ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করলে অক্সিজেন সংকটের শঙ্কা

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২১, ০৮:৪৫ এএম | আপডেট: ০৯ মে ২০২১, ০৮:৫০ এএম

অক্সিজেনের অভাবে অনেক করোনা রোগীর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে উঠছে। ফাইল ছবি

অক্সিজেনের অভাবে অনেক করোনা রোগীর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে উঠছে। ফাইল ছবি

স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশে কেবল শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন হতো। বর্তমানে দ্বিতীয় দফার করোনা সংক্রমণে রোগীদের ফুসফুস দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চলতি বছরের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশে অক্সিজেনের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে গিয়েছিল। 

বর্তমানে করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি রোগী কমেছে। ফলে অক্সিজেন চাহিদাও কমেছে; কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বিপদ রয়েই গেছে। ভারতের ডাবল ও ট্রিপল মিউট্যান্টের করোনাভাইরাস বাংলাদেশের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। ভারতের এই নতুন ধরনের ভাইরাস বাংলাদেশে চলে এলে, তখন সত্যিকারের বিপদটা আসতে পারে। 

ভারতের নতুন মিউট্যান্টে আক্রান্ত হলে খুব দ্রুত রোগীদের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ভারতে রূপান্তরিত ওই ভাইরাসটি চলে এলে এখানকার অবস্থা সন্তোষজনক নাও থাকতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হতে পারে। গত এপ্রিলের প্রথম থেকেমাঝামাঝি পর্যন্ত এ ধরনের একটি আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, যখন দৈনিক সাড়ে ৭ হাজারের বেশি করোনা আক্রান্ত এ ধরনের একটি আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, যখন দৈনিক সাড়ে ৭ হাজারের বেশি করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছিল। তখন হাসপাতালগুলোতে যেমন নতুন রোগী নেয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না, তেমনি দেখা দিয়েছিল অক্সিজেনের অভাব। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা ছিল সব জটিল করোনা রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়া ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণে এই রোগীগুলো স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না। রোগীকে তখন অক্সিজেন দিতে হয়। মানুষের রক্তে অক্সিজেন দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে বলে শরীরের সর্বত্র অক্সিজেন পৌঁছে যায় এবং ফুসফুস সেই কাজটি করতে সহায়তা করে। ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে এই অঙ্গটি শরীরে অক্সিজেন পাঠাতে পারে না। অক্সিজেন পাঠাতে না পারলে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ কাজ করতে পারে না। ফলে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। 

কিন্তু বাস্তবতা হলো নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি কম হলেও পুরনো রোগীরা এখনো হাসপাতালে রয়ে গেছে। আবার নতুন রোগী যারা হাসপাতালে আসছেন, তারাও চরম অসুস্থতা নিয়ে আসছেন। এই দুই ধরনের রোগীদেরই অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। সে কারণে অক্সিজেন চাহিদা এখনো কমেনি। তবে এটাও ঠিক এখন পর্যন্ত দেশে অক্সিজেনের চরম অভাব দেখা দেয়নি; কিন্তু ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট চলে এলে বাংলাদেশে যে কোনো মুহূর্তে অক্সিজেন সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এই ভ্যারিয়েন্টের কারণে ভারতে অক্সিজেন সংকট দেখা দেওয়ায় ভারত সরকার বাংলাদেশে অক্সিজেন রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। আমদানি করা অক্সিজেনের বেশির ভাগই ভারত থেকে আসতো।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় অক্সিজেন উৎপাদন কোম্পানি লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে গত এপ্রিলে অক্সিজেনের দৈনিক চাহিদা ছিল ১৫০ টন। লিন্ডে বাংলাদেশ সরবরাহ করতে পারছে ৯০ টন (কিছুটা আমদানি করে) এবং স্পেক্ট্রা সরবরাহ করছে ৩৮ টন। এই দুটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব প্ল্যান্টে অক্সিজেন উৎপাদন করছে। এই দুটো প্রতিষ্ঠানই আবার প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে নিজেদের উৎপাদনের ঘাটতিটা ভারত থেকে আমদানি করে মিটিয়ে থাকে। 

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো বিঘ্ন হয়নি। তা সত্ত্বেও বিকল্প কোনো দেশ থেকে অক্সিজেন আনার এখন পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনা নেই। বিভিন্ন অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। এ ছাড়া ছোট ছোট কোম্পানিকে আমরা উৎপাদন বাড়াতে বলেছি, যারা শিল্প-কারখানায় অক্সিজেন সরবরাহ করে। মাঝখানে চাহিদা কিছুটা বেড়ে গেলে শিল্প কারখানার জন্য উৎপাদন বন্ধ করে তাদের হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেন উৎপাদন করতে বলেছি।’

করোনা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছার আগে দেশে দৈনিক ১০০ টন মেডিকেল গ্রেড (মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী) অক্সিজেনের চাহিদা ছিল। হাসপাতালে রোগী সংখ্যা বেড়ে গেলে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ভেন্টিলেটর ও আইসিইউর চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। ফলে অক্সিজেনের কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছিল; কিন্তু অন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসেছে। নিজেদের শিল্প-কারখানায় ব্যবহারের জন্য যারা শিল্প গ্রেডের অক্সিজেন উৎপাদন করতো তারা শিল্পে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেন উৎপাদন করছে। যেমন- চট্টগ্রামের আবুল খায়ের গ্রুপ শিল্পের অক্সিজেন বন্ধ করে মেডিকেল অক্সিজেন তৈরি করে সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছে। 

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে দ্বিতীয় পর্যায়ের করোনা সংক্রমণের সর্বোচ্চ পর্যায়ে (এপ্রিল ২০ পর্যন্ত) দৈনিক অক্সিজেনের সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে গেলেও এখন রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমায় হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন ১২০ টনের নিচে নেমে এসেছে। 

ভারত থেকে বাংলাদেশে অক্সিজেন আমদানি বন্ধ হয়ে যায় গত ২১ এপ্রিল। 

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এর আগ পর্যন্ত চারটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫০০ টন তরল অক্সিজেন আমদানি করে। এ মুহূর্তে হাসপাতালে রোগী কমে যাওয়ায় আমদানি বন্ধের ধাক্কাটা লাগছে না। অবশ্য ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিল্পকারখানার অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। 

লিন্ডের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান সাইকা মাজেদ জানান, মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের ২০ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে অক্সিজেনের চাহিদা ৪০ শতাংশ বাড়ে। লিন্ডে দৈনিক উৎপাদনের ৮৮ টনের পুরোটাই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে দিয়েছে। এতে শিল্প-কারখানার সমস্যা হয়েছে কিন্তু কিছু মানুষকে বাঁচানো গেছে। তিনি আরও জানান, সরকার ও লিন্ডের কাছে আগে মেডিকেল পরে শিল্প-কারখানা। এখন যা উৎপাদন হচ্ছে, তা দিয়েই চাহিদা মেটানো যাচ্ছে।’ 

ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাইন বিল্লাহ জানান, ইসলাম অক্সিজেন ৩০ টনের মতো অক্সিজেন হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করছে। এখন যে উৎপাদন হচ্ছে, তা দিয়ে চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে। আমরা ৩০ টনের মতো অক্সিজেন উৎপাদন করছি। সব মিলিয়ে দৈনিক ৪০ টন অক্সিজেন উৎপাদন করার সক্ষমতা আছে। ইসলাম অক্সিজেনও ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি করে আসছিল। হাসপাতালে অক্সিজেন দেওয়ার পর বাড়তিটুকু শিল্পে দিয়ে আসছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। 

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ অক্সিজেন উৎপাদন হচ্ছে, তা দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য চলে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে করোনা সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে গেলে দেশীয় চাহিদা মেটাতে পারবে না। তখন হয়তো বাইরে থেকে অক্সিজেন আনতে হবে। তবে মানুষ যদি সচেতন থাকেন, সরকারি নির্দেশনাগুলো পালন করেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইরে চলাফেরা করেন, তাহলে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণেই থাকবে।

তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এ ব্যাপারে খুবই সচেতন। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানতে চায় না। তারা যেন স্বাস্থ্যবিধি মানেন, সে জন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং পরিবার থেকেই চাপ দিতে হবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh