নজরুলের কয়েকটি কবিতার জন্মকথা

সৈয়দ জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২১, ০৪:৪৭ পিএম

কাজী নজরুল ইসলা

কাজী নজরুল ইসলা

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)-এর আসন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪৪) সমপঙক্তিতে। শুধু সৃষ্টির প্রাচুর্যেই নয়, গুণগত মূল্যেও রবি-নজরুল একসঙ্গে উচ্চারণযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যখন তাঁর গীতিনাট্য ‘বসন্ত’ নজরুলকে উৎসর্গ করেন নজরুল তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি। উৎসর্গ পত্রে রবীন্দ্রনাথ লেখেন- ‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু’। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া ‘কবি’ স্বীকৃতিতে সেদিন রবীন্দ্রনাথের অনেক ভক্তই খুশি হননি বলে তথ্য পাওয়া যায়- রশীদ হায়দার (সম্পাদিত) : রবীন্দ্রনাথ : নজরুল, পৃষ্ঠা : ৪৮-৪৯, প্রথম প্রকাশ, ২০১১, নজরুল ইনস্টিটিউট। রবীন্দ্রনাথ নিজে যাকে ‘কবি’ বলে আখ্যা দিয়ে নিজ আসনের পাশে স্থান দিয়েছেন সেই কবিকে আমরা অগ্রগণ্য কবি বলে গৌরবমাল্য পরাতেই পারি। উপনিবেশবিরোধী নজরুল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের চোখে রাজদ্রোহী হতে পারেন কিন্তু বাঙালির হৃদয়রাজ্যের তিনি মুকুটহীন রাজা। শিল্পমাধ্যম যা কিছুই হোক না কেন, যাঁরা শিল্পের সাধক- তাঁরা বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে বিশেষ বিশেষ শিল্প সৃষ্টি করেন। এ প্রসঙ্গে আমরা রবীন্দ্রনাথের অনেক শিল্পকর্মেরই উদাহরণ টানতে পারি। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন, বিশ্বের আরো অনেক শিল্পীর শিল্পকর্মের নেপথ্য-কাহিনিই উল্লেখ করা যেতে পারে। উদাহরণ দীর্ঘ না করে কাজী নজরুলের বিখ্যাত কয়েকটি কবিতার নেপথ্য-কাহিনি বিবৃত করতে চাই।

নজরুলের প্রথম কাব্য ‘অগ্নি-বীণা’ নজরুল উৎসর্গ করেছিলেন বিপ্লবী শ্রী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের (১৮৮০-১৯৫৯) শ্রী চরণারবিন্দে। অগ্নি-বীণার উৎসর্গপত্রটি ১৯২০ সালে লেখা হয়েছিল ছন্দোবদ্ধ পত্র হিসেবে। কেন নজরুল এই ছন্দোবদ্ধ পত্রটি লিখেছিলেন তাঁর নেপথ্য কথা নজরুল সুহৃদ কমরেড মুজফ্ফর আহমদ বর্ণনা করেছেন এভাবে- তখন আমরা ‘নবযুগ কাগজ বা’র করছি, আর থাকছি ৮/এ টার্নার স্ট্রিটে। বারীন্দ্রকুমার ঘোষেরা থাকতেন শ্যামবাজারে মোহনলাল স্ট্রিটে। তাঁদের সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ও প্রকাশিত হতো ওই ঠিকানা হতেই। শ্রী চিত্তরঞ্জন দাসের (তখনও দেশবন্ধু হননি) মাসিক কাগজ ‘নারায়ণে’র পরিচালনার ভারও ছিল শ্রীবারীন ঘোষেদের হাতে। নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁদের তখনও ব্যক্তিগত পরিচয় হয়নি। কিন্তু তাঁরা নজরুলের ‘বাঁধন-হারা’ হতে (তখন ‘মোসলেম ভারতে’ ছাপা হচ্ছিল) ছোট ছোট অংশ ‘নারায়ণে’ তুলে দিয়ে তাঁর ওপরে ভালো মন্তব্য লিখতেন। ‘আদি পুরোহিত’ ও ‘সাগ্নিক বীর’ রূপে শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষের ওপরে নজরুলের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল! তাঁর ওপরে, তাঁরা তাঁর লেখা সম্বন্ধে ভালো কথা বলছিলেন। এই সূত্রে তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে নজরুলের আগ্রহ খুব বেড়ে যায়। সে তখন ছন্দে শ্রী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে একখানা ছোট্ট পত্র লেখে। ১৯২০ সালের এই ছন্দোবন্ধ পত্রখানাই হচ্ছে ১৯২২ সালে মুদ্রিত ‘অগ্নি-বীণা’র উৎসর্গের গান’ (মুজফ্ফর আহমদ : কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, ষষ্ঠ প্রকাশ, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা : ১২৬-১২৭, মুক্তধারা, ঢাকা)। ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যের প্রথম কবিতার নাম ‘প্রলয়োল্লাস’। 

