নলকূপে পানি নাই

আরিফুর রহমান, সুবর্ণচর

প্রকাশ: ১৩ মে ২০২১, ০১:৩৫ পিএম

সর্বশক্তি প্রয়োগ করে গভীর নলকূপ থেকে পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে এক কলসি পানি ওঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন পঞ্চাশোর্ধ হালিমা খাতুন। বার বার চেষ্টা করেও পানি তুলতে না পেরে হতাশ হয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন তিনি। এ জনপদে গত কয়েক সপ্তাহ পূর্বেও কয়েক মিনিট কল চাপলেই কলসি পূর্ণ হতো; কিন্তু সেই নলকূপে এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা চাপলেও কলসি পূর্ণ করা যাচ্ছে না! নিজেদের গ্রামের নলকূপে পানি না থাকায় দুঃখ করে ভুক্তভোগী এ নারী আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের গ্রামে এখন নলকূপ আছে, পানি নাই।

গত ১ মাস ধরে উপজেলার চরক্লার্ক ইউনিয়ন, পূর্ব চরবাটা ইউনিয়ন, চরবাটা ইউনিয়ন, চরজুবলি ইউনিয়ন, চরজব্বার ইউনিয়ন, চরওয়াপদা ইউনিয়ন ও মোহাম্মদপুর ইউনিয়নসহ বেশকিছু গ্রামে গভীর নলকূপে পানি শূন্যতার কারণে সুপেয় পানির জন্য বড়ই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এই উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের। পূর্ব চরবাটা ইউনিয়নের চরমজিদ গ্রামের বেলাল উদ্দিনের খামার বাড়িতে কলসি নিয়ে হাজির হয়েছেন কয়েকজন নারী। এদের মধ্যে আয়েশা বেগম (৪৫) জানান, প্রায় ১ কিলোমিটার দূর থেকে এক কলস পানির জন্য এসেছি দেড় ঘণ্টা হলো এখনো পানি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারিনি। কখন পানি নিয়ে বাড়ি ফিরব জানি না। আর এখানেও নলকূপে তেমন পানি উঠছে না। 

চরবাটা ইউনিয়নের পোলট্রি খামারি আলাউদ্দিন জানান, নলকূপের পানি আমাদের একমাত্র ভরসা। নলকূপের বিশুদ্ধ পানি ছাড়া পোলট্রি খামার অচল প্রায়। গত এক মাস ধরে আমাদের নলকূপে পানি কম উঠছে, এতে আমরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। খামারে ঠিক মতো খাবার, পানি ও ওষুধ দিতে পারছি না। এ সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হলে বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে পোলট্রি খামারিদের। 

৮নং মোহাম্মদ ইউনিয়ন পরিষদ সচিব গোলাম কিবরিয়া জানান, গত একমাস ধরে ইউনিয়ন পরিষদের গভীর নলকূপ থেকে মোটরে পানি উঠছে না। আমরা অন্য স্থান থেকে পরিষদে পানির চাহিদা মেটাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, শুধু পরিষদের নলকূপ নয় এই ইউনিয়নের প্রায় গ্রামে নলকূপে পানি উঠছে না বলে অভিযোগ করছে এলাকাবাসী। এতে এই ইউনিয়নের বাসিন্দারা সুপেয় পানির জন্য দুর্ভোগ পোয়াচ্ছে দিনের পর দিন।

নলকূপে পানি না থাকার বিষয়ে স্থানীয়দের অভিযোগ, বোরো চাষের জন্য গ্রামে যত্রতত্র অনুমোদনহীন ও অপরিকল্পিতভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করে গভীর থেকে পানি উত্তোলনের কারণে গভীর নলকূপে পানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ভুক্তভোগীরা জানায়, বিগত ৩ যুগেও এই অঞ্চলে এ ধরনের নলকূপে পানির সংকট দেখিনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ  অনিশ্চিত হতে পারে।

অপরিকল্পিত ও অননুমোদিত গভীর নলকূপ স্থাপনের বিষয়ে উপজেলা বিএডিসি উপসহকারী প্রকৌশলী মো. শরিফুল ইসলাম জানান, উপজেলায় ৮টি ইউনিয়নে কৃষকদের মাঝে অনুমোদিত গভীর নলকূপ রয়েছে ১৫২টি ও বিএডিসির নিজস্ব নলকূপ রয়েছে ২০টি। অননুমোদিত ও অপরিকল্পিত গভীর নলকূপ রয়েছে সহস্রাধিক। তিনি জানান, অনুমোদিত একটি গভীর নলকূপে প্রতি ঘণ্টায় ১৮০০ কিউসেক পানি উত্তোলন হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে। গড়ে প্রতিদিন অনুমোদিত ১৭২টি গভীর নলকূপ থেকে ১০ ঘণ্টা করে ভূগর্ভ হতে পানি তুলছে কৃষক। এ ছাড়াও লাগামহীন ও অননুমোদিত সহস্রাধিক গভীর নলকূপ তো আছেই।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ জানান, ভূগর্ভের পানি রক্ষায় ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের লক্ষ্যে আমরা রবি মৌসুমে অন্যান্য লাভজনক ফলস চাষের পরামর্শ দিচ্ছি কৃষকদের। হাইব্রিড ধানে পানির শোষণ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় এবং এ অঞ্চলে পুকুর ও খাল বিলে পানি মজুদ না থাকায় ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভর করছে কৃষক। এদিকে এবার বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সম্পূর্ণ ভূগর্ভের পানি দিয়ে চাষাবাদ হয়েছে এ অঞ্চলে। ভূগর্ভের পানি রক্ষায় ও ভূগর্ভের পানির ওপর চাপ কমাতে কম পানি লাগে এমন লাভজনক অন্যান্য ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষকদের মাঝে প্রশিক্ষণ চলমান আছে।

গভীর নলকূপ স্থাপনের বিষয়ে এই কৃষি কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন বিএডিসির গভীর নলকূপ স্থাপনে অনুমোদন বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার রয়েছে। ফলে কত পরিমাণ ভূমিতে কি পরিমাণ পানি লাগবে সেই তথ্য নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। চাষ অনুযায়ী গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলে অবৈধ নলকূপ স্থাপন কমে আসত।

অবৈধ গভীর নলকূপ স্থাপন বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এএসএম ইবনুল হাসান বলেন, মাটির গভীর স্তরের পানি রক্ষায় অবৈধ ও অপরিকল্পিত গভীর নলকূপের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হবে। এই অঞ্চলের কৃষকদের উপরিভাগের পানি সঞ্চয় করতে উদ্বুদ্ধ করা হবে। এছাড়াও কম সেচ লাগে এমন ফসলের চাষ নিয়ে কৃষকদের মাঝে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে উপজেলা কৃষি বিভাগ।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh