পুষ্টির অভাবে উচ্চতা কমছে শিশুদের

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২১, ১১:৩০ এএম

 ঠিকঠাক বৃদ্ধি না ঘটলে পিছিয়ে পড়বে শিশু। ছবি : সাম্প্রতিক দেশকাল

ঠিকঠাক বৃদ্ধি না ঘটলে পিছিয়ে পড়বে শিশু। ছবি : সাম্প্রতিক দেশকাল

শিশুর বড় হওয়ার সাথে উচ্চতার একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। দুইমাস আগে কেনা একটা জামা দেখলেন ঝুলে খাটো হয়ে গেছে কিংবা কিছুদিন আগে যে জায়গার সে নাগাল পেত না, সেখানে দিব্যি হাত পাচ্ছে। শিশুর উচ্চতা বলে দেয় তার শরীর সুস্থ আছে কি না।

শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা জানতে হবে নিয়মিত। কারণ ঠিকঠাক বৃদ্ধি না ঘটলে পিছিয়ে পড়বে শিশু। তাই সে বেড়ে উঠছে কি না জানতে হলে নিয়মিত শিশুর ওজন, উচ্চতা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দেয়া সর্বজনস্বীকৃত গ্রোথ চার্টের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে।

গবেষণায় দেখা গেছে, একমাত্র খাবারই বেড়ে ওঠার বছরগুলোতে একজন শিশুর উচ্চতাকে প্রভাবিত করতে পারে। উচ্চতার জন্য তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারণকারী উপাদান হলো- জিন, খাদ্য ও জীবনধারা।

অনেক সময়ই দেখা যায় বয়সের অনুপাতে ছেলেমেয়েদের শারীরিক গঠন ঠিকমতো হচ্ছে না। এজন্য অনেক ছেলেমেয়েই অনেক সময় থাকছে খর্বাকৃতির বা সহজ কথায় খাটো। আর এমনটা হলে ওই ছেলেমেয়েদের পড়তে হয় সামাজিক বিড়ম্বনায়। যা তার মানসিকতায়ও প্রভাব ফেলে। ফলে অনেক সময়ই সে তার সমবয়সীদের সাথে মিশতে পারে না বা তাকে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। 

শিশুর শরীর ঠিকমত না বাড়ার পিছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে পুষ্টির অভাব। শিশুর উচ্চতার বৃদ্ধি স্বাভাবিক হলে ঠিক আছে। গ্রোথ চার্ট মেনটেন করা জরুরি। বয়সভেদে নির্দিষ্ট ওজন ও উচ্চতা হয়। শিশু সেই মাপকাঠির আওতায় আছে কি না, তা মা-বাবা ও চিকিৎসক দুইজনকেই দেখতে হবে।


তবে গ্রোথ চার্টের উনিশ-বিশ হতেই পারে। জোর দিতে হবে শিশুর সার্বিক বৃদ্ধির দিকে। এর জন্য এক্সারসাইজ ও সুষম খাবার প্রয়োজন। আর একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, শিশুর শারীরিক গঠন কিন্তু অনেকটাই জেনেটিক। তাই জোর করে খাইয়ে বা প্রচুর ব্যায়াম করিয়ে সব সময়ে কাঙ্ক্ষিত ফল না-ও মিলতে পারে।

শিশু জন্মেরর পর প্রথম সপ্তাহে ওজন কমে ও দুই-তিন সপ্তাহে ওজন স্থির থাকে। এরপর ধীরে ধীরে ওজন বাড়তে থাকে। প্রথম তিন মাসে প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ গ্রাম করে ওজন বাড়ে। পরবর্তী মাসগুলোতে আরেকটু কম হারে ওজন বাড়তে থাকে, ৩-১২ মাস বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৪০ গ্রাম ওজন বাড়ে। ৬ মাস বয়সে শিশুর ওজন জন্মের সময়ের ওজনের দ্বিগুণ হয়, এক বছরে ৩ গুণ, দুই বছরে ৪ গুণ, তিন বছরে ৫ গুণ, পাঁচ বছরে ৬ গুণ হয়। 

তবে জন্ম-ওজনের পার্থক্যের কারণে একই বয়সী দুটি শিশুর ওজনের কিছু তারতম্য ঘটতে পারে। সঠিক পরিচর্যা ও পুষ্টি পেলে আবার স্বাভাবিক ওজনে পৌঁছে যায়।

স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা সাময়িকী দ্য ল্যানসেটের মতে, উচ্চতায় যে দেশের মানুষেরা এগিয়ে তাদের তুলনায় বাংলাদেশসহ মোট চারটি দেশের ছেলেমেয়েরা নিম্নমানের পুষ্টির কারণে সাত ইঞ্চির বেশি উচ্চতা হারাচ্ছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবচেয়ে ছোট মেয়েদের (১৯ বছর বয়সী) দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম দেখা গেছে। বাকি তিনটি দেশ নেপাল, গুয়াতেমালা এবং তিমুর।

যুক্তরাজ্যের ওষুধ প্রস্তুতকারী ও বায়োটেকনোলোজি কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার সহযোগিতায় দ্য ইমপিরিয়াল কলেজ লন্ডনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা ২০০ দেশের ৬৫ মিলিয়ন (৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী) অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে গবেষণাটি করেছেন। ২০১৯ সালে সংগ্রহ করা এই তথ্যে সবচেয়ে বেশি লম্বা দেখা গেছে নেদারল্যান্ডস, মন্টেনেগ্রো, ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ডের ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের। বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক এই পর্যবেক্ষণে লম্বাদের তুলনায় খাটো কিশোর-কিশোরীদের ওজনও কম দেখা গেছে।

ফলাফলে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের গড় উচ্চতা যতটুকু নেদারল্যান্ডসের ১১ বছর বয়সীদের উচ্চতা ততটুকু! গবেষণা প্রতিবেদনের সিনিয়র লেখক মজিদ এজাতি বলেছেন, ‘এতে বোঝা যাচ্ছে স্কুলে যাওয়ার আগে ও স্কুলে যাওয়ার দিনগুলোতে শিশুদের ওপর বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগে বড় পার্থক্য আছে। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময়ে অনেক দরিদ্র পরিবার পর্যাপ্ত পুষ্টি পাচ্ছে না’।

সবচেয়ে খাটোর তালিকায় বাংলাদেশের কিশোররা না থাকলেও উচ্চতা অনুযায়ী ওজনের সবচেয়ে নিম্নমানের তালিকায় তাদের দেখা গেছে। কার ওজন কত হওয়া উচিত, তার সূচককে বিএমআই বা বডি ম্যাস ইনডেক্স বলে। ভারত, বাংলাদেশ, তিমুর, ইথিওপিয়ার ছেলেমেয়েদের বিএমআই সবচেয়ে কম। শুধু মেয়েদের মধ্যে জাপান ও রোমানিয়ার কিশোরীদের উচ্চতা সবচেয়ে কম।

শিশুদের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য সহায়ক ব্যায়াম

ছয়-সাত বছরের আগে শিশুদের ব্যায়াম করানো মুশকিল। একদম ছোটরা নির্দেশ মেনে ঠিকমতো ভঙ্গিতে ব্যায়াম করতে পারবে না। তাই তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের খেলার মাধ্যমে শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখতে হবে।

৬ থেকে ১২ বছর বয়সটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ঠিকমতো ব্যায়াম এই সময়ে শিশুকে বাড়তে সাহায্য করবে। টিনএজারদের শারীরচর্চা আবশ্যিক। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ফিটনেস বিশেষজ্ঞ সৌমেন দাস বাড়ন্ত বয়সের শিশুদের জন্য বেশ কিছু স্ট্রেচিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, বাড়ন্ত বয়সের শিশুদের জন্য স্ট্রেচিং মাস্ট। এতে সে লম্বাও হবে, ফ্লেক্সিবিলিটিও বাড়বে।

পরামর্শগুলো হলো:

১. দেয়ালের দিকে পিঠ রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কানের পাশ দিয়ে হাত লম্বা করে উপরে তুলে দিতে হবে। এবার পায়ের আঙুলের উপরে ভর দিয়ে শরীরটা যতটা সম্ভব উপর দিকে টানার চেষ্টা করতে হবে। একসেটে তিনবার করে তিনসেট। শিশুর হাত কতটা দূর পৌঁছচ্ছে, সেটা পেনসিল দিয়ে দাগ দিয়ে রাখা যেতে পারে। একমাস পরে দেখা যাবে, দাগের চেয়ে কতটা উঁচুতে হাত যাচ্ছে।

২. মাটিতে পা দুটো ছড়িয়ে বসে, হাত দিয়ে পায়ের আঙুল ধরার চেষ্টা করতে হবে। মাথা নিচু থাকবে।

৩. বাটারফ্লাই ফিটও ভাল স্ট্রেচিং। মেঝেতে বসে দুটো পায়ের পাতা সামনাসামনি জুড়ে রাখতে বলুন। এবার হাঁটু অল্প ওঠানামা করতে হবে।

৪. ক্রস লেগ এক্সারসাইজ ও ফরওয়ার্ড-ব্যাক বেন্ডিংও ছোটদের জন্য ভাল ও জরুরি।

৫. দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে পায়ের পাতার সামনের অংশের উপর ভর দিয়ে উঁচু হতে হবে। এই অবস্থায় ১০ গুনে আবার পা নামিয়ে নিতে হবে। এটা ১০ বার করলেই চলবে, কাফ মাসলের জন্য খুব ভাল ব্যায়াম।

৬. স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ়ের পাশাপাশি জগিং, স্কিপিং, সাইক্লিং করলে ভাল। সুইমিং, ক্যারাটে, ব্যাডমিন্টন বা অন্য যেকোনো খেলার সাথে শিশুকে যুক্ত করা যেতে পারে।

এছাড়া সাঁতার আরেকটি স্বাস্থ্যকর শরীরচর্চা, যা শিশুর সামগ্রিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। নিয়মিত সাঁতার কাটলে মেরুদণ্ড শক্তিশালী হয় ও উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।

পাশাপাশি রাতে একটি ভালো ঘুম কেবল বড়দের জন্য নয়, শিশুদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিশুদের সুস্থ ও শক্তিশালী রাখার জন্য প্রতি রাতে তার অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাড়িতে বসে থেকে শিশুদের স্বাভাবিক জীবন যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনই বৃদ্ধি। তাই বাড়ির মধ্যেই যতটা পারা যায় শিশুদের ফিজিক্যালি অ্যাক্টিভ রাখতে হবে। শরীরচর্চার পাশাপাশি সুষম পুষ্টিও প্রয়োজন। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ভিটামিন সব কিছুই যেন থাকে শিশুর রোজকার ডায়েটে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh