চেতনার কবি নজরুল

হেনা সুলতানা

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২১, ০৯:০৮ পিএম | আপডেট: ২৯ মে ২০২১, ০৯:১১ পিএম

কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম

প্রথমত কাজী নজরুল ইসলাম মানুষ। মানুষ কবিতায় তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন- ‘গাহি সম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান।’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়ার পর সৈনিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতায় ফিরে আসেন। শৈলজানন্দের লেখা থেকে জানা যায়, কবি উঠেছিলেন তাদের হোস্টেলে ‘অতিথি’ হিসেবে; কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই জানাজানি হয়ে গেল ‘উনি মুসলমান’। তাই হোস্টেল সুপার তাকে ‘মেস’ ছাড়া করবার জন্য চাপ দিলেন শৈলজানন্দকে। বিষয়টি নজরুলও জেনে যান। ফলে তখন তিনি কলেজ স্ট্রিটে কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদের বাসায় গিয়ে ওঠেন। মুজাফ্ফর আহমেদ মহাসমারোহে অভ্যর্থনা জানালেন নজরুলকে। তিনি যে তাঁরই প্রতীক্ষা করছিলেন। এভাবে ব্যক্তিগত জীবনে মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলো, সুন্দরের ধ্যান ও আদর্শ তাঁর চোখে টিকে থাকতে পারেনি। জন্মেই তাপ অনুভব করেছেন কঠিন পৃথিবীর স্বার্থের নিঃশ্বাস। সুন্দর তাঁকে বারবার হাতছানি দিলেও দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে ভেঙে গেছে সুন্দরের স্বপ্ন। ঠিক এই অবস্থায় যারা শিল্প-সত্তা খোঁজার নামে নজরুলের সাহিত্যকে পোস্টমর্টেম করতে বসেন, তারা হয়তো ভুলে যান যুগের যন্ত্রণা ও বুকের বিষ-জ্বালাই নজরুলকে শিল্পী করেছে।

কাজী নজরুল ইসলাম দেখেছেন মহাযুদ্ধ, অংশ নিয়েছেন সে যুদ্ধে, দেখেছেন তার ধ্বংসলীলা, যুদ্ধের পর বাজার মন্দা, অর্থনৈতিক সংকট, চোরা কারবারিদের দোর্দণ্ড প্রতাপ, সমাজ লিপ্সা, মানবাত্মার অপমান, নারীর অমর্যাদা, সামান্য অর্থে পশুশক্তির কাছে বিকোচ্ছে মা-বোনদের সম্ভ্রম সর্বোপরি মুখোশপরা ভদ্রবেশী বর্বরতা।

যুগের এই সমস্ত ঘটনা নজরুলের কবি মানসে তীব্র উত্তাপ ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেই তাকে সাহিত্য জগতে টেনে এনেছে। সুতরাং কলাকৌশলবাদী হয়ে তিনি সাহিত্য রচনা করতে পারেননি। ভেতরের বেদনা যেমন নিংড়ে বের করে আনে অশ্রুজল- ঠিক তেমনি নগ্ন, পীড়িত, হেয়, অপাংক্তেয় মানুষের হতাশা ও দুর্দশা, দেখেছেন বন্দি দেশমাতার ম্লান মুখ। দেখেছেন কোথাও কোনো প্রতিকার নেই। তাই তাঁর কলম থেকে সোজাসাপ্টা অনায়াসে বেরিয়ে এসেছে ভেতরের যন্ত্রণা-  বন্ধু গো আর বলিতে পারি না, বড় বিষজ্বালা এই বুকে! দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে কই মুখে। এই যখন অবস্থা তখন কাজী নজরুল ইসলামের জন্য আর্টের চর্চা ছিল সত্যিই বিলাসিতা। নজরুল কাব্য ও শিল্পকলা আলোচনা করতে গিয়ে নজরুলচর্চায় ঋদ্ধ লেখক আজহারউদ্দিন লিখেছেন, ‘তাঁর কবিতা প্রচলিত রাষ্ট্রীয় শাসন, সমাজ-ব্যবস্থা, সংস্কারাদির মূলে কুঠারাঘাত করেছিল অন্যায়ের জন্য। তিনি প্রগতির কবি এবং জনপ্রিয় কবি। .... কাব্য রচনায় বসে তিনি কাব্যালঙ্কারের দিকে তাকাননি, তাকিয়েছেন তাঁর বিরাট দেশের দিকে- দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অত্যাচারে নিষ্পেষিত জনতার দিকে- যারা রুটি চায়, কাজ চায়, চায় সৌন্দর্যকে ভোগ করার মতো শান্ত পরিবেশ।’

সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে কবি বারবার মাটির দিকে তাকিয়েছেন। কল্পনায় ভাসবার মতো অবস্থা তার ছিল না। কবি নিজেই বলেছেন- ‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,/কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুজে তাই সই সবি!’ কবির কলম যে সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, রাখে বলিষ্ঠ ভূমিকা বাংলা সাহিত্যে তার প্রথম দৃষ্টান্ত নজরুল। যেখানেই অন্যায় অত্যাচার ও অবিচার দেখেছেন সেখানেই তাঁর কলম গর্জে উঠেছে সংগ্রামী ভূমিকায়। সমাজের যে কোনো অন্যায়-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে যদি সোচ্চার না হওয়া যায় তা হলে সে হয় সমাজের ও কর্তব্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। নজরুল প্রকৃতপক্ষেই সমাজ ও তার কর্তব্যের প্রতি সচেতন ছিলেন। কবি নজরুলের প্রতি প্রায়ই একটি অভিযোগ শোনা যায় যে ‘তিনি বিশেষ যুগের- তাঁর কাব্য কালোত্তীর্ণ ও মানোত্তীর্ণ হয়ে চিরন্তন আবেদনে ভাস্বরিত হয়নি, এ মনোভাব সংকীর্ণতাবশত। কবি তার জবাব দিয়েছেন-  ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায়- ‘রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,/ তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা,/ বড় কথা বড় ভাব আসে না’ক মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!/ অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!/ পরোয়া করি না, বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে/ মাথার ওপর জ্বলিছে রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।/ প্রার্থনা ক’রো - যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটির মুখের গ্রাস,/ যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।’

মানুষের দুর্দশাকে এড়িয়ে যে শিল্পকলা রচিত হয় তা আজকের এই মানবতার যুগে সমর্থন করা যায় না। কোন লোভ, প্রলোভনের মোহ নজরুলের শৈল্পিক সত্তাকে বিনাশ করতে পারেনি। নজরুলের শিল্প-সত্তায় প্রতিফলিত হয়েছে যুগের প্রতিচ্ছবি। ম্যাক্সিম গোর্কি ছিলেন এমনই এক মানবতাবাদী লেখক। তিনি তাঁর সাহিত্যে লিখতেন ক্ষেত-খামারে খেটে খাওয়া নিচুতলার মানুষদের কথা। তাঁর বিরুদ্ধেও উঠেছিল অভিযোগ। আর এরই উত্তরে শিল্প ও শিল্পী সম্বন্ধে গোর্কি লিখেছিলেন- ‘শিল্পী হচ্ছেন তাঁর দেশ ও তাঁর স্বদেশ ও সমাজের যেন চক্ষু, কর্ণ আর হৃদয়। এক কথায় তার যুগের বাণী বা প্রতিধ্বনি। তিনি যথাসাধ্য সব কিছু জানবেন। অতীতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকবে যত বেশি ততই তিনি নিজের যুগকে ভালোভাবে বুঝতে পারবেন, ততই তিনি তার কালের সার্বজনীন বিপ্লবী রূপ ও কর্তব্যেও পরিধি তীব্রভাবে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। জনগণের ইতিহাস তাঁর জানা উচিত, শুধু জানা উচিত বললে হবে না, তাঁকে তা জানতেই হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে জনগণের মনোভাব কি তা-ও তাকে বুঝতে হবে।’

রোমা রোঁলা বলেছেন আরও খোলামেলা ভাবে, শ্রমিকরা যে পথ গড়েছে বুদ্ধিজীবীদের তা আলোকিত করতে হবে। তাঁরা দুটি ভিন্ন মজুরের দল কিন্তু কাজের লক্ষ্য এক।... যে সংগ্রাম নতুন পৃথিবীর সৃষ্টি করছে তার মহান যোদ্ধা হওয়ার চাইতে বুদ্ধিজীবীদের আর কোনো বড় কাজ নেই। মানুষের বেদনার উত্তাপ নিজে অনুভব করে যে সাহিত্য রচিত হয় তাই-ই বিশুদ্ধ শিল্প। নজরুল ছিলেন এই ঘরানার সাহিত্যিক। শোষিত মানুষের প্রতি তাঁর দরদ, সাম্য ও মুক্তির অধিকার সর্বস্বীকৃত করার জন্য তাঁর অক্লান্ত প্রয়াস তাঁকে সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। মুক্তিকামী মানুষ মাত্রই তাঁকে আপনার বলে মনে করে। জাতি ভেদকেই নজরুল সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেছেন। মানুষকে দেখেছেন সবার ওপরে। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নেই আত্মপর।’ শুধু বাংলা বা ভারতের জন্যই নয়, হিন্দ-মুসলমান বা বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের জন্য নয় নিখিল বিশ্ব ও মানবতার জন্য গভীর আকুতি ছিল নজরুলের। সাম্যবাদ কবিতায় কবি বলেছেন- ‘গাহি সাম্যের গান-/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ মুসলিম ক্রীশ্চান।’

১৮৪১ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতিতে ভাষণ দিতে গিয়ে নজরুল বলেছেন, ‘হিন্দু মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ মানুষের একদিকে কঠোর দারিদ্র ঋণ, অভাব অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম -অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুন্দরকে সংহার করতে এসেছিলাম। আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম সুন্দর।’ যারা দূর থেকে দূরবীন লাগিয়ে সমাজ ও মানুষ দেখেন- তারা কখনো জনগণের শিল্পী নন, নন জীবনমুখীও। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলছেন আক্ষেপ করে- ‘আমার কবিতা জানি আমি/গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।/কৃষকের জীবনের শরীক যে জন,/ কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন/যে আছে মাটির কাছাকাছি/সে কবির বাণীর লাগি কান পেতে আছি॥’ রবীন্দ্রনাথের নিকট কাঙ্ক্ষিত মটির কাছাকাছি কবি ছিলেন- কাজী নজরুল ইসলাম। এবং বাঙালি চেতনার কবিও তিনি-ই।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh