৮০ বছর খবর পৌঁছে দিলেও এখন কেউই নেয় না তার খবর

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০২ মে ২০২১, ০৩:১২ পিএম

১১১ বছর বয়সী সৈয়দ আহম্মেদ। ছবি: লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

১১১ বছর বয়সী সৈয়দ আহম্মেদ। ছবি: লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি

লাখো মানুষের সুখ-দুঃখের খবর ফেরি করেছি। কিন্ত আমার কষ্টের খবর কেউ ফেরি করে না আক্ষেপ করে কথা বলছিলেন, লক্ষ্মীপুরের সৈয়দ হকার। ১১১ বছর বয়সী সৈয়দ আহম্মেদ। পেশায় তিনি ছিলেন একজন পত্রিকা বিক্রেতা। ৮০ বছর ধরে লক্ষ্মীপুরে পথেঘাটে পত্রিকা নিয়ে হাজির হতেন মানুষের ধারে। স্থানীয়ভাবে সৈয়দ হকার নামের এই ব্যক্তি জীবনের ৮০ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন পত্রিকা বিক্রি করে।

এদিকে স্থানীয় পত্রিকা সংশ্লিষ্টদের দাবি, বাংলাদেশে সবচেয়ে আদি পত্রিকা বিক্রেতা সৈয়দ আহম্মেদ।

তার পুরো নাম সৈয়দ আহম্মদ ভূইঁয়া। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ ১ মার্চ ১৯১১ সাল। লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বাঞ্চানগরের মকরম আলীর ছেলে সৈয়দ আহম্মদের জীবিত ছয় ছেলে ও মেয়েরাও ষাটোর্ধ্ব বয়সী। ছেলেদের কোনোভাবে সংসার চললেও ষাট বছর বয়সী স্বামী পরিত্যক্ত দুই মেয়ে আর শতবর্ষী স্ত্রীসহ চারজনের ভরণ পোষণের দায়িত্ব এখনো তার ঘাড়ে। নিজের আর স্ত্রীর বয়স্কভাতা ছাড়া অন্য কোনো আয় নেই এ বৃদ্ধের। 


তবুও সৈয়দ আহম্মদ এখনো লাঠিতে ভর করে লক্ষ্মীপুর শহরে ঘুরে বেড়ায় জীবিকার সন্ধানে। চোখে ঠিকমতো না দেখলেও তিন বেলা আহারের খোঁজে প্রতিদিনই বের হয় পথে ঘাটে। পুরনো পত্রিকার গ্রাহকরা তাকে দেখলেই জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেন। 

গত বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে লক্ষ্মীপুর শহরে তার অতীতের কর্মস্থল রহমানিয়া প্রেসে কথা হলে এ প্রতিবেদকের কাছে তিনি জীবনের নানা বিষয় তুলে ধরেন। এসময় বিভিন্ন পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে দেখতে চোখের দুকোণে জলগড়িয়ে পড়ে তার। 

প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী জানায়, বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার পূর্বের লক্ষ্মীপুর থানার সব সময়ের হাজার ঘটনার স্বাক্ষী ছিলো খবরের ফেরিওয়ালা সৈয়দ আহম্মদ। পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেয়াই ছিল তার কাজ। বাম হাতে একটি লাঠি আর কাঁধে ব্যাগ, পরনে পুরোনো বিবর্ণ শার্ট, লুঙ্গি ডান হাতে পত্রিকা  নিয়ে ঘুরে ফিরতেন অলিগলি। কখনো কখনো লক্ষ্মীপুর শহরের পুলের উপরে বসেও পত্রিকা বিক্রি করতেন তিনি। কিন্তু তার কাঁধে ঝোলানো আছে সে ব্যাগ আর পরনে পুরোনো বিবর্ণ শার্ট, লুঙ্গি ও ডান হাতে লাঠি ও আছে। কিন্তু নেই শুধু পত্রিকা। এখন তার সময় যাচ্ছে কষ্টে।

লক্ষ্মীপুর পত্রিকা হকার সমিতির সভাপতি আনোয়ার জানান, পত্রিকার আয়ে তার সংসার চলতো। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত পত্রিকা বিক্রি করতে পারছেন না তিনি। সেকারণে এখনো শীর্ণ দেহে প্রতিদিনই বের হন মানুষের সহযোগিতার আশায়। বহু দিনের পরিচিত পাঠকরা কেউ কেউ কিছু সহযোগিতা করেন। এভাবে যা পান, তা দিয়েই চলে তার। 


রহমানিয়া প্রেসে বসে সৈয়দ আহম্মদ জানান, কর্মজীবনের শুরুতে প্রথমে নৌকায় কাজ করতেন। এরপর স্থানীয় এক মাওলানার সহযোগিতায় প্রায় ৮৫ বছর আগে পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করেন তিনি। সন-তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছিলেন না। তবে ইংরেজ আমলে ভারতীয় পয়গাম পত্রিকা বিক্রি করেছেন। পরে আজাদ, ইত্তেফাক, যুগশঙ্খ আর সংবাদ পত্রিকা বিক্রি করতেন। দুই পয়সা, চার পয়সায় পত্রিকা বিক্রি শুরু করেছিলেন তিনি। 

সৈয়দ আহম্মদ আরো জানান, সে সময়ে ছোট এ লক্ষ্মীপুরে সরাসরি পত্রিকা আসতো না। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে রেলগাড়িতে পত্রিকা আসতো। সেখান থেকে বাসে করে লক্ষ্মীপুরে পত্রিকা নিয়ে আসতেন। তারপর তা পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতেন প্রকাশের তিন-চার দিন পরে। প্রতিদিন পত্রিকা পৌঁছে দেয়াও সম্ভব হতো না। কিছু সময় ডাকহরকররা পায়ে হেঁটে পত্রিকা পৌঁছে দিতো। তখনও সকালবেলার পত্রিকা আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যার সময় পত্রিকা বিক্রির জন্য বের হতেন তিনি। 

এভাবে নিজের অজান্তেই পত্রিকার সাথে নিজের জীবনকে পুরো জড়িয়ে নেন সৈয়দ আহম্মদ। তারপর টানা প্রায় ৮০ বছর পত্রিকা বিক্রির সাথেই ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত কয়েক বছর থেকে আর পত্রিকা বিক্রি করতে পারছে না। কিন্ত অভ্যাসের কারণে প্রায় প্রতিদিনই এজেন্সিতে আসেন তিনি। পত্রিকা না পড়তে পারলেও উল্টিপাল্টিয়ে দেখেন। 


অতীতের প্রসঙ্গ তুলতেই সৈয়দ আহমেদ জানান, এ পত্রিকা বিক্রিকালেই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ৯০-এর গণআন্দোলনসহ সব ঐতিহাসিক আন্দোলনের স্বাক্ষী তিনি।  

মুক্তিযুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করলে সৈয়দ আহম্মদ জানান, সে সময় ইত্তেফাক আর সংগ্রাম ছাড়া অন্য কিছু বিক্রি করতে পারতেন না। প্রথম দিকে নিজে নিজে পত্রিকা বিক্রি শুরু করলেও এক সময় তার প্রধান আশ্রয়দাতা হন লক্ষ্মীপুরের প্রয়াত সাংবাদিক ও রহমানিয়া প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক গোলাম রহমান। গোলামের মৃত্যুর পর তার ছেলে মনোয়ার রহমান। মনোয়ারের পরে তার ছেলে রাকিব হোসেনের সাথেও দীর্ঘদিন ব্যবসা করেছেন তিনি।

রহমানিয়া প্রেসের পরিচালক রাকিব হোসেন জানান, ছোটবেলা থেকে দেখতাম প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে রহমানিয়া প্রেসে চলে আসতেন সৈয়দ চাচা। মাঝে মাঝে সকালবেলা দোকান খুলতে এসে দেখতাম সৈয়দ চাচা বসে আছেন। প্রায় সময়ই তিনি আমাদের আগেই এসে বসে থাকতেন। অনেক সময় রাত পর্যন্তও তিনি পত্রিকা বিক্রি করতেন। পত্রিকার গাড়ি এসে পৌঁছালেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। শুরু হয়ে যেতো তার কাজ। কাজের সময় তার সাথে কথা বলা সম্ভব হতো না। 

তিনি আরো বলেন, চাচা ছিলেন কাগজে কলমে অশিক্ষিত কিন্তু তার হৃদয় ছিল আলোকিত। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে চরম দুঃখ কষ্টে। তবুও হৃদয়বান এ মানুষটি শিশুদের পাঠশালার জন্য দান করেছেন পৌরসভার চার শতক জমি। আর মুসল্লিদের জন্য দিয়েছেন মসজিদের জমি।

এসময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, যে মানুষটি আজীবন মানুষের নিকট জ্ঞান বিক্রি করেছেন, সমাজ আলোকিত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু তার শেষ দিনগুলো যাচ্ছে চরম কষ্টে। বিগত আট দশকের খবরের ফেরিওয়ালা সৈয়দ হকার এখন বার্ধক্য আর রোগ শোকে খুবই ক্লান্ত। এখন তার জীবন চলছে অত্যন্ত দুঃখকষ্টে। এক ছেলে আবুল কালাম (৬০) বাবার পেশা পত্রিকা বিক্রি ধরে রেখেছেন। কিন্ত বর্তমান প্রযুক্তির যুগে পত্রিকা বিক্রির পয়সায় তারও সংসার চলে না। 

লক্ষ্মীপুর শহরের ঠিকাদারি ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন পাঠান জানান, স্কুলজীবন থেকেই তিনি সৈয়দ আহম্মদকে পত্রিকা বিক্রি করতে দেখেছেন। তার বাবাও দেখেছেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি বিনা পয়সায় তাকে পত্রিকা পড়তে দিতেন।

পত্রিকা পড়তে না পারলেও পত্রিকা বিক্রির প্রতি তার অসম্ভব ঝোঁক ছিল। মাঝে মধ্যে যেদিন পত্রিকা বের হতো না সেদিনও তিনি পুরোনো পত্রিকা নিয়ে বের হতেন। পত্রিকার প্রতি অন্য রকম নেশা ছিল তার। কারো কাছে তিনি সৈয়দ চাচা, কারো কাছে তিনি সৈয়দ নানা হিসেবে পরিচিত। শতবর্ষের এ আলোকিত মানুষটির জীবনে সব সময়ই নিত্যদিন সঙ্গী হচ্ছে অভাব। তবুও তিনি অত্যন্ত বড় হৃদয়ের মানুষ। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh