বঙ্গবন্ধু ও ৬ দফার সংগ্রাম: অন্ধকার থেকে আলোয়

হেনা সুলতানা

প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২১, ০৯:২৭ পিএম | আপডেট: ০৭ জুন ২০২১, ১০:৪৩ পিএম

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

পলিমাটিতে মোড়া বাংলাদেশের মানুষের মনও কী সেই মাটিতে গড়া যা এক প্লাবনের পলিস্তর তার সকল দুঃখ-কষ্ট, ভাঙন-সৃজনসহ একেবারে ঢাকা পড়ে যাবে আরেক প্লাবনের পলিতে? 

না, বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের মন বারবার অভিষিক্ত হয়েছে নানা আন্দোলন আর অকাতরে রক্ত ঢালার ইতিহাসে। তার ইতিহাস সাহসিকতার ইতিহাস। বাঙালির রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনের ইতিহাস, সেখানে চিরস্থায়ী হয়ে আছে যে নামটি- সে নাম চিরভাস্বর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আজকের এই করোনা অতিমারির প্রকোপ ক্লিষ্ট বিপন্ন সময়ে, এই শতধা বিভক্ত সমাজমানসে, এই দুঃখ জর্জর, বঞ্চনা-পীড়িত অশক্ত সমাজে বঙ্গবন্ধুকে যোগ্যভাবে স্মরণ করতে ইতিহাসের পুনর্পাঠ একান্ত প্রয়োজন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ৬ দফার আন্দোলন। ৬ দফার আন্দোলন কেন করতে হয়েছিল? পিছন ফিরে তাকাতে হয়। 

১৯৬৬ সালের শুরু ছিল হতাশা ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এর সূচনা ১৯৫৮ সালে যখন জারি হয় আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, নিষিদ্ধ হয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড রুদ্ধ হয় বাক-স্বাধীনতা। সেই উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই। তবে সাফল্য বিশেষ মেলে না। আন্দোলন জোর খুঁজে পায় না প্রবীণ নেতদের ভীরুতা ও আপোষকামিতার কারণে। এই পটভূমিকায় ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন শেখ মুজিব। এর পরপরই ঘটে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সমাজ বিনষ্টের আয়োজন। এর বিরুদ্ধে জাগে বাঙালি সমাজের প্রতিরোধ। সংবাদ পত্রে ছাপা হয় সমবেত আহবান- “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও।” দাঙ্গা প্রতিরোধে শহরময় ছুটে বেড়ান শেখ মুজিব। এর পাশাপাশি চলে আইয়ুবের শাসন পাকাপাকি করার আয়োজন। তার প্রণীত শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রির ভোটে নিজেকে তথাকথিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট করার ব্যবস্থা। ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে আইয়ুব খান সদম্ভে ঘোষণা করেন- ২০ বছর অব্যাহত থাকবে তার শাসনতন্ত্র। 

নেমে আসে ঘোর তমসা। এই দুর্দিনে কবি সিকান্দার আবু জাফর লিখেছিলেন কবিতা ‘জনতার সংগ্রাম চলবে আমাদের সংগ্রাম চলবে ....’ ছাপা হলো দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায়। ক্রমেই শেখ মুজিবের মনে দানা বাধতে থাকে বাঙালির মুক্তির পথরেখা। ১৯৬৬ সাল ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধীদলের রাজনৈতিক কনভেনশনে শেখ মুজিব তার ৬ দফা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার দাবি তোলেন। প্রস্তাব অগ্রাহ্য হলো। সভা ত্যাগ করে তিনি সংবাদ সম্মেলনে পেশ করেন ৬ দফা। ঢাকার দেওয়াল ছেয়ে গেল ৬ দফার পোস্টারে পোস্টারে।

৬ দফার প্রথমেই রয়েছে গণতন্ত্রের দাবি। তারপর ৩, ৪ ও ৫নং দফায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে অর্থনীতির অধিকার। এদেশের হাতে থাকবে কর আরোপ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্য, পরিকল্পনা ও ইত্যাদি অধিকার। প্রয়োজনে দুই প্রদেশে থাকবে দুই মুদ্রা। ৬নং দফায় বলা হয়েছে সামরিক অধিকারের কথা।

৬ দফার দাবিতে ৭ জুন শেখ মুজিবের ডাকে মনু মিয়াসহ বহু শ্রমিক ঢেলে দিলেন বুকের রক্ত। বাংলার মানুষ তৈরি করলো ইতিহাস। ৬ দফা বাঙালির বাঁচার দাবি মুক্তির সনদ। সে আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল নতুন চেতনা। এটি বাঙালির ইতিহাসে এক মাইলফলক। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল অভিযাত্রা স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা।

 “বঙ্গবন্ধু ও  ৬ দফার সংগ্রাম: অন্ধকার থেকে আলোয় 

৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ জুন ১৯৬৬” শিরোনামে সোমবার (৭ জুন) রাত ৮টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর অনলাইনে মুজিব শতবর্ষে ৬- দফা দিবস উপলক্ষে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শণীর আয়োজন করেছে। প্রদর্শনীতে ৬ দফাকে কেন্দ্র করে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আরো অর্থবহ করার চেষ্টা সার্থক হয়েছে। এই প্রদর্শনীটি ৬ দফার সংগ্রমের একটি সামগ্রিক গবেষণার সারবস্তু হিসেবে রয়ে যাবে।

তবে, খুব স্বচ্ছ ভাষায় চমৎকার উপস্থাপনায় ৬ দফার পটভূমিসহ ইতিহাস তুলে ধরার নৈপুণ্যের কৃতিত্ব মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। প্রদর্শনীটির পরিকল্পনা বিন্যাস করেছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক ও আমেনা খাতুন। 

ড. রোজিনা ও আমেনা খাতুনের গবেষণাজাত এ তথ্যচিত্রটিতে সাধারণের কাছে ইতিহাস অত্যন্ত সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষার্থী যারা ইতিহাসের জটিল জায়গায় পৌঁছতে ক্লান্তিবোধ করে তাদের জন্য এটি ঐতিহাসিক ৬ দফার আন্দোলন কী ও কেন তা জানতে আবেদন সৃষ্টি করবে সন্দেহ নেই। 

তরুণ সমাজের কাছে সহজ করে ইতিহাস তুলে ধরা গেলে তারা ইতিহাস বিমুখ হবে না। এটাই এখন জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সে গুরুদায়িত্ব পালন করছে নিষ্ঠার সাথে। নানা বিষয় নিয়ে বিশেষ দিনগুলিতে তারা আয়োজন করে থাকে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান ও তথ্যচিত্রের প্রদর্শনীর। তাদের লক্ষ থাকে তরুণ প্রজন্ম।

প্রাণ ঢালা অভিনন্দন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে! 

লেখক: শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh