বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীন?

মনজুরুল হক

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২১, ০৮:৫৯ এএম | আপডেট: ০৯ মে ২০২১, ০৯:০০ এএম

রুপার্ট মারডকের কথা হয়তো এখনকার ওয়েব প্রজন্ম জানবে না। যারা একসময় প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ শুরু করেছিলেন, তারা এই নামটি জানেন না এমন একজনও ছিলেন না। মারডক একজন মিডিয়া ব্যবসায়ী। ‘নিউজ করপোরেশন’-এর মালিক। সারাবিশ্বে কয়েকশ’ পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল রয়েছে তার। 

দৈনিক পত্রিকা, ট্যাবলয়েড, ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেল, চলচ্চিত্র, বই প্রকাশনা, শেয়ার ব্যবসা, ওয়েব পোর্টাল কোথায় নেই তিনি? মিডিয়া বাণিজ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া তার দখলে। আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্রের মালিকানাও তার। তার প্রকাশিত খবরেই নড়ে ওঠে গোটা বিশ্ব। কয়েকটি দেশে তার প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক চালে সরকার বদল হয়, যুদ্ধ বাধে। সে কারণেই রুপার্ট মারডককে মিডিয়া সাম্রাজ্যের বাদশাহ মানা হয়।

এই ভূমিকা সেরে নেওয়া হলো এটা বলার জন্য যে, বাংলাদেশে তো সবকিছুতেই অপেশাদারিত্ব, আর কুৎসিত ব্যক্তিচিন্তা দ্বারা আক্রান্ত। তারপরও এই দেশে ঠিক এই সময়ে অন্তত ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশজন মারডকে ‘বাংলাদেশি ভার্সন’ রয়েছে। তারা টিভি চ্যানেলের মালিকই হয়েছেন এটাকে আর একটা লাভজনক ব্যবসা সাব্যস্ত করে, সেই সঙ্গে আরও ডজন ডজন ব্যবসার এপিটাইজার কিংবা ব্যাকআপ ফুয়েল হিসেবে। এর মধ্যে যাদের একটু রুচি আছে, তারা ব্যবসা-বাণিজ্যটা একটু রুচিসম্মতভাবে করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ দালালি করলেও সেটি মাটিতে উপুড় হয়ে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণামের মতো নয়। একটু দূর থেকে মেরুদণ্ড বাঁকা করে বো-করা। আর বিস্তর ডিগ্রি নেওয়ার পরও, যাদের গা থেকে এখনো সামন্ত গ্রাম্য গন্ধ যায়নি- তারা প্রয়োজনে ক্ষমতাবলয়ের চারপাশে মাছির মতো ভন ভন করতে থাকেন। জনে জনে ফালা ফালা করে মিডিয়া ব্যবচ্ছেদ উদ্দেশ্য নয়। এ নিয়ে বলতে শুরু করলে শেষ হবে না। শুধু তিনটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

নিজেদের গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির বিজ্ঞাপন বেশি বেশি প্রচার করবেন, সেটা কোনো ফর্মেটেই দোষের কিছু নয়; কিন্তু সেটা যখন ‘সাদা ছাগলটাও আমার কালো ছাগলটাও আমার’ এর মতো বিরক্তিকর হয়, তখন দোষের। কিছু চ্যানেলকে দেখা যায় দলে তিনশ’ সংসদ সদস্য থাকলেও তাদের মালিক কোথায় কি বলেছেন সেটাই বারে বারে প্রচার করে। কোনো চ্যানেলকে দেখা গেছে, সুন্নতে খতনা-পরবর্তী খানাপিনার লাইভ টেলিকাস্ট করছে! এরকম ডজন ডজন ‘ছোটলোকি’ আছে। থাকুক। সর্বশেষটা বলি- এক মালিক উপনির্বাচনে নমিনেশন দাবিদার। সেটা তিনি আপামর জনসাধারণকে ধরে ধরে নমিনেশনের জন্য মাননীয় অমুকের কাছে মিনতি রাখছেন। মুখস্ত করার পরও কেউ হয় বলে বসছে- ‘উনাকে ভোট দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি’।

এরকম বিবিধ স্টাইল আর প্যাশন নিয়ে যে খানা চল্লিশেক টিভি চ্যানেল চলছে, তাদের উল্লিখিত আচরণ বিরক্তিকর, হাস্যকর বা বিব্রতকর হলেও ভীতিকর নয়। আতঙ্ক ছড়ায় না...

আমাদের ঐতিহ্যবাহী প্রিন্ট মিডিয়ার কথা বলতে গেলে আগেই ক্রোধ সংবরণ করার জন্য ওষুধপত্তর খেয়ে নেওয়া কর্তব্য। ১৯৭৪ সালে চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব ব্যান করে দেওয়া হয়েছিল। সেই চারটিও ছিল সরকারের বশংবদ বা নেক নজরে থাকার চেষ্টায় ‘সফল’। তারপরও সেই চারটি কাগজ যতটুকু মুক্তভাবে সংবাদ ছাপতে পারত এখনকার দিনে হাজার হাজার প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক আর ওয়েব মিডিয়া সেটুকুও পারে না। এটা কি কেবল সরকারের দমন-পীড়নের ভয়ে? নিশ্চই নয়। আগেই বলেছি; এখন মিডিয়া চালায় পুঁজিবাদীরা। তাও জাতীয় পুঁজির পুঁজিবাদী নয়। ফড়িয়া পুঁজি বা তস্কর পুঁজি। 

এখন দৈনিক সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, ওয়েবপোর্টাল, ব্লগ মিডিয়া, সবই কোনো না কোনো কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য খোলা হয়েছে।, অথবা আরও সোজাসাপ্টা বললে- ওইসব ভূমিদস্যু, জলদস্যু, বনখোর, ভূমিখোর, জলাশয়খোর, সরকারি কলকারখানাখোর, কমিশনখোর, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া, খুন-খারাবি করা, ভেজাল দেওয়া, মানুষের জমি-জিরেত, কল-কারখানা-বন-জঙ্গল দখল করা মাফিয়াদের প্রটেক্ট করবার জন্য। আইনত জায়েজ করবার জন্য। সরকারকে চাপে রেখে মতলব হাসিলের জন্য। 

এসব করতে গিয়ে তারা একদল সংবাদকর্মী কিংবা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব পোষে। তারাও প্রভুর সঙ্গে প্রভুর সব লুটপাট, চুরি-চামারি, ডাকাতি-লুণ্ঠনের খুদ-কুড়ো পায়, উচ্ছ্বিষ্ট পায়। মাঝে মাঝে চিত্ত-বিনোদনের জন্য মদ-মেয়েমানুষও হাতিয়ে নিতে পারে। এই যে বিশাল একটা প্যারাসাইট ক্লাস তারা তৈরি করেছে, তারাই এদেশের প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, ওয়েব জগতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এবং সমাজের মাতব্বর সেজে জ্ঞান বিতরণ করছেন। বলাবাহুল্য দেশের অধিকাংশ বিবশ মানুষ এসব আবর্জনাকেই সত্য বলে মেনে নিচ্ছে। তাই গত চার দশকে এই দেশে একটা কিম্ভূতকিমাকার জগাখিচুড়ি বিবেকহীন শ্রেণি গজিয়ে উঠেছে। এরাই দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে বাপ-দাদার তালুক সাব্যস্ত করে ছড়ি ঘোরাচ্ছে।

এর উল্টোদিকে আছে সরকারের হরেকরকম  নিবর্তন। ডজন ডজন নিষেধাজ্ঞা। একটা সাধারণ সংবাদও প্রকাশের আগে অন্তত চার বার সেন্সর হয়। প্রথম সেল্ফ সেন্সর করে রিপোর্টার, এরপর নিউজ এডিটর এবং তারপর সম্পাদক। এর পরও যদি কোনোও মতে ফার্স্ট এডিশন ছেপে বসে কিংবা সন্ধ্যার খবরে অন-এয়ার করে দেয়, তারপর আসে সরকারের বিশেষ দপ্তরের হুমকি। কখনো সরাসরি ফোন। কখনোওবা সরাসরি অফিসেই হাজির হয়। তারপর দেখা যায়, সেকেন্ড এডিশনে ওই খবর আর নেই। রাতের খবরে ওই খবর ব্ল্যাকআউট। অমুকের বিরুদ্ধে বলা যাবে না। তমুকের বিরুদ্ধে বললে অত বছরের জেল। তার নামে বললে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়া হবে। ওর নামে বললে গুম হয়ে যাবে। তাদের নামে বললে ‘রাজাকার’ অপবাদ জুটবে। প্রকাশ্যে ঠ্যাং ভেঙে দেওয়া হবে। নিদেনপক্ষে ভাঙার হুমকি দিয়ে কলজে কাঁপিয়ে দেওয়া হবে।

তারও পরে আছে বাণিজ্য-ব্যাপারিবাজী। বিশেষ কোম্পানির বিশেষ প্রডাক্টের বিজ্ঞাপন পাওয়ার অন্যতম শর্ত সেই কোম্পানির কোনোরকম অনিয়ম, অনাচার, অত্যাচার, ফাঁকিবাজী, চুরি-ডাকাতি, লুটপাট আর দখলের খবর প্রচার করা যাবে না। মিডিয়াও সুবোধ বালকের মতো সেইসব সরকারি-বেসরকারি, কোম্পানি শাসন মেনে চালিত হচ্ছে। উপায় নেই। কারণ মালিকরা ‘ভালো’ সাংবাদিক ধরতে টোপ ফেলেছিল। কাউকে কাউকে ওয়েজ বোর্ডের বাইরেও লাখ টাকা বেতন দেওয়া হয়।

এসব তথাকথিত গণমাধ্যম (বাংলাদেশে কার্যত কোনো গণমাধ্যম নেই। সবই সংবাদ মাধ্যম বড়জোর) কখনই ভাটিয়ারির জাহাজভাঙা তথাকথিত শিল্পের নিয়মিত মৃত শ্রমিকের কথা লেখে না। বলে না। বাংলাদেশে যে অবৈজ্ঞানিক, অস্বাস্থ্যকর, বিপজ্জনক পরিবেশে বিষাক্ত কেমিক্যালবাহী জাহাজ ভাঙার ব্যবসা চলে, তার নজির বিশ্বের আর কোথাও নেই। এরা কখনো বনখেকোদের নিয়ে খবর ছাপে না। সরকারি চোরদের চুরি-ডাকাতির খবর চেপে-চুপে ছাপে। এরা কখনো পরিবেশখেকো ভূমি দস্যুদের বিরুদ্ধে লেখে না। এরা কখনো চাষার দুঃখ নিয়ে ফিচার করে না। শত শত নদী দখল নিয়ে এদের রা নেই। এরা কখনো সরকারকে সাবধান করে গণস্বার্থের বিষয়ে লেখে না। তার বদলে কোন বলিউড নায়িকার পেটে কয় মাসের বাচ্চা, কার উরুদেশে ফুসকুড়ি উঠেছে, কার মন খারাপ, কে ঈদে কোন রঙের শাড়ি পড়বে, কে সিঙ্গাপুরে ঈদ শপিংয়ে গেছে, কার ভাগনি জামাইয়ের খালাতো ভাইয়ে ডিগ্রি লাভ ঘটেছে, কোন কানাডাবাসী বাঙালি কবিতার বই প্রকাশ করেছে, কোন ক্রিকেটার সংসদ সদস্য হয়ে খিচুড়ি বিলিয়েছে, কার সন্তান প্রসব করতে ইউএসএ গেছে, নারী বশীকরণের দশটি উপায়, কি করিলে স্ত্রীকে সুখ দেওয়া যাবে, কোন পীর স্বপ্নে পাওয়া তাবিজ দিয়ে ক্যান্সার ভালো করে, কোন পাথর বিক্রেতার পাথরে পথের ফকির বিল গেটসের মত ধনী হয়েছে এসবই তাদের উপাদেয় খাদ্য। 

আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ’ বিভাগে নিশ্চই পাঠ্য রয়েছে মিডিয়ার অন্যতম প্রিন্সিপাল বা প্রধান প্রধান অনুষঙ্গ। মনে করিয়ে দেওয়া যাক-

1. All mass media have business interests.

2. All mass media have an intended target audience.

3. All mass media have codes and conventions.

4. All mass media construct reality.

5. All mass media contain values, beliefs, and ideologies.

6. All mass media convey messages. Some of these messages are explicit, while others are implicit. Unintended messages are very often part of the messagesÕ structure.

7. A new mass media technology will initially borrow the content and imitate the conventions of the mass medium that is currently dominant in a society. As the technology advances, the new medium will consume the older medium, turning it into content. This can be referred to as the Principle of Necro-Media.

এই সাতটি পয়েন্টই the main principals of mass media and communication. অথচ একটু চোখ-কান খোলা যাদের, তারা সহজেই ধরতে পারবেন এর কোনো পয়েন্টই এদেশের মিডিয়ায় চর্চা হয় না। কেন? এখনকার সংবাদকর্মী যারা এই বিষয়ে পড়াশোনা করে পাস করে তবেই চাকরি নিয়েছেন, তারা কি এসব ভুলে গেছেন? না। তাদের হাত-পা বেঁধে রাখা আছে। কোথাও টাকা দিয়ে। কোথাও ক্ষমতার লোভ দিয়ে। কোথাও উপঢৌকন দিয়ে। কোথাওবা রাজনৈতিক থ্রেট দিয়ে।

এই চরম বিবেকহীন রাক্ষসদশায় এদেশে প্রতিবারের মতো এবারও পালিত হয়েছে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’। তার প্রতিপাদ্য কী সে কথা পুনরুল্লেখ দরকার পড়ে না। আমরা জগতের যা কিছু ভালো, যা কিছু মানব কল্যাণকর, যা কিছু প্রশংসাহ তার তালিকার কোথায় আছি, সেটাও সকলে জ্ঞাত আছেন। আজকে খুব ছোট্ট করে একটা তথ্য দিতে নিজেরই লজ্জা করছে! 

আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত, দরিদ্র, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা একটা উগ্র সাম্প্রদায়িক দেশ আর রাজা-বাদশাদের ছোট্ট দরিদ্র দেশ ভুটানও আমাদের চেয়ে ওপরে। রিপোর্টার্স উইদাউট বডার্সের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স আমাদের অবস্থান ১৫২তম! তার পরও আমাদের নিয়ে তেতো কণ্ঠে সজোরে বলতে হচ্ছে- দেশে এখন গণমাধ্যম পূর্ণ স্বাধীন!

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh