স্ত্রী হত্যায় সাবেক এসপি বাবুল পিবিআই হেফাজতে

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১১ মে ২০২১, ১০:৩৫ পিএম

স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে সাবেক এসপি বাবুল আক্তার।

স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে সাবেক এসপি বাবুল আক্তার।

চট্টগ্রামে পাঁচ বছর আগে মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় সম্পৃক্ততা থাকায় তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এর আগে বাদী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোমবার রাতে তাকে চট্টগ্রামে ডেকে আনা হয়। মঙ্গলবার (১১ মে) তাকে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

মঙ্গলবার রাত ৮টার পর পিবিআইয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বিষয়টি নিশ্চিত করলেও কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাকে আগামীকাল আদালতে হাজির করে নির্দেশনা মতে নতুন করে মিতু হত্যায় আরেকটি মামলা দায়ের করা হতে পারে বলে জানিয়েছে সূত্র। 

এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মিতু হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে, বাদী পুলিশ কমকর্তা বাবুল আক্তারের সাথে পিবিআইয়ের লাগাতার আলোচনা হচ্ছে, কয়েকদিন ধরেই তার সাথে কথা হচ্ছে। এটা তারই অংশ।’ 

১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ের প্রকাশ্যে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে মাহমুদা আক্তার মিতুকে হত্যা করা হয়। ওই দিনই স্বামী তৎকালীন পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। অনেকবার আলোচিত এ মামলার চার্জশিট দেয়ার গুঞ্জন শোনা গেলেও কোনো অগ্রগতি নেই।

বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন ও শাশুড়ি সাহেদা মোশাররফ অব্যাহতভাবে হত্যাকাণ্ডের জন্য বাবুল আক্তারকে দায়ী করে আসছেন। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে কখনোই এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। গোয়েন্দা পুলিশ এর আগেও বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। শুরু থেকে চট্টগ্রামের ডিবি পুলিশ মামলাটির তদন্ত করে। তারা প্রায় তিন বছর তদন্ত করেও অভিযোগপত্র দিতে ব্যর্থ হয়। পরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালত মামলাটির তদন্তের ভার পিবিআইকে দেয়। 


ঘটনার বিবরণ

চট্টগ্রামে জঙ্গি দমন অভিযানের জন্য আলোচিত বাবুল আক্তার সিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি থেকে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দফতরে যোগ দেন বাবুল আক্তার। এর কয়েক দিনের মাথায় ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রামের ওআর নিজাম রোডের বাসা থেকে কয়েকশ গজ দূরে নগরীর জিইসি মোড়ে খুন হন বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু। মোটরসাইকেলে করে আসা কয়েকজন সেখানে ছেলের সামনে তাকে প্রথমে ছুরিকাঘাত করে। পরে গুলি করে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন বাবুল আক্তার।

এরপর চট্টগ্রামে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততাও মিতু হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণ হতে পারে ধরে নিয়ে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তবে অল্পদিনেই সে ধারণা থেকে সরে আসেন তদন্তকারীরা। হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা গুঞ্জনের মধ্যে ওই বছরে ২৪ জুন রাতে ঢাকার বনশ্রীতে শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন তার কাছ থেকে জোর করে পদত্যাগপত্র নেয়ার খবর ছড়ালেও সে বিষয়ে কেউ মুখ খুলছিলেন না।

তার ২০ দিন পর ২০১৬ সালের ১৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, বাবুলের অব্যাহতির আবেদন তার কাছে রয়েছে। আরও ২২ দিন পর ৬ সেপ্টেম্বর বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নানা আলোচনা সমালোচনার মধ্যে চুপ থাকা বাবুল আক্তার হত্যাকাণ্ডের দুই মাস পর ফেসবুকে স্ত্রীকে নিয়ে আবেগঘন একটি স্ট্যাটাস দিয়ে আবার আলোচনায় আসেন। মিতু হত্যার পর থেকে বাবুল ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে থাকলেও নতুন চাকরিতে (বেসরকারি) যোগ দেয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে ঢাকার মগবাজারে আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে শুরু করেন। 


মামলায় উঠে আসে যাদের নাম

সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের দায়ের করা মিতু হত্যা মামলায় ঘটনার পর সাতজনকে গ্রেফতার করা হলেও এ চার বছরে অধরা মূল অভিযুক্ত নিদের্শদাতা মুছা। গ্রেফতার অন্য আসামিরা হলেন- আনোয়ার, ওয়াসিম, এহতেশামুল হক ভোলা, সাইদুল ইসলাম সিকদার ওরফে সাকু, শাহজাহান, আবু নাসের গুন্নু ও শাহজামান ওরফে রবিন। এর মধ্যে আবু নাসের গুন্নু ও শাহজামান ওরফে রবিনের এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে সাবেক সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।

অপর চারজনের মধ্যে সাইদুল ইসলাম ওরফে সাকুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি তিনিই সরবরাহ করেছেন তার বড় ভাই মুসা সিকদার ওরফে আবু মুসাকে। মুসা এ মোটরসাইকেল চালিয়েই মিতু হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়। অপর তিনজনের মধ্যে এহতেশামুল হক ভোলা মিতু হত্যাকাণ্ডে অস্ত্র সরবরাহকারী। শাহজাহান, ওয়াসিম ও আনোয়ার হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল। এছাড়া মিতু হত্যায় সন্দেহভাজনদের মধ্যে রাশেদ ও নবী নামে দুইজন রাঙ্গুনিয়ায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।

বর্তমানে পলাতক আছে মুসা সিকদার ও কালু নামে দুইজন। ওই সময়ে পলাতক মুসাকে ধরতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে সিএমপি। তবে এরপরও সে ধরা পড়েনি। গ্রেফতারদের মধ্যে ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মুসার পরিকল্পনায় তারা মিতুকে খুন করেছে বলে জবানবন্দিতে দাবি করে।


দ্রুত চার্জশিট চেয়েছেন মিতুর বাবা

মিতুর মা শাহেদা মোশাররফ ও বাবা সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আমরা শুরু থেকে বলে আসছি যে বা যারা মিতুকে হত্যা করে থাকুক না কেন তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হোক। কিন্তু পুলিশ এখনও আমাদের জানাতে পারেনি কার নির্দেশে মিতুকে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টি বের করে আনতে এতো সময় লাগার কথা নয়। কোনো এক রহস্যজনক কারণে পুলিশ নির্দেশদাতাকে শনাক্ত করতে পারেনি। চার্জশিটও দিচ্ছে না। আমরা দ্রুত তদন্ত শেষ করে হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। তারা বিভিন্ন সময় এ খুনের পিছনে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারের সম্পৃক্তারও অভিযোগ তুলেছেন।


শনাক্ত হয়নি পরিকল্পনাকারী

এদিকে মিতুর স্বজনদের দাবি, মূল আসামিকে বাঁচাতে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে এ মামলার তদন্ত। তারা এ হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে মিতুর স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকেই ইঙ্গিত করছেন। যদিও তদন্তকারী সংস্থা এ বিষয় মুখ খোলেনি। সিএমপির ডিবিতে বাবুল আক্তারের অধীনে একই টিম কাজ করেছিলেন। যদিও বর্তমানে মামলাটি পিবিআই তদন্ত করছে।  

হত্যাকাণ্ডের পর বাবুলের শ্বশুর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন জামাতার পক্ষে কথা বললেও পরে তার মেয়ের হত্যাকাণ্ডের পেছনে জামাতার ‘পরকীয়া সম্পর্কের’ সন্দেহের ইঙ্গিত করে তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে তিনি এসব দাবি জানানোর পাশাপাশি ওই সময় সাংবাদিকদের কাছে এ দাবি করেন। বাবুল আক্তারের সঙ্গে উন্নয়নকর্মী গায়ত্রী সিং ও রাজধানীর বনানীর বিনতে বসির বর্ণি নামে দুই নারীর সম্পর্কের কথা বলেছিলেন তিনি।

তবে সে সময় উল্টো শ্বশুরপক্ষ তাকে ঘায়েল করতে চাচ্ছেন অভিযোগ করে সঠিক তদন্তেই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হবে বলে দাবি করেছিলেন বাবুল আক্তার।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh