শাদে ‘ফরাসি অভ্যুত্থান’

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২১, ০৯:২৩ এএম

অভ্যুত্থানের পর শাদের রাজপথে মোতায়েন করা ট্যাঙ্ক। ছবি : এএফপি

অভ্যুত্থানের পর শাদের রাজপথে মোতায়েন করা ট্যাঙ্ক। ছবি : এএফপি

গত ১৯ এপ্রিল মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদের প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস দেবির হঠাৎ করেই মৃত্যু হয়। ১৯৯০ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি দেশটির ক্ষমতায় আসেন। দেশটির সামরিক বাহিনী জানায়, শাদের উত্তরে বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়ার সময় তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বিতর্কিত নির্বাচনে ষষ্ঠবারের মতো নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হলো। 

বিদ্রোহী গ্রুপ ‘ফ্রন্ট ফর চেঞ্জ অ্যান্ড কনকর্ড ইন শাদ’ বা ‘এফএসিটি’ গত ১১ এপ্রিল লিবিয়া থেকে শাদের সীমানায় প্রবেশ করে। দেবির মৃত্যুর পর ২১ এপ্রিল তার ছেলে জেনারেল মাহামাত ইদ্রিস দেবিকে সামরিক সরকারের প্রধান ঘোষণা করে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। 

সংবিধান স্থগিত করে ১৮ মাসের মাঝে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলা হয়। অথচ সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার হারুন কাবাদির নেতৃত্ব নেওয়ার কথা। ইদ্রিস দেবির রহস্যজনক মৃত্যু এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা নেয়ার ঘটনাকে বিশ্লেষকরা অভ্যুত্থান হিসেবেই দেখছেন। শাদে যা কিছুই হোক না কেন, সেখানে ফ্রান্সের ভূমিকা থাকে গুরুত্বপূর্ণ। শাদের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স কখনোই এই দেশ ছেড়ে যায়নি। তাই ইদ্রিস দেবির মৃত্যুতে ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়া ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

ফ্রান্স-২ টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ ইভস লে ড্রিয়ান শাদে ইদ্রিস দেবির ছেলের ক্ষমতা নেওয়ার ব্যাপারটি সমর্থন করে বলেন, স্পিকার হারুন কাবাদি দেশের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে নিরাপত্তার স্বার্থে ক্ষমতা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এমতাবস্থায় সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আর কাবাদি এই ব্যাপারটি মেনেও নিয়েছেন। তিনি দেশটির স্থিতিশীলতাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে লে ড্রিয়ান ১৮ মাস সময়ের মাঝে নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। 

ফরাসি সরকারের বক্তব্য অনেককেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। শাদের-বিরোধী রিফরমিস্ট পার্টির প্রধান ইয়াসিন আব্দেরামানি সাকিনে বলছেন, এটি পরিষ্কার যে, এর পেছনে সামরিক বাহিনী এবং ফ্রান্স জড়িত। এটি একটা অভ্যুত্থান; যার মাধ্যমে বাবার কাছ থেকে ছেলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে। লিবিয়া থেকে হামলা করা সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ এফএসিটি নেতৃত্ব জানায়, শাদ কোনো রাজতন্ত্র নয় যে, বংশপরম্পরায় নেতৃত্ব আসবে।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শাদের প্রেসিডেন্টের প্রধান বন্ধু ছিল ফ্রান্স। সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্স পাঁচ হাজার ১০০ সেনা মোতায়েন রেখেছে; যার হেডকোয়ার্টার হলো শাদের রাজধানী নিজালমিনা। এছাড়াও ফরাসি সেনারা উত্তরে ফায়া লারগিউতে লিবিয়ার সীমানায় নজর রাখছে এবং পূর্বের আবেশেতে সুদানের সীমানার ওপর নজর রাখছে। প্রতিবেদনে শাদের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কথাই তুলে ধরা হয়; যে কারণে ইদ্রিস দেবি এতকাল ফ্রান্সের বন্ধু ছিলেন; যদিও তার সরকারের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন ছিল ব্যাপক। 