নজরুল কবে, কোথায়, কী কারণে ‘প্রলয়োল্লাস’ লিখেছিলেন এসব নিয়ে একেক গবেষক একেক তথ্য পরিবেশন করেছেন। আজহার উদ্দীন খান ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ গ্রন্থে যে তথ্য দিয়েছেন সুশীলকুমার গুপ্তও ঠিক একই কথা বলেছেন। তাঁদের তথ্য ভ্রান্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে মন্মথ রায় প্রযোজিত ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম’ শিরোনামের তথ্যচিত্র। উপরিউক্ত গ্রন্থকারদ্বয়-প্রলয়োল্লাসের পটভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন প্রসঙ্গ এবং রচনাকাল নির্দেশ করেছেন ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু মুজফ্ফর আহমদ আবিষ্কার করেছেন ভিন্ন পটভূমি। মুজফ্ফর আহমদ তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, “প্রলয়োল্লাস ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তো রচিত হয়নি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দেও তাঁর রচনাকাল নয়। কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে কুমিল্লায় ... ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শেষাশেষিতে আমরা এদেশের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলব স্থির করেছিলাম। কাজী নজরুল ইসলামও আমাদের এই পরিকল্পনায় ছিল। রুশ বিপ্লবের ওপরে যে সে আগে হতেই শ্রদ্ধান্বিত ছিল... আমাদের এই পরিকল্পনা হতেই সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর সুবিখ্যাত ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতা। তাঁর সিন্ধু পারের ‘আগল ভাঙ্গা’ মানে রুশ বিপ্লব। আর প্রলয় মানে ‘বিপ্লব’। আর জগৎজোড়া বিপ্লবের ভিতর দিয়েই আসছে নজরুলের নূতন অর্থাৎ আমাদের দেশের বিপ্লব। এই বিপ্লব আবার সামাজিক বিপ্লবও।” [রফিকুল ইসলাম : নজরুল-জীবনী, প্রথম মুদ্রণ, ২০১৩, পৃষ্ঠা : ১৮০-১৮১, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা]

‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখার কারণেই নজরুলকে ‘বিদ্রোহী কবি’ বলা হয়। ৩/৪-সি, তালতলা লেনের একটি দোতলা বাড়িতে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে রাতের বেলা কবি এই কবিতাটি পেন্সিল দিয়ে লিখেছিলেন। এই কবিতার প্রথম শ্রোতা ছিলেন মুজফ্ফর আহমদ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বিজলী’ পত্রিকায়। ‘মোসলেম ভারত’ নাকি ‘বিজলী’ কোন পত্রিকায় এটি প্রথম ছাপা হয়েছিল এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও মুজফ্ফর আহমদ সন-তারিখ ঘেঁটে সিদ্ধান্তে আসেন যে ‘বিজলী’ পত্রিকাই প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের দাবিদার। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাপা হওয়ার পরে কাজী নজরুল ইসলাম কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। কবিতাটি শোনার পরে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন শ্রী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য।

‘খেয়াপারের তরণী’ নজরুলের আরেকটি বিখ্যাত কবিতা। এই কবিতা পড়েই মুগ্ধ হয়ে কবি মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) ‘মোসলেম ভারতে’র সম্পাদককে পত্র লেখেন এবং এগারো বছর বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও মোহিতলাল-নজরুলের সখ্য গড়ে ওঠে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির মতো এই কবিতাটিও রাতের বেলা রচনা করেছিলেন নজরুল, তবে তালতলা লেনের বাড়িতে নয়, ৮/এ টার্নার স্ট্রিটের বাড়িতে। ‘শাতিল-আরব’ কবিতাটি যেমন একটি নদীর ছবি দেখে লিখেছিলেন নজরুল তদ্রুপ ‘খেয়াপারের তরণী’ কবিতাটিও রচনা করেছিলেন ঢাকার বেগম মুহম্মদ আজম সাহেবার আঁকা একটি ছবি দেখে। এ প্রসঙ্গে মুজফ্ফর আহমদ যে তথ্য উল্লেখ করেছেন, তা হলো- “তখন নজরুল ইসলাম আর আমি ৮/এ, টার্নার স্ট্রিটে বাস করছি। কি কারণে জানি না, আফজালুল হক সাহেব ঢাকা গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ‘মোসলেম ভারতে’ ছাপানোর উদ্দেশ্যে ঢাকার বেগম মুহম্মদ আজম সাহেবার (খান বাহাদুর মুহম্মদ আজমের স্ত্রীর) আঁকা একখানা নৌকার ছবি সঙ্গে নিয়ে আসেন। পত্রিকায় ছাপানোর আগে ছবিখানার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখিত হওয়ার দরকার ছিল। তাঁর জন্যে ছবিখানা একদিন বিকালবেলা নজরুল ইসলামের নিকটে আফজালুল হক সাহেব রেখে গেলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, নজরুল ইসলাম গদ্যে এই আধ্যাত্মিক ছবিখানার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখে দিবে; কিন্তু নজরুল তা করল না। সে রাত্রিবেলা প্রথমে মনোযোগ সহকারে ছবিখানা অধ্যয়ন করল এবং তাঁরপরে লিখল এই ছবির বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘খেয়াপারের তরণী’।” [মুজফ্ফর আহমদ : প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ৪৫] 

১৯২৬ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। এই দাঙ্গা তিন দফায় লেগেছিল। প্রথমে কয়দিন হয়ে মাঝে কয়দিন বন্ধ থাকে। তাঁরপর আবার কয়দিন হয়ে কয়দিন বন্ধ থাকে। তৃতীবার কয়েকদিন দাঙ্গা চলার পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। এই জীবনঘাতী দাঙ্গায় বহু হিন্দু-মুসলমান হতাহত হয়। এই দাঙ্গার ভয়াবহ রূপ দেখে অস্থির হয়ে ওঠেন নজরুল। দাঙ্গাপীড়িত মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুভব করে নজরুল লিখেন তাঁর ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটি। শ্রী নারায়ণ চৌধুরী তাঁর ‘সঙ্গীতে কাজী নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন- সুভাষচন্দ্র বসুর (১৮৯৭-১৯৪৫) অনুরোধে নজরুল ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ লিখেছিলেন, কিন্তু এ কথা সঠিক নয়, কেননা নজরুল যখন কবিতাটি লেখেন তখন সুভাষ বসু বার্মার জেলে বন্দি ছিলেন। 

কাজী নজরুল ইসলাম ছন্দের জাদুকর হিসেবে পরিচিত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে (১৮৮২-১৯২২) ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত চোখের পীড়ায় অন্ধ হবার উপক্রম হন। এ সময় তিনি ‘খাঁচার পাখী’ নামে একটি বেদনাবিধুর কবিতা লিখে নিজের জীবনের দুর্দশার ছবি তুলে ধরেন। এই কবিতাটি পড়ে নজরুল খুবই ব্যথিত হন এবং সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে সান্ত¦না দেবার জন্য ‘দিল দরদী’ কবিতা লেখেন। ‘দিল দরদী’ কবিতাটি পড়ে সত্যেন্দ্রনাথ আপ্লুত হন এবং নজরুলের সঙ্গে দেখা করার জন্য ৩/৪-সি, তালতলা লেনের বাড়িতে যান। সত্যেন্দ্রনাথ মাত্র চল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল ইসলাম যে কবিতা রচনা করেন তাঁর নাম- ‘সত্য কবি’। 

নজরুল তাঁর জীবদ্দশায় অনেক শিশুতোষ কবিতা লিখেছেন। এ রকম একটি কবিতা হলো ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’। এই কবিতাটি নজরুল কুমিল্লায় বসে রচনা করেন। ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’ কীভাবে লেখা হলো তাঁর বিবরণ নজরুল নিজেই দিয়েছিলেন মুজফ্ফর আহমদকে। মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন- “সে (নজরুল) একদিন দেখতে পেল যে শ্রী ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের শিশু কন্যা জটু (ভালো নাম অঞ্জলি সেন) একা একা কাঠবেড়ালির সঙ্গে কথা বলছে। তা দেখেই সে কবিতাটি লিখে ফেলে। কবিতার ‘রাঙা দা’ হচ্ছেন শ্রী বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত, ‘বৌদি’ তাঁর স্ত্রী, আর ছোড়দি বীরেন সেনের বোন কমলা দাশগুপ্ত। ‘রাঙা দিদি’ মানে প্রমীলা সেনগুপ্ত, পরে নজরুল ইসলামের স্ত্রী।” [মুজফ্ফর আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৮] 

নজরুল ভারতভূমিতে জন্ম নিলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তিনি নানা উপলক্ষে বাংলাদেশের জেলায় জেলায় ঘুরেছেন এবং কবিতা-গান রচনা করেছেন। বাংলার মাটি নজরুলকে যেমন সম্মান দিয়েছে, তেমনি এই মাটিই তাঁকে দগ্ধ করেছে সবচেয়ে বেশি। নজরুল-নার্গিস ট্র্যাজেডি বাংলার মাটিতেই সংঘটিত হয়েছিল, বঙ্গললনা প্রমীলাকে বিয়ে করেও সামাজিকভাবে আঘাত পেয়েছেন নজরুল। নজরুল-প্রমীলার বিবাহকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ই নজরুলের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগে। বিশেষ করে ব্রাহ্ম সমাজের একটি অংশ প্রকাশ্যে নজরুলের বিরোধিতা করা শুরু করে। এর ফলে মাসিক ‘প্রবাসী’তে নজরুলের লেখা বন্ধ হয়ে যায়। নজরুল-প্রমীলার বিবাহ তৎকালীন সমাজে কতটা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল এবং এই বিবাহের ফলে নজরুল কী কী সমস্যা মোকাবেলা করেছেন, তাঁর প্রমাণ নিম্নের উদ্ধৃতি থেকে পাওয়া যাবে।

নজরুলকে উদ্দেশ করে বিশেষ করে বিবাহের পর থেকে মুসলমান, হিন্দু ও ব্রাহ্ম সমাজের গোঁড়া সম্প্রদায় ‘ইসলাম-দর্শন’, ‘মোসলেম দর্পণ, ‘শনিবারের চিঠি’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় যে অন্যায় আক্রমণ পরিচালনা করছিল, তাঁর উত্তরে নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘আমার কৈফিয়ত’ হুগলিতে রচিত। [রফিকুল ইসলাম : প্রাগুক্ত, ২৭২] 

‘প্রবাসী’ ও ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার বিখ্যাত লেখকরা অর্থাৎ সজনীকান্ত দাস ও মোহিতলাল মজুমদারের নেতৃত্বে নজরুলের ওপর যে আক্রমণ শুরু হয় তা অবর্ণনীয়। ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকাটির জন্মই হয়েছিল নজরুলবিরোধিতার জন্য এমন কথা সজনীকান্ত দাস নিজেই তাঁর লেখায় স্বীকার করেছেন। মোহিতলাল মজুমদারের নজরুলবিদ্বেষও এ সময় চরমে ওঠে। সজনীকান্ত দাস লিখেছেন-

“নজরুলকে ‘শনিবারের চিঠি’ কম গালি দেয় নাই, সত্য কথা বলিতে গেলে ‘শনিবারের চিঠি’র জন্মকাল হইতেই সাহিত্যের ব্যাপারে একমাত্র নজরুলকে লক্ষ্য করিয়াই প্রথম উদ্যোক্তারা তাক করিতেন, তখন আমি আসিয়া জুটি নাই। অশোক-যোগানন্দ-হেমন্ত এলাইয়া পড়িলে ওই নজরুলী রন্ধ্রপথেই আমি ‘শনিবারের চিঠি’তে প্রবেশাধিকার পাইয়াছিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মোহিতলালও ওই নজরুলের কারণেই আসিয়া জুটিয়াছিলেন, তবে আমাদের ছিল স্রেফে খেলা, মোহিতলালের ছিল জীবন-মরণ সমস্যা।” [মুজফফর : প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭২]

‘শনিবারের চিঠি’ নানাভাবে নজরুলকে জ্বালাতন করতে শুরু করে। উক্ত পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি হিসেবে ছাপা হয় সজনীকান্ত দাসের ‘কামস্কাটকীয়’ ছন্দে লেখা ‘ব্যাঙ’ কবিতা। শুধু ‘ব্যাঙ’ লিখেই সজনীকান্ত ক্ষান্ত হলেন না। যোগানন্দ দাস, অশোক চট্টোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস মিলে ‘বিদ্রোহী’ অবলম্বনে লেখেন ‘আমি বীর’ শিরোনামের আরেকটি প্যারোডি কবিতা। কবিতাটি ‘শ্রী অবলানলিনী কান্ত হাঁ, এম.এ.এ-জেড’ এই নামে মুদ্রিত হয়। রফিকুল ইসলাম তাঁর ‘নজরুল-জীবনী’ গ্রন্থে লিখেন- “সজনীকান্ত দাসের ‘কামস্কাটকীয় ছন্দে’র অন্তর্ভুক্ত ‘বিদ্রোহী’র প্যারোডি ‘ব্যাঙ’ শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত হলে নজরুল ইসলাম কবিতাটি মোহিতলাল মজুমদারের রচনা বলে অনুমান করেন। নজরুলের ধৈর্য ধারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, বিশেষ করে ‘শনিবারের চিঠি’র সঙ্গে মোহিতলালের ঘনিষ্ঠতা নজরুলকে পীড়িত করেছিল অধিক। ক্রমাগত আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় নজরুল তাঁর কল্লোলের বন্ধু-বান্ধবদের অনুরোধে লিখলেন ‘সর্বনাশের ঘণ্টা কবিতাটি।” [রফিকুল ইসলাম : প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ২৫৮-২৫৯] ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’ কবিতাটি কল্লোল পত্রিকার কার্তিক ১৩৩১ সংখ্যায় প্রকাশিত হলেও, নজরুলের ‘ফণি-মনসা’ গ্রন্থে এটি ‘সাবধানী ঘণ্টা’ নামে স্থান পায়।

কাজী নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেছেন আজ ৪৫ বছর হলো। এই ৪৫ বছরে এবং নজরুলের জীবদ্দশায় তার সম্পর্কে যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে সেই সব বইয়ে নজরুলের অনেক কবিতারই নেপথ্য-কথা বলা হয়েছে। অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে খুঁজলে সেসব পুস্তক থেকে নজরুল কবিতার নেপথ্য-কথা শিরোনামে একটি পরিপূর্ণ গ্রন্থ লেখা অসম্ভব নয়। নতুন কোনো গবেষক এ বিষয়ে দৃষ্টি দিলে নজরুলের কবিতার পাঠোদ্ধার করা সহজতর হবে, সমৃদ্ধ নজরুল-কাব্যের নান্দনিক ভুবন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh