বিপর্যস্ত মানুষের জন্য কী থাকছে বাজেটে?

এম এইচ রশিদ

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২১, ০৮:৪৩ এএম | আপডেট: ২৯ মে ২০২১, ০৮:৪৯ এএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে জীবনের পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষ জীবিকা নিয়ে বিপাকে আছেন। অচলাবস্থায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের, এমনকি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে যারা কর্মরত ছিলেন, করোনার কারণে তারা কাজ হারিয়েছেন। এদের বড় অংশই কাজে ফিরতে পারেননি। সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে, সেটিও তারা পাননি। তাই তাদের জন্য আগামী বাজেটে সুস্পষ্ট বরাদ্দ থাকতে হবে। 

যদিও সরকার থেকে বরাদ্দ রাখার কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু তাদের কর্মে ফিরিয়ে আনা এবং খাদ্য ও চিকিৎসার প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা জরুরি। তাদের কাছে নগদ টাকা পৌঁছানোর উদ্যোগ থাকতে হবে বাজেটে। 

সূত্র জানায়, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরে বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। এতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। 

করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত এমনিতেই। তবে বিপাকে স্বল্প আয়ের মানুষ। এক বছর কোথায় কীভাবে খরচ করা হবে, তার ঘোষণা থাকে বাজেটে। তাই এ বছরের বাজেটে প্রত্যাশা বেশি। মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেটি দেখার বিষয়। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোভিডকালে আমরা দেখলাম নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরাও কতখানি অসহায়। শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ও বেকার। এ ছাড়া অতিমারির কারণে নিম্নআয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে- চর, হাওর, উপকূল ও নদীভাঙনের এলাকায় বসবাসকারী মানুষ, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীরা এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। এ বাজেটের মাধ্যমে এদের সবাইকে একটি সর্বজনীন ও সামগ্রিক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার অধীনে আনা উচিত। এসব কারণে আগামী বাজেটে সরকারি ব্যয় করার সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টি সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

সামগ্রিকভাবে বাজেট প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, দেশের ভেতরে অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। অতিমারির অভিঘাত মোকাবেলার জন্য গত বাজেটেও একটি মধ্যমেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার অভাব ছিল। এবারও গতানুগতিক মনোভাব অব্যাহত থাকবে সে রকম একটি আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এবার প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো- অতিমারি-উত্তর আর্থ-সামাজিক পুনরুদ্ধারের জন্য একটি তিন বছরের পরিকল্পনা গ্রহণ। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মাধ্যমে বড় শহরের বাইরে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি, উচ্চমানের সেবা খাত এবং রফতানি পণ্যের নিট মূল্য বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। আর ব্যয় বাড়ানোর কথা বললে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত চলে আসে সবার আগে। বছরে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ ব্যয় করা হয়। একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক। বাজেটে চেষ্টা থাকতে হবে প্রতি বছর অন্তত জিডিপির শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করে বাড়িয়ে এ অনুপাত জিডিপির ৫ থেকে ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। একইভাবে শিক্ষা খাতে বর্তমানে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ ব্যয় হয়। এটাও প্রতি বছর জিডিপির শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করে বাড়াতে হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আসন্ন বাজেটে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় অগ্রাধিকারভিত্তিতে স্বাস্থ্য, কৃষি, সমাজকল্যাণ, খাদ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থাকছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আকারও বাড়ছে। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি বাজেটের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। আর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো হতে পারে। 

অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, দেশের চার কোটি মানুষ এখন দরিদ্রসীমার নিচে। তারা ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করতেন। তাদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। যারা একেবারেই দরিদ্র তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। আয় রোজগার বাড়াতে হবে। দারিদ্র্য যাতে আর না বাড়ে, সেটার ব্যবস্থা করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পুরোপুরি হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন খাত, পরিবহন ও হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এখনো মন্দা চলছে। এই মন্দার সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে কর্মজীবীরা মানুষ। ড. আবুল বারকাতের গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। এর মধ্যে ১ কোটি ৪৪ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। তারা এখনো কাজে ফিরতে পারেননি। 

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার কারণে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এমনকি আগে যারা মধ্যবিত্তের কাতারে ছিলেন, তারাও খাদ্য সংকটে ভুগছেন। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের একজন উদ্যোক্তা বিপাকে পড়ে সরকারের কাছে খাদ্য সহায়তা চেয়েছেন। অনেকে আগের ঋণ পরিশোধের পরিবর্তে নতুন করে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। 

সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান ও কৃষি খাতের ওপর জোর দিতে হবে। কারণ করোনার প্রভাবে অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তা দিতে না পারি, তাহলে যে অর্থনৈতিক কার্যক্রম, সেটার ক্ষতি হয়ে যাবে। গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণ, নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা চালু এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ থাকতে হবে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চিকিৎসাসামগ্রী এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি টিকা কার্যক্রম শক্তিশালী করাও চলমান কার্যক্রমের মধ্যে রাখতে হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh