করোনায় কর্মহীনতা নিয়ে যাচ্ছে দারিদ্র্যের দিকে

এম এইচ রশিদ

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২১, ০৮:৪০ এএম | আপডেট: ০৬ মে ২০২১, ০৮:৪৩ এএম

করোনাভাইরাসের ফাঁদে দিশেহারা নিম্নআয়ের মানুষ। ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের ফাঁদে দিশেহারা নিম্নআয়ের মানুষ। ফাইল ছবি

মরণঘাতী করোনাভাইরাসের ফাঁদে দিশেহারা নিম্নআয়ের মানুষ। জীবন ও স্বাস্থ্যবিনাসী এই ভাইরাস মানুষের আর্থিক সক্ষমতাকে পঙ্গু করে ফেলছে। লকডাউনের মতো পরিস্থিতিতে মানুষের কাজের সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। এতে যারা কাজে নিয়োজিত থেকে এতদিন দরিদ্রসীমার বাইরে ছিলেন, তারাও নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়ছেন। 

নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন- দেশের প্রায় ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। বিভিন্ন শিল্পে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশরই আয় আগের তুলনায় কমেছে। অনেকে কাজ হারিয়ে সেই কাজ আর ফিরে পাননি। বাধ্য হয়ে অন্যকাজে যোগদান করেছেন। তবে ৮ শতাংশ এখনো কাজে যোগদানের সুযোগ পাননি। আয় কমে যাওয়া এবং কাজ ফিরে না পাওয়া মানুষ নিজেদের সামান্যতম প্রয়োজন মেটাতে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। 

করোনাভাইরাসের প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করায় ১৪ এপ্রিল থেকে লকডাউন কার্যকর করেছে সরকার। বন্ধ রাখা হয়েছে গণপরিবহন। এর আগে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ২ মাসেরই বেশি সময় সাধারণ ছুটি কার্যকর করে সরকার। এতে অনেকেই কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল কিংবা সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারেনি। এতে একদিকে চাকরি হারিয়েছেন অনেকে, অনেকে কম বেতন পেয়েছেন। মানুষের জীবন যেমন বাঁচানো আবশ্যক, তেমনি আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষদের জীবিকা নিশ্চিত করাও আবশ্যক। 

করোনাভাইরাসের গত এক বছরের প্রভাব জানতে যৌথভাবে জরিপ পরিচালনা করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি)। ওই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের ছোবলে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। ওই জরিপে বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত যেখানে শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫৯ শতাংশ, সেখানে গ্রামাঞ্চলে তা ৪৪ শতাংশ। ওই জরিপে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চে এসে ৪১ শতাংশ কর্মজীবী আগের পেশা ছেড়ে নতুন পেশা গ্রহণে বাধ্য হয়েছেন। আর আগের বছরের মার্চে কাজ হারানোর মধ্যে এখনো ৮ শতাংশ কর্মজীবী কাজ ফিরে পাননি। 

এ বিষয়ে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অরক্ষিত অদরিদ্র এবং দরিদ্র নয়- এমন শ্রেণির মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ কোভিড-পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে নিচে নেমে গেছে। সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হয়েছেন। একই সঙ্গে সব শ্রেণিতেই ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের হার সামগ্রিকভাবে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

শ্রমিকদের ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব জানতে আরেকটি জরিপ পরিচালনা করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান সুইডেনের ওয়েজ ইন্ডিকেটর ফাউন্ডেশন (ডব্লিউআইএফ)। ওই জরিপের ফল এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে জরিপে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে চার শিল্প খাতের ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন শ্রমিকের মধ্যে ৮০ জনেরই মজুরি কমেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে শ্রমিকদের ধারকর্জের জন্য হয় আত্মীয়স্বজন, নয়তো ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আবার কাউকে কাউকে নিতে হয়েছে সরকারের দেওয়া খাদ্য সহায়তা। ওই চার খাত হচ্ছে- তৈরি পোশাক, চামড়া, নির্মাণ ও চা শিল্প। জরিপে দেখা গেছে, এই চার খাতের নারী শ্রমিকরা পুরুষের তুলনায় গড়ে ৭৭ শতাংশ কম মজুরি পান। চার খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মজুরি পান নির্মাণশিল্পের শ্রমিকরা। আবার তারাই আছেন সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়। কারণ এই শিল্পে কর্মরত কোনো শ্রমিকেরই যৌথ চুক্তি নেই, যা অন্য তিনটি খাতে কিছুটা হলেও আছে। নিরাপত্তার দিক থেকেও তারা বেশি পিছিয়ে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। অন্যদিকে সবচেয়ে কম মজুরি পান চা-শিল্পের শ্রমিকরা।

বিআইডিএস ও ডব্লিউআইএফ গত বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর সময়ে র‌্যান্ডম স্যাম্পলিং বা দৈবচয়নের ভিত্তিতে ‘শোভন মজুরি’ শীর্ষক এই জরিপ পরিচালনা করেছে। এতে চার খাতের মোট ১ হাজার ৮৯৪ জন শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৬৫টি তৈরি পোশাক কারখানার ৭২৪ জন, ৩৪টি চামড়া কারখানার ৩৩৭ জন, পাঁচটি চা-বাগানের ৪০১ জন এবং নির্মাণশিল্পের ৪৩২ জন শ্রমিক রয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের ৮৩ শতাংশই জানান, করোনার কারণে যখন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, তখন তারা কাজে উপস্থিত ছিলেন না। আর অনুপস্থিত সব শ্রমিকেরই মজুরি কমানো হয়েছে। তবে জরিপে সার্বিকভাবে ৭০ শতাংশ শ্রমিকের বার্ষিক বোনাস পাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।

বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মিনহাজ মাহমুদ বলেন, করোনার প্রভাব শ্রমিক শ্রেণির মানুষের আয় কমে গেছে। নিজেদের নিত্য প্রয়োজন মেটাতে ঋণ ও ধারকর্জ করতে বাধ্য হয়েছেন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh