শতবর্ষে সত্যজিৎ রায়

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০২ মে ২০২১, ১০:৪৩ এএম

সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ রায় শুধু চলচ্চিত্রকার নয়, তিনি শিল্প-সাহিত্যের সক্রিয় সারথি, বহুমুখী ব্যক্তিত্বের প্রতিভূ। কালান্তরের চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক, লেখক, সঙ্গীত স্বর লিপিকার, সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রচ্ছদ শিল্পী।

আজ ২ মে (রবিবার) সত্যজিৎ রায়ের শততম জন্মবার্ষিকী। ১৯২১ সালের এই দিনে কলকাতায় তার জন্ম হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুপরিচিত শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় ও মা সুপ্রভা দেবী। শিশু বয়সে বাবাকে হারানোর পর মায়ের সান্নিধ্যে বড় হয়ে ওঠেন সত্যজিৎ রায়।

আধুনিক বাংলা সংস্কৃতি জগতের একটি বিরল প্রতিভা সত্যজিৎ রায়। চলচ্চিত্র পরিচালনায় তার অসাধারণ নৈপুণ্য ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা চলচ্চিত্রে একটি নতুন মাত্রা তৈরি করেছিল। হয়ত এটা বললে ভুল হবে না যে শুধুমাত্র সত্যজিৎ রায়ের কারণেই আজ বাংলা ভাষায় তৈরি চলচ্চিত্র পৃথিবী জুড়ে সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। অনেকেই বলেন সত্যজিৎ রায় তার ছবির মাধ্যমে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন।


চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক ও লেখক সত্যজিৎ রায় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

তার পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কিশোরগঞ্জে (বর্তমানে বাংলাদেশ) কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামে। তার ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন সুপরিচিত লেখক, চিত্রকর ও দার্শনিক। সেসময় তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের অন্যতম একজন নেতা। তার নিজের একটি ছাপাখানাও ছিল।

১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হন সত্যজিৎ রায়। এরপর মায়ের একান্ত ইচ্ছায় শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে যান চারুকলা নিয়ে। এসময় শিক্ষক হিসাবে তিনি পেয়েছিলেন আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার দুই দিকপাল আচার্য নন্দলাল বসু ও বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়কে।


১৯৪৩ সালে কলকাতায় ফিরে এসে যোগ দেন ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি.জে. কিমারে। সেখানে তিনি বিজ্ঞাপন ডিজাইনের কাজ করতেন। একইসময়ে তিনি প্রকাশনা সংস্থা সিগনেট প্রেসের সাথেও জড়িয়ে পড়েন এবং সেখানে তিনি প্রচুর বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন করেন। যার মধ্যে রয়েছে জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ ও ‘রূপসী বাংলা’র প্রচ্ছদ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ এবং জওহরলাল নেহেরুর ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’সহ বহু বইয়ের প্রচ্ছদ।

কিন্তু চলচ্চিত্র সম্পর্কে তার ব্যাপক উৎসাহ তৈরি করে দেয় তার বাকি জীবনের ইতিহাস। ১৯৫০’র দশকের গোড়ার দিকে লন্ডন সফরের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় চলচ্চিত্র জগতে তার জয়যাত্রা। কলকাতায় সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক সুনেত্রা ঘটক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ওই যাত্রাটা সত্যজিৎ রায়ের জীবনের জন্য ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

তিনি বলেন, তখন তিনি জাহাজে করে বিদেশ যাচ্ছেন। যাওয়ার সময় ডি.জে.কিমার ও সিগনেট প্রেসের আম আঁটির ভেঁপু বইটির প্রচ্ছদ ও ইলাসট্রেশনের কাজটা তাকে সাথে নিয়ে যেতে হয়। ওটা যখন করছেন, তখনই, আমার যেটা মনে হয়, ওনার ছবি করার একটা কথা মাথায় এসে থাকতে পারে। তখন তিনি পাতায় পাতায় ছবি আঁকছেন। ভিজ্যুয়ালগুলো ভাবছেন।


জানা যায়, লন্ডনে ডি.জে.কিমারের সদর দফতরে কাজ করার সময় সত্যজিৎ তিন মাসে ৯৯টি চলচ্চিত্র দেখেন। 

সুনেত্রা ঘটক বলেন, ‘ওখানে গিয়ে উনি প্রচুর ছবি (সিনেমা) দেখেছিলেন। তার মধ্যে যে ছবিটি ওঁনার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, সেটি হচ্ছে ইটালীয় পরিচালক ডি সিকার ছবি বাইসাইকেল থিভস্। এই ছবিটি তিনি দেখেন অনেকবার এবং সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায় আমাকে বলেছেন, ওই ছবিটা দেখার পরই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে তিনি চলচ্চিত্রকার হবেন।’ 

তিনি আরো বলেন, লন্ডনে যাবার পথে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালির শিশুতোষ সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’র ভিজ্যুয়াল তৈরির কাজ তিনি শেষ করে ফেলেছিলেন। আর জাহাজে দেশে ফেরার পথে তিনি পথের পাঁচালির স্ক্রিপ্টও তৈরি করে ফেলেন।

পথের পাঁচালির একটি দৃশ্য

আম আঁটির ভেঁপু বইয়ের জন্য তার আকা ছবিগুলোই পরে দৃশ্য বা শট হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তার সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র পথের পাঁচালিতে। তার এই বিশ্বনন্দিত ছবিটি বানানোর জন্য তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতাহীন কিছু কলাকুশলীকে একত্রিত করেছিলেন। নিজের জমানো অর্থ খরচ করে ছবির শ্যুটিং শুরু করেছিলেন। আর্থিক সহায়তার অভাবে ছবিটির দৃশ্যগ্রহণ চলে দীর্ঘ তিনবছর ধরে।

পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে ছবি তৈরির কাজ শেষ করেন সত্যজিৎ রায় এবং সেই বছরই ছবিটি মুক্তি পায়। মুক্তি পাওয়ার পর পরই ছবিটি দর্শক-সমালোচক সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে ও বহু পুরস্কার জিতে নেয়। দেশে বিদেশে ছবিটি বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল।

মানুষের জীবন নিয়ে তার সংবেদনশীলতাকে তিনি তার ছবিতে ভাষা দিয়েছেন। তার ক্যামেরা দিয়ে তিনি জীবনের নানা ছবি এঁকেছেন।

১৯৫৫ সাল থেকে নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সত্যজিৎ রায়। জীবনের শেষ প্রান্তে গিয়ে চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান অস্কার পান তিনি ১৯৯২ সালে।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন সত্যজিৎ রায়। শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণই নয়, অনেক ছোট গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন তিনি। তার সাহিত্যকর্মে শিশু কিশোরদের জন্য একটা বিশেষ জায়গা ছিল। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। একটি হলো- গোয়েন্দা ফেলুদা, অন্যটি বিজ্ঞানী প্রফেসর শঙ্কু।

৭১ বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়ের জীবনাবসান ঘটে কলকাতায় ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh