শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে জরুরি কিছু মতামত

আবুল কাসেম ফজলুল হক

প্রকাশ: ১০ মে ২০২১, ০৯:৩০ এএম

স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে গেছে। এর অভিঘাতে সর্বত্র রাষ্ট্রব্যবস্থাও বদলে গেছে। এই সময়ে বাংলাদেশ পরিবর্তিত হয়েছে বাইরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরিকল্পনা অনুযায়ী। বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চাপে। 

বাস্তবে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি গণবিরোধী রূপ ও প্রকৃতি নিয়ে আছে। অবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রথমে এই অবাঞ্ছিত অবস্থাটাকে ভালোভাবে বুঝে দেখা দরকার।

তথ্যপ্রযুক্তি, জীবপ্রযুক্তির বিপ্লব, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ এবং ওয়াশিংটনের কর্তৃত্বে বিশ্বায়ন পৃথিবীতে যুগান্তর ঘটিয়েছে। বাংলাদেশেও ১৯৮০-র দশক থেকে ঘটে চলছে যুগান্তর প্রক্রিয়া। এনজিও ও সিএসও প্রবর্তন, গণতন্ত্রের নির্বাচনসর্বস্ব ধারণা প্রতিষ্ঠা ও নিঃরাজনীতিকরণ, মৌলবাদ-বিরোধী, নারীবাদী ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী আন্দোলন, দাতাসংস্থা ও উন্নয়ন-সহযোগী রূপে বৃহৎ শক্তিবর্গের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সব ব্যাপারে নিয়ামক হয়ে ওঠা, সাম্রাজ্যবাদী চাপে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাংলাদেশে গণতন্ত্র চাওয়ার জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে এবং ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে ধর্ণা দেওয়া, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার, রাজনীতিতে একটির পর একটি নাগরিক কমিটির দৌরাত্ম্য, নির্বাচনের জন্য অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, কৃষি, পোশাকশিল্প, বিদেশে শ্রমিক রফতানি ও আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনীতে সৈন্য প্রেরণের মাধ্যমে জাতীয় আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি, বহুত্ববাদ ও অবাধ প্রতিযোগিতাবাদের নীতি গ্রহণ, সমাজে মানুষের কেন্দ্রীয় প্রবণতার পরিবর্তন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ঘটেছে যুগান্তর। মানুষ বদলে গেছে। আগের মানুষ আর নেই। আগের পরিবেশও নেই।

ব্রিটিশ শাসিত বাংলার রেনেসাঁস, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন, ব্রিটিশ শাসনবিরোধী স্বাধীনতা-আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে জীবনবোধ, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাক্সক্ষা, জীবন-জগত দৃষ্টি ও রাজনীতি বিকশিত হয়ে চলছিল, ১৯৮০-র দশক থেকে ক্রমে তার অবসান ঘটে এবং ভিন্ন জীবনবোধ ও চিন্তা-চেতনা, ভিন্ন আশা-আকাক্সক্ষা ও জীবন-জগৎ দৃষ্টি আর রাজনীতির নামে নগ্ন ক্ষমতার লড়াই ও স্বার্থের সংঘাতে চলছে। আগের রাজনীতি আর নেই, উন্নততর নতুন রাজনীতি গড়ে তোলার চেষ্টাও দেখা যাচ্ছে না। নবযুগ নয়, চলছে এক যুগসন্ধি।

১৯৮০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন যুক্ত উদ্যোগে বিবিসি রেডিওর মাধ্যমে পরিচালনা করে মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন। এ সময়ে সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যে পরিচালিত মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন বাংলাদেশে জোরদার হয়। সমাজতন্ত্রের ও গণতন্ত্রের ব্যর্থতার মধ্যে ওই দুই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে ধর্মীয় শক্তির পুনরুজ্জীবন ঘটে। এই ঘটনা লক্ষ্য করে ১৯৮০-র দশক থেকে কেউ কেউ বলে আসছেন, ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে।

বাংলাদেশে গত চার দশকের মধ্যে সংঘটিত পরিবর্তনে দেশের জনগণের ও নেতৃত্বের ভূমিকা কী, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ-তহবিল, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা একান্ত দরকার। দেখা দরকার, কী হতে পারত আর কী হয়েছে, কী আমরা করতে পারতাম আর কী করেছি। রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, শিক্ষাব্যবস্থায়, প্রশাসনব্যবস্থায়, বিচারব্যবস্থায় গত ৫০ বছরে আমাদের সংস্কৃতির চেহারাটা কী? সংগীতে, চারুশিল্লে, সাহিত্যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের জাতির সৃষ্টিশীলতার স্বরূপ কী? আমরা কোন গন্তব্যের দিকে চলছি? সব কিছুই কি অনিবার্য ছিল? এখন আমাদের লক্ষ্য কী? আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালচনা ও আত্মোৎকর্ষ দরকার।

আমাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা তো রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থারই অংশ। তবু সরকার চাইলে এরই মধ্যে ভালো অনেক কিছু করতে পারত-করতে পারে। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে একমুখী প্রাথমিক শিক্ষার কথা; কিন্তু কোনো সরকারই তা মান্য করছে না। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা এখন চৌদ্দভাগে বিভক্ত। এটা সংবিধানের ও রাষ্ট্রের স্বার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। জাতীয় শিক্ষানীতিতে (২০১০) কী লেখা আছে, সেটা এখন আর বড় কথা নয়, সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী হয়ে সরকার কী করছে, বাস্তবে শিক্ষাব্যবস্থার রূপ ও প্রকৃতি কেমন দেখা যাচ্ছে, সেটাই বড় কথা।

সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, মূলধারার (এনসিটিবি যে ধারার পাঠ্যপুস্তকের জোগান দেয়) প্রতি যথোচিত গুরুত্ব না দিয়ে এবং ধর্মীয় ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চাপে শিক্ষাব্যবস্থাকে অত্যন্ত বেশি জটিল করে তুলেছে। মূলধারার শিক্ষাকে সরকার যে রূপ দিয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য তা মোটেই কল্যাণকর নয়। সরকার শিক্ষার বিশ্বমান অর্জনের কথা বলে সাম্রাজ্যবাদী নীতির অন্ধ অনুসারী হয়ে চলছে। এতে জাতির আত্মসত্তা বিপর্যস্ত। সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, খ্রিস্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা চালু করেছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে এগুলো থেকে একটি পড়তে হয়; কিন্তু গণতন্ত্র ও নৈতিক শিক্ষা, সমাজতন্ত্র ও নৈতিক শিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও নৈতিক শিক্ষা, জাতীয়তাবাদ ও নৈতিক শিক্ষা চালু করেনি। সরকার সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি কথা বলে এবং কখনো কখনো নানা রকম উস্কানিমূলক কাজের দ্বারা প্রতিপক্ষকে সক্রিয় করে কী অর্জন করতে চায়, তা বোঝা যায় না। তবে এটা বোঝা যায় যে, যা কিছু করে- কেবল ক্ষমতার জন্য।

ধর্মনিরপেক্ষতা আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে রাজনীতিতে, আর নাস্তিকতা ও আস্তিকতা নিয়ে সমাজের স্তরে স্তরে যে বিরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে, শিক্ষানীতিতে ও শিক্ষাব্যবস্থায় তার ঘনীভূত প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরে এর সমাধান সম্ভব নয়। চরম সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যে কেবল পুলিশ, র্যাব, কারাগার ও ফাঁসিরকাষ্ঠ দিয়ে সমাধান হবে না। যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম দুটি কথাই সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া সমীচীন।

শিক্ষাব্যবস্থা নানা ধারা-উপধারায় এমনভাবে বিভক্ত যে, তা জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এ ব্যাপারে শিক্ষক, অভিভাবক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কারো মধ্যেই খুব একটা সচেতনতা নেই। সকলেই চলমান ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে চলছেন, পরিবর্তন সাধনের চিন্তা ও চেষ্টা নেই। বাংলাদেশে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কৃত পাঠ্যসূচি ও পাঠক্রম অনুযায়ী ইংরেজি মাধ্যমে চালাচ্ছে ও-লেভেল, এ-লেভেল- যা ব্রিটিশ স্বার্থে ব্রিটেনের বাস্তবতা অনুযায়ী পরিকল্পিত। তা ছাড়াও বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমে অন্য ধারার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও চালানো হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের মূলধারার শিক্ষাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি চালাচ্ছে ‘ইংলিশ ভার্সন’। এনজিও মহল থেকে চালানো হচ্ছে নানা ধরনের বিদ্যালয়। পাশাপাশি আছে আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার ধারা। তাছাড়াও আছে সরকারি ও বেসরকারি কয়েক ধারার মাদ্রাসা। মূলধারার পাঠসূচি, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক মোটেই সন্তোষজনক নয়। এখন মূল ধারার পাঠ্যপুস্তকের হেফাজতিকরণ নিয়ে প্রচারমাধ্যমে বাদ-প্রতিবাদ চলছে। আগে বিতর্ক ছিল জামায়াতিকরণ নিয়ে। সরকার কর্তৃক মাদ্রাসা ধারার আধুনিকীকরণের চেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় চলছে মূলধারার ইসলামীকরণের জন্য এই চাপ।

কথিত সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবিমুখ, জ্ঞানবিমুখ, অনুসন্ধিৎসাবিমুখ ও পরীক্ষামুখী করেছে। পঞ্চম, অষ্টম, নবম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে প্রবর্তিত পাবলিক পরীক্ষার ফল কেন্দ্রীয়ভাবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষণা করার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী যেসব কথা বলে আসছেন, তাতে শিক্ষা সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরীক্ষাসর্বস্ব ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষা আর পরীক্ষার ফলকে সমার্থক করে ফেলা হয়েছে। শিক্ষার অর্থ করা হচ্ছে, কথিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে জিপিএ ফাইভ পাওয়ার প্রস্তুতি। যারা সব পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে তারা সৃজনশীল। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে রাজধানী পর্যন্ত জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের যেভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তাতে জ্ঞানের প্রতি, শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহের কোনো কারণ থাকে না। এসব পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকে এখন সবাই মেনে নিচ্ছেন। জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো বই উপহার না দিয়ে দেওয়া হয় ক্রেস্ট। শিক্ষার্থীদের উপহার দেওয়ার মতো ভালো বই কি বাংলাদেশে পাওয়া যায় না? শিক্ষার্থীদের মনে ধারণা দেওয়া হচ্ছে যে ইন্টারনেটের যুগে বইয়ের দিন শেষ।

রাষ্ট্রের সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং পরীক্ষা গ্রহণে প্রতিটি শিক্ষাবোর্ড হওয়া উচিত স্বায়ত্তশাসিত। আর প্রত্যেক শিক্ষাবোর্ডের আওতায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ করার জন্য আলাদা আলাদা পাঠ্যপুস্তক শাখা প্রতিষ্ঠা করা উচিত। তাতে বিভিন্ন বোর্ডের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের ও শিক্ষার উন্নতি হবে। শিক্ষার পরীক্ষাসর্বস্ব ধারণা পরিহার্য। সর্বত্র বহুত্ববাদ, কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ কেন্দ্রিকতাবাদ কেন?

লেখক: শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh