি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
প্রণোদনার বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ কর্মসূচি ঠিকই ছিল। কিছু বৈসাদৃশ্য আছে। সরকার প্রণোদনা দিয়েছে পুরোটি ব্যাংকের কাঁধে বন্দুক রেখে। ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল। তৈরি পোশাকশিল্পসহ বড় উদ্যোক্তারা অর্থঋণ পেয়েছেন; কিন্তু ছোট উদ্যোক্তারা পাননি। ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দও খুব কম ছিল। মাত্র ২০ হাজার কোটি টাকা।’
আগের প্যাকেজ কার্যকরের এই শিথিলতার মধ্যে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। সংক্রমণ এড়াতে সরকার সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করেছে। আগে থেকে ব্যবসা খারাপ হয়ে পড়া এবং প্রণোদনা না পেয়ে বিপাকে রয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। লকডাউনে তাদের বিপদ আরও বাড়াবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, করোনার ধাক্কা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এ দেশের ছোট-বড় শিল্প মালিকরা বিপাকে পড়তে পারেন। করোনার ধাক্কা সামাল দিতে বড় শিল্প মালিকদের ছাড় করা টাকার ৫ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অনুদানে রূপান্তর করা উচিত। এ ছাড়া কৃষি খাতে যেসব প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার অর্থ পেয়েছে, তাদেরও ৫০ শতাংশ অনুদান হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।