স্থলবেষ্টিত শাদের উত্তরে রয়েছে লিবিয়া; যেখানে এখন চলছে গৃহযুদ্ধ। পশ্চিমে শাদ হ্রদকে ঘিরে রয়েছে ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া এবং নাইজার, যেখানে বোকো হারাম সশস্ত্র গ্রুপের বিরুদ্ধে ফরাসি নেতৃত্বে যুদ্ধ চলছে। দক্ষিণে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং পূর্বে সুদানের দারফুর অঞ্চলেও চলছে গৃহযুদ্ধ। জাতিসংঘের হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে মোতায়েন রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার ৭০০ শান্তিরক্ষী সেনাসদস্য এবং দারফুরে রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার শান্তিরক্ষী। অর্থাৎ, শাদের চারদিকে সবগুলো অঞ্চলেই চলছে যুদ্ধ। শাদ হ্রদ অঞ্চলে শাদের সামরিক বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে জড়িত। মালির গৃহযুদ্ধে ফরাসি নেতৃত্বে শাদের সেনারা যুদ্ধ করছে। এ বছরের শুরুতেই শাদের এক হাজার ২০০ সেনাকে নাইজার, মালি এবং বুরকিনা ফাসো, এই তিন দেশের সীমানার সংযোগস্থলে মোতায়েন করা হয়েছে, যা কিনা সাহেলে ফরাসি সামরিক কৌশলের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। 

অপরদিকে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং দারফুরে শাদের বিদ্রোহী গ্রুপগুলো যুদ্ধ করছে। লিবিয়ার যুদ্ধে অংশ নেওয়া শাদের যোদ্ধারাই এখন শাদে হামলা করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, এই সেনারা লিবিয়ার যুদ্ধ থেকে অর্থ, অস্ত্র এবং অভিজ্ঞতা পেয়েছে, যা ব্যবহার করে তারা শাদ আক্রমণ করেছে। তারা একসময় লিবিয়ার সামরিক নেতা খলিফা হাফতারের পক্ষে যুদ্ধ করেছে। 

শাদের রাজধানী নিজালমিনা হলো অত্র অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সামরিক বিমান ঘাঁটি। আশপাশের সবগুলো দেশে যুদ্ধ তদারকি করার ক্ষেত্রে শাদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ আর নেই। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়া থেকে আসা বিদ্রোহী সামরিক বাহিনীর উপর ফরাসি বিমান বাহিনী ব্যাপক বোমা হামলা চালায়। বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানায়, চলমান বিদ্রোহী হামলায় প্যারিস এখনো পর্যন্ত সরসরি সামরিক সহায়তা না দিলেও শাদের সামরিক বাহিনীকে ইন্টেলিজেন্স এবং লজিস্টিক সহায়তা দিচ্ছে ফ্রান্স। 

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক দ্য আটলান্টিক কাউন্সিলের এক লেখায় সিনিয়র ফেলো ক্যামেরন হাডসন বলেন, ফ্রান্স তার ইউরোপীয় বন্ধুদের চাপের মুখে রয়েছে। সাহেলের সামরিক মিশনে সহায়তা দেওয়ার অংশ হিসেবে তারা দাবি করছে, ফ্রান্স যেন শাদের অভ্যন্তরীণ কলহে না জড়ায়।  

সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আজিম বেরমানদোয়া আগুনা ১৭ এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেন, লিবিয়া থেকে আসা বিদ্রোহীদের সম্পূর্ণ পরাজিত করা হয়েছে; কিন্তু দেবির মৃত্যুর আগের দিন মার্কিন এবং ১৭ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার যখন নিজালমিনাতে তাদের দূতাবাস খালি করতে বলে, তখন দেশটির স্থিতিশীলতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে। রাজধানী নিজালমিনায় সাঁজোয়া যান মোতায়েনের ব্যাপারটি অনেককেই চিন্তিত করেছে। ১৬ এপ্রিল এফএসিটি দাবি করে, তারা গুরি নামের এলাকায় একটা সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে। এবং ফরাসি লজিস্টিক সহায়তার পরও শাদের সামরিক বাহিনী পরাজিত হয়েছে। ইদ্রিস দেবির মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতিকে পশ্চিমারা সর্বদাই এড়িয়ে গেছে; কারণ সাহেলে তিনিই ছিলেন পশ্চিমা স্বার্থের রক্ষক। 

শাদের অভ্যুত্থান এমন এক সময়ে ঘটল, যখন মালির যুদ্ধ প্রতিবেশী নাইজার এবং বুরকিনা ফাসোতে ছড়িয়ে গেছে এবং শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। ফ্রান্স এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে ক্রমেই তার পশ্চিমা বন্ধুদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে; যা বন্ধুদের ফ্রান্সের নীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিচ্ছে। এমনই এক অবস্থায় সাহেলের প্রধান ঘাঁটি শাদকে নিয়ে চাপের মাঝে পড়েছে প্যারিস। ফ্রান্স যত বাধ্য হচ্ছে বন্ধুদের চাপ সহ্য করতে, ততই দুর্বল হচ্ছে আফ্রিকায় ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh