সেন্টু হাজং: কৃষক থেকে বিজ্ঞানী

শেরপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২১, ০১:৩০ পিএম

সেন্টু চন্দ্র হাজং। ছবি: শেরপুর প্রতিনিধি

সেন্টু চন্দ্র হাজং। ছবি: শেরপুর প্রতিনিধি

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের চাটকিয়া গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত কৃষক সেন্টু চন্দ্র হাজং (৪৫) দেশি জাতের ধান চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। এখন তিনি ব্রিডিং সংকরায়ণ পদ্ধতিতে নিজ হাতেই উদ্ভাবন করছেন নতুন জাতের দেশি ধান। ফলে এলাকায় তিনি কৃষক থেকে বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। 

তার আবিষ্কার করা আমন জাতের বীজ ধান নিয়ে আবাদ করে আশপাশের কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন। ইতিমধ্যেই তার উদ্ভাবিত আমন সেন্টু শাইল চিকন জাতের ধান ফলন ভালো হওয়ায় স্থানীয় কৃষকদের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

এবারের আমন মৌসুমে মাটির গুনাগুন ধরে রাখতে সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে তিনি ছয় একর জমিতে দেশি জাতের ধান আবাদ করেছেন। এছাড়াও দেশি জাতের ধান প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিলুপ্ত হতে চলেছে এমন- বগি, হালই, গোলাপী, মালঞ্চি, ময়নাগিড়ি, মালসিরা, অনামিয়া, পারিজাত, আপচি, কাইশাবিন্নি, মারাক্কাবিন্নি, শংবিন্নি, দুধবিন্নি, বিরই, চাপাল, খাসিয়াবিন্নিসহ বেশ কয়েক রকমের ৪০০ প্লটে আমন জাতের ধান। এগুলো বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে বাচাঁনোর জন্য প্রতি বছর নিজের এক একর জমিতে বিভিন্ন জাতের ধান ট্রায়াল করে লাগান। ট্রায়ালের জন্য নিজের ছয় একর জমিতে গোবর সার ও নিজের তৈরি কেঁচো কম্পোষ্ট সার দিয়ে সেন্টু শাইল, চিনিশাইল, তুলসিমালা, পাইজাম, ঢেপা, চাপাল, পুরাবিন্নি ও নেদরাবিন্নি ধান লাগান।

সেন্টু জানান, স্থানীয় কারিতাস নামের বেসরকারি সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তিনি নিজেই সংকরায়ণ ও ব্রিডিং পদ্ধতিতে নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। এবার নিজের এক একর জমিতে ট্রায়ালও করেন। এখানে নাম ও নামবিহীন আমন জাতের ১০০টি জাত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

তিনি আরো জানান, দেশি জাতের ধানে এমনিতেই পোকার আক্রমণ কম হয়। অন্যদিকে কেঁচো কম্পোষ্ট ও গোবর সার ব্যবহার করাতে ধানের গাছ শক্ত মজবুত হয়। ঝড়বৃষ্টি কিংবা উচু হলেও হেলে পড়ে না। একটু আধটু পোকার আক্রমণ হলে নিমপাতা, গোলঞ্চপাতা ও বাসকপাতা পানিতে ভিজিয়ে ফুটিয়ে তারপর মেশিনের সাহায্যে জমিতে স্প্রে করেন। পাশাপাশি জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ধানের উৎপাদন খরচও কম পড়ে। এসব দেশি জাতের ধান মোটামুটি ভালো হলে একরে ৪০ থেকে ৫০ মন হারে উৎপাদন হয়।

একই গ্রামের কৃষক বিল্লাল হোসেন ও আন্ধারুপাড়া গ্রামের কৃষক হাবিল উদ্দিন সেন্টুর কাছ থেকে সংকরায়ণ করা সেন্টু শাইল জাতের ধান আবাদ করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন। 

ওই গ্রামের কৃষক রত্নেশর বর্মণ জানান, সেন্টু শাইল জাতের চিকন ধান দুই একর লাগিয়েছেন। এই জাতের ধানে বাজারে দামও ভালো পাওয়া যায়। তাছাড়া শুকনা ধান ৫০ মন হারে ফলন হয়। বাজারে চাহিদাও বেশ।

সেন্টু বলেন, কৃষকরা রাসায়নিক সার ব্যবহার করার ফলে দিন দিন জমির উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলছে। কিন্তু এখনো তিনি হালের গরু দিয়ে ধান ক্ষেত চাষ করেন। এই ধান নিয়েই তার সব গবেষণা। ১৯৯১ সালে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরুতে পারেননি। প্রায় ৩০ বছর যাবৎ কৃষি কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। আর প্রায় আট বছর ধরে এই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার গবেষণার কাজে সহায়তা করেন স্ত্রী অবলা রাণী হাজং।

বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে কৃষি বিজ্ঞানীরা যখন অল্প জমিতে অধিক উৎপাদন করতে তথা ফলন বাড়াতে নানা রকম গবেষণা চালিয়ে নতুন নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করছেন। আর তিনি সেই আগের হারিয়ে যাওয়া বা বিলুপ্ত হতে চলা ধান নিয়েই গবেষণা করছেন।

তিনি আরো বলেন, দেশি জাতের ধানের আছে আলাদা বৈশিষ্ট। এসব ধানের ভাত, পিঠাপুলি, মুড়ি বা এ ধরনের খাবার ক্ষেতে আলাদা স্বাদ। দেশি জাতের ধান যুগ যুগ ধরে কৃষকের কাছে থাকছে। তিনি চান দেশি জাতের ধানগুলো যেন কৃষকের মাঝ থেকে তাড়াতাড়ি বিলুপ্ত না হয়ে যায়। এজন্য কারিতাসের সহায়তায় তার এই উদ্যোগ। 

এ বিষয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আলমগীর কবির বলেন, সেন্টু প্রতি বছরই দেশি জাতের ধান ট্রায়াল করে আবাদ করেন। তার উদ্ভাবন করা দেশি জাতের ধান সেন্টু শাইলের ফলন ভালো হওয়ায় বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে। এই জাতের ধানে রোগ বালাই কম। এটি দেশের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে। দেশি জাতের ধান সংরক্ষণে তার উদ্যোগটি খুবই ভাল উদ্যোগ।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh