সমির মল্লিক
প্রকাশ: ১১ জুন ২০২১, ১১:১৭ এএম
খাগড়াছড়িতে বাড়ছে আম
খাগড়াছড়িতে বাড়ছে আম, অর্থনীতির পরিধি বাড়ছে। প্রতি বছরই বাড়ছে বাগানের সংখ্যা। অনুকূল আবহাওয়া ও পাহাড়ের মাটি আম চাষের উপযোগী হওয়ায় বাড়ছে চাষের পরিমাণ। জেলায় ছোট-বড় আম বাগানের সংখ্যা প্রায় ৭ শতাধিক। একসময়ের অনাবাদি পাহাড়ে এখন আম চাষ হচ্ছে। আম চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেকে।
আম উৎপাদনের নতুন রাজধানী এখন খাগড়াছড়ি। চলতি মৌসুমে ৩ হাজার ৩৬৯ একর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। খাগড়াছড়ির ৯ উপজেলায় আমচাষির সংখ্যা বাড়ছে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা, মাটিরাঙা, গুইমারা, পানছড়িসহ সবখানেই বাড়ছে আমের আবাদ। জেলা সদরের ভাইবোন ছড়া ইউনিয়নের জোরমরম ও বানছড়া এলাকায় চাষির সংখ্যা প্রায় ১৫০ জন। পুরো এলাকায় আম চাষ হয়েছে। ছোট বড় আম বাগান গড়ে তুলেছে চাষিরা। সুজন চাকমা ২০০৭ সালে এই এলাকায় প্রথম বাগান গড়ে তোলেন। বিশ একর পাহাড়ি টিলাতে ২ হাজার আম গাছ রোপণ করেন তিনি।
তিনি জানান, ‘ প্রথম বাগান করার সময় গ্রামবাসী আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করত। এত আম কে খাবে বা বিক্রি হবে না বলত। তারা আমাকে সেগুন বা রাবার চাষ করার জন্য পরামর্শ দেয়। তবে এখন পুরো গ্রামে চাষির সংখ্যা দেড়শ জন। প্রত্যেকে দুই থেকে পাঁচ একরের চাষ গড়ে তুলেছে। আম বিক্রি করে প্রত্যেকে বছরে দুই থেকে ১০ লাখ টাকা আয় করছেন। সারাবছর আম বাগানের পরিচর্যা করতে হয়।’
বর্তমানে সুজন চাকমার আম বাগানের পরিমাণ প্রায় ৭৬ একর। এবার ২শ’ টন আম উৎপাদন হবে বলে জানিয়েছেন সুজন চাকমা। বাজারমূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা। সরেজমিনে বানছড়া এলাকায় দেখা যায়, গ্রামীণ সড়কের দু’পাশে ছোট ছোট টিলা পাহাড়। এসব পাহাড়ে আম্রপালি, রাংগুয়ায়, বারি-৪সহ বিভিন্ন জাতের আমের চাষ হয়েছে। প্রতিটি বাগানে আম ঝুলছে।
এলাকার স্থানীয় আমচাষি সুমন চাকমা, প্রশান্ত চাকমা ও কিরণময় চাকমা জানান, ‘প্রতিটি পরিবার আম বাগান গড়ে তুলেছে। প্রতি বছরই আমের বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি একর জমিতে ২ থেকে ৫ টন পর্যন্ত আম উৎপাদন হয়। প্রতিটি পরিবার আম বাগান থেকে ২-৬ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করে।’
খাগড়াছড়িতে আম চাষে লাখপতি হয়েছেন অনেক চাষি। জেলার মহালছড়ি এলাকায় ধুমনিঘাট এলাকায় ৩৫ একরের বাগান গড়ে তুলেছেন মহালছড়ি ফল বাগান মালিক সমিতির সভাপতি আম বাগানি কৃষক হ্ল্যাশিমং চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে বাগান গড়ে তুলেছি। বাগানে ৬০ প্রজাতির আম রয়েছে। গত মৌসুমে প্রায় ১০ লাখ টাকার আম বিক্রি করেছি। চলতি মৌসুমে উৎপাদন আরও বাড়বে। আম চাষে অনেকে আগ্রহী হচ্ছে। আমার সমিতির সদস্যসংখ্যা প্রায় ৩০ জন। প্রত্যেকের আম বাগান রয়েছে। অন্যান্য ফলের তুলনায় আম চাষ লাভজনক হওয়ায় আমচাষির সংখ্যাও বাড়ছে।
খাগড়াছড়ির মায়াবিনী লেক এলাকায় আম্রপালি, রাংগুয়াই ও বারি-৪ জাতের আমের বাগান গড়ে তুলেছে অংহ্ল্যা মারমা। তিনি বলেন, ‘বাগানে ১৩শ আম গাছ রয়েছে। এবার ভালো আমের ফলন হয়েছে। আমের ফলন তোলার আগে প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হলে। বাগানটি ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারব।’
খাগড়াছড়িসহ পাহাড়ি অঞ্চলে আমের ভালো ফলন হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলেন খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের ড. মুন্সী রাশীদ আহমেদ। তিনি জানান, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৫ থেকে ২০ বছর আগে থেকে আম চাষ শুরু হয়েছে। গত ১০ বছর ধরে ব্যাপকভাবে আমের চাষ শুরু হয়েছে। প্রতি বছরই নতুন করে আমের বাগান সৃজিত হচ্ছে। পাহাড়ে মাটি কিছুটা অম্রীয়ভাবাপন্ন এবং ঢালু অংশে চাষাবাদ করার কারণে সূর্যের আলো বেশি পায়। এখানে যে আম হয়, তা আকারে বড় হয় এবং মিষ্টি বেশি হয়। ফলে খাগড়াছড়িতে আম চট্টগ্রাম ও ঢাকার ফলমুন্ডিতে আলাদা নামে, আলাদা দামে বিক্রি হয়। এটি এই অঞ্চলের একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। আমকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়।
জেলা হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ কিশোর কুমার মজুমদার জানান, ‘১০ জুনের পরে আম্রপালি মাড়াই করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। জেলার চাহিদা মিটিয়ে আম দেশের বড় বড় বাজারে যাচ্ছে। হটিকালচার সেন্টার যে পরিমাণ আমের চারা উৎপাদন করছে তা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।’
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মর্ত্তুজ আলী জানান, ‘চলতি মৌসুমে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩৬ হাজার ৪০০ টন। একসময় খাগড়াছড়িতে আম উৎপাদন ছিল যৎসামান্য অথচ এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খাগড়াছড়ির আম যাচ্ছে। গুণ এবং মানে এখানকার আম বিশেষত আম্রপালি সারাদেশে সমাদৃত। আম চাষের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বছরে আম চাষকে কেন্দ্র করে প্রায় ১৬০ কোটি টাকার লেনদেন হয়